
আট দিনের মিশনে মহাকাশে গিয়েছিলেন, কিন্তু কাটাতে হলো দীর্ঘ নয় মাস। অবশেষে পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন নাসার দুই মহাকাশচারী বুচ উইলমোর ও সুনিতা উইলিয়ামস।
চারটি প্যারাসুট খুলে গিয়ে ফ্লোরিডা উপকূলে মৃদুভাবে স্প্ল্যাশডাউন (স্পেসক্রাফ্টের পানিতে অবতরণ) করার আগে তাদের স্পেসএক্স ক্যাপসুলটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে অতি দ্রুত গতিতে স্ফূলিঙ্গের মতো পুনঃপ্রবেশ করে।
পানিতে অবতরণের পর তাদের যানকে ঘিরেছিল একঝাঁক ডলফিন।
একটি উদ্ধারকারী দল অবতরণের পর ওই যানকে পানি থেকে তুলে আনে। তাদের সহকর্মী তথা ক্রু সদস্য নভোচারী নিক হেগ এবং আলেকজান্ডার গরবানভের সঙ্গে যানটির হ্যাচ খুলে বেরিয়ে আসার সময় বেশ খোশ মেজাজে দেখা গিয়েছিল সুনিতা উইলিয়ামস ও বুচ উইলমোরকে। অন্যদের উদ্দেশ্যে হাতও নাড়েন তারা।
নাসার কমার্শিয়াল ক্রু প্রোগ্রামের ব্যবস্থাপক স্টিভ স্টিচ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, "ক্রুয়ের সদস্যরা দারুণ কাজ করছেন।"
এরসঙ্গেই এমন এক মহাকাশ অভিযানের সমাপ্তি ঘটল যার মেয়াদ আসলে হওয়ার কথা ছিল মাত্র আট দিন।
ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে সফরের জন্য তৈরি মহাকাশযানটি একাধিক প্রযুক্তিগত সমস্যার সম্মুখীন হয়। এর ফলে সুনিতা উইলিয়ামস এবং বুচ উইলমোরের মহাকাশ যাত্রার মেয়াদ নাটকীয়ভাবে বাড়াতে হয়।
নাসার স্পেস অপারেশনস মিশন ডিরেক্টরেটের ডেপুটি অ্যাসোসিয়েট অ্যাডমিনিস্ট্রেটর জোয়েল মন্টালবানো বলেন, "ক্রু নাইন ফিরে আসতে পারায় দারুণ লাগছে। ল্যান্ডিংটি অসাধারণ ছিল।"
নভোচারীদের সহনশীলতা এবং নমনীয়তার জন্য তাদের ধন্যবাদ জানান তিনি। পাশাপাশি স্পেসএক্স-এর প্রশংসা করে বলেন এটি একটি "দুর্দান্ত অংশীদার" ছিল।
মহাকাশচারীদের পৃথিবীতে ফিরে আসার যাত্রায় সময় লেগেছে ১৭ ঘণ্টা।
ফিরে আসার পর, 'স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাকটিস' মেনে নভোচারীদের স্ট্রেচারের সাহায্যে নিয়ে যাওয়া হয়। মাধ্যাকর্ষণহীন পরিবেশে এত দীর্ঘ সময় কাটানোর পর এটাই নিয়ম। তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য একটি মেডিক্যাল টিম রয়েছে।
ওই টিমের বিশেষজ্ঞরা তাদের শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করে দেখার পরই নিজেদের পরিবারের সঙ্গে আবার মিলিত হতে পারবেন মহাকাশচারীরা।

ছবির উৎস,NASA
ব্রিটেনের প্রথম নভোচারী হেলেন সারম্যান জানিয়েছেন, সবচেয়ে বড় বিষয় হবে অভিযান থেকে ফেরার পর পরিবার এবং বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে যখন তারা দেখা করবেন।
হেলেন সারম্যানের কথায়, "বন্ধুবান্ধব, পরিবার এবং যেসব মানুষের সঙ্গে তারা ক্রিসমাস উদযাপন করবেন বলে আশা করেছিলেন, তাদের সঙ্গে দেখা করাই হবে সব চাইতে বড় বিষয়। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে উদযাপন, জন্মদিন এবং অন্যান্য যে সমস্ত অনুষ্ঠানের অংশ তারা হতে পারবেন বলে ভেবেছিলেন, সেই সমস্ত হারিয়ে যাওয়া মুহূর্ত এখন হয়ত কিছুটা হলেও অনুভব করতে পারবেন তারা।"
