
একসময় যিনি রক্তক্ষয়ী মাদকবিরোধী ও অপরাধ বিরোধী অভিযানের মধ্য দিয়ে নিজের দেশকে পরিশুদ্ধ করার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, নিজের ৮০-তম জন্মদিনের আগে সেই রদ্রিগো দুতের্তে গ্রেফতার হলেন তারই দেশের পুলিশের হাতে।
ফিলিপিন্সের সাবেক এই প্রেসিডেন্ট হংকং থেকে ম্যানিলা ফিরে বিমানবন্দরেই পুলিশের কাছে গ্রেফতার হন। হংকংয়ে বসবাসরত ফিলিপিনোদের কাছে নিজের দলের প্রার্থীর জন্য আসন্ন মধ্যবর্তী নির্বাচনের প্রচারণা চালাতে গিয়েছিলেন তিনি।
তার নামে জারি করা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা ফিলিপিন্সের সরকারের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল আগেই। তারা তাই ঐ পরোয়ানা কার্যকর করতে বেশি সময় নেয়নি।
গ্রেফতারের পর মি. দুতের্তেকে বিমানবন্দরের ভেতরেই বিমানবাহিনীর একটি ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে চার্টার্ড বিমানে করে তাকে নেয়া হয় নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সদর সপ্তরে।
কিন্তু এটা সম্ভব হলো কীভাবে? প্রচণ্ড ক্ষমতাধর ও তুমুল জনপ্রিয় এক সাবেক প্রেসিডেন্ট, যাকে 'এশিয়ার ট্রাম্প' বলা হতো, কীভাবে নিজের দেশেই এমন অপমানজনক পরিস্থিতির মধ্যে পড়লেন?
মার্কোস-দুতের্তে পরিবার ও ফিলিপিন্সের রাজনীতি
রদ্রিগো দুতের্তে ২০১৬ থেকে ২০২২ পর্যন্ত যখন ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখন মার্কোস পরিবারের সাথে একটি জোট তৈরি করেছিলেন।
স্বৈরশাসক ফার্দিনান্দ মার্কোস ১৯৬৫ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং তার শাসনামলে দুর্নীতি