বুচ উইলমোর ও সুনিতা উইলিয়ামসের সফরের এই গল্পটি শুরু হয়েছিল ২০২৪ সালের জুন মাসে।
'বোয়িং'-এর তৈরি স্টারলাইনার স্পেসক্রাফ্টের প্রথম মনুষ্যবাহী টেস্ট ফ্লাইট বা পরীক্ষামূলক উড়ানে অংশ নিয়েছিলেন তারা।
কিন্তু তারা যে ক্যাপসুলে করে মহাকাশ যাত্রা করেছিলেন, সেটি একাধিক প্রযুক্তিগত সমস্যার সম্মুখীন হয়। ওই পরিস্থিতিতে এই দুই মহাকাশচারীদের ঘরে ফিরিয়ে আনা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে বলে মনে করা হয়েছিল।
এরপর স্টারলাইনার গত বছর সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকে নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসে।
স্টারলাইনারের পৃথিবীতে ফিরে আসার অর্থ ছিল, মহাকাশে থেকে যাওয়া দুই নভোচারীকে ফিরিয়ে আনার জন্য আরও একটি নতুন যানের প্রয়োজন।
সেই কথা মাথায় রেখে নাসা পরবর্তী নির্ধারিত ফ্লাইট হিসেবে বেছে নিয়েছিল একটি স্পেসএক্স ক্যাপসুলকে। গত বছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে পৌঁছায় স্পেসএক্স ক্যাপসুল।
চারজন নভোচারীর পরিবর্তে দু'জনকে নিয়ে উড়ে গিয়েছিল এই ক্যাপসুল। দু'টি আসন ফাঁকা রাখা হয়েছিল যাতে আরও দু'জন মহাকাশচারী অর্থাৎ সুনিতা উইলিয়ামস এবং বুচ উইলমোর ওই মহাকাশযানে করে পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারেন।

ছবির উৎস,NASA
এটি ছয় মাসের একটি পরিকল্পিত অভিযান ছিল। কিন্তু মহাকাশচারীদের অবস্থানের মেয়াদ বর্তমান সময় পর্যন্ত বাড়াতে হয়েছিল।
তবে মহাকাশে প্রত্যাশিত সময়ের চাইতে বেশি সময়ের জন্য নিজেদের এই অবস্থানকে মেনে নিয়েছিলেন সুনিতা ও বুচ।
তারা 'অরবিটিং ল্যাবরেটরি' বা কক্ষপথস্থিত পরীক্ষাগারে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান এবং স্পেসওয়াকও পরিচালনা করেন।
এর আগে কোনো নারী মহাকাশচারীর স্পেস স্টেশনের বাইরে সর্বোচ্চ যে সময় কাটিয়েছিলেন, সেই রেকর্ডকে ভেঙে দিয়ে নজির গড়েছেন সুনিতা ইউলিয়ামস।
বাড়ি ফেরার কথা থাকলেও মহাকাশেই ক্রিসমাস উদযাপন করতে হয় সুনিতা ও বুচকে। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মহাকাশেও উৎসবের আমেজ উপভোগ করতে দেখা গিয়েছিল তাদের। সান্তার টুপি এবং বল্গা হরিণের শিংয়ের আদলে তৈরি 'হেডব্যান্ড' পরে অন্যদের উদ্দেশে ক্রিসমাসের শুভেচ্ছা বার্তা পাঠান তারা।
এই নভোচারীরা মহাকাশে 'আটকে' রয়েছেন বলে বর্ণনা করা হলেও আসলে কিন্তু তেমনটি ছিল না।
পুরো অভিযান জুড়েই সবসময় স্পেস স্টেশনের সঙ্গে মহাকাশযান সংযুক্ত অবস্থায় ছিল যাতে যদি কোনো জরুরি অবস্থা তৈরি হয় তাহলে তাদের যেন ফিরিয়ে আনা যায়। জরুরি অবস্থার কথা মাথায় রেখে সব সময় প্রস্তুত ছিলেন মহাকাশে থেকে যাওয়া নভোচারীরাও।
এখন অবশ্য তারা পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন। শিগগিরই তাদের টেক্সাসের হিউস্টনের জনসন স্পেস সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে তাদের শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করে দেখবেন বিশেষজ্ঞরা।

ছবির উৎস,NASA
মহাকাশে দীর্ঘমেয়াদী অভিযান মানুষের শরীরের ওপর বিভিন্ন রকমের প্রভাব ফেলে। এই পরিস্থিতিতে নভোচারীদের হাড়ের ঘনত্ব কমে যায়, তাদের শরীরের পেশীগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেহে রক্ত সঞ্চালনও প্রভাবিত হয় এবং 'ফ্লুইড শিফ্ট'-এর কারণে তাদের দৃষ্টিশক্তিও প্রভাবিত হতে পারে।
তাদের শরীর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে দীর্ঘ সময়ও নিতে পারে।
তাই বুচ উইলমোর ও সুনিতা উইলিয়ামসকে একটি বিস্তৃত 'এক্সারসাইজ রেজিম' বা শরীরচর্চার অনুশীলন করতে দেওয়া হবে কারণ পৃথিবীতে ফিরে আসার পর তাদের দেহকে আরও একবার মাধ্যাকর্ষণের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। খাপ খাইয়ে নিতে হবে তাদের পুরানো জীবনযাত্রার সঙ্গেও।
যুক্তরাজ্যের নভোচারী টিম পিক জানিয়েছেন, নতুনভাবে সব কিছুর সঙ্গে তাদের আরও একবার মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগতে পারে।
মাধ্যাকর্ষণহীন অবস্থায় মহাকাশে কেমন অভিজ্ঞতা হয়, সেই বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা করেছেন তিনি।
টিম পিক বিবিসিকে বলেন, "আপনার শরীর দারুণ অনুভব করে, অনেকটা ছুটি কাটানোর মতো। (সেখানে) আপনার হার্ট একটি সহজ সময় কাটায়, আপনার পেশী এবং হাড়ও সহজ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যায়। আপনি এই বিস্ময়কর শূন্য মধ্যাকর্ষণ পরিবেশে স্পেস স্টেশনের চারপাশে ভেসে বেড়াতে থাকেন।"
"তবে আপনাকে অবশ্যই এক্সারসাইজের অনুশীলন চালিয়ে যেতে হবে। কারণ আপনি মহাকাশে ফিট থাকছেন, কিন্তু সেটি মহাকাশে থাকার জন্য নয়। যখন আপনি পৃথিবীর শাস্তিমূলক মাধ্যাকর্ষণযুক্ত পরিবেশে ফিরে আসবেন, সেটির কথা মাথায় রেখে আপনাকে সুস্থ থাকতে হবে। পৃথিবীতে ফিরে আসার প্রথম দুই বা তিন দিন সত্যিই শাস্তি বলে মনে হতে পারে।"
মহাকাশে থাকাকালীন অবস্থাতে বুচ উইলমোর ও সুনিতা উইলিয়ামস যে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন, সেখানে তারা জানিয়েছিলেন যে প্রত্যাশার চাইতে বেশি সময় সেখানে কাটানোর জন্য তারা ভালোভাবেই প্রস্তুত।
তবে এমন অনেক কিছুই ছিল যা করার জন্য উদগ্রীব ছিলেন। সেই সমস্ত কিছুর কথা ভেবেই ঘরে ফেরার দিকে তাকিয়ে ছিলেন তারা।
গত মাসে সিবিএসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সুনিতা উইলিয়ামস বলেন, "আমার পরিবার, পোষা কুকুরদের সঙ্গে দেখা করার জন্য এবং সমুদ্রে ঝাঁপ দেওয়ার অপেক্ষায় আছি আমি। পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারলে… পৃথিবীকে অনুভব করতে পারলে সত্যিই দারুণ অনুভব করব।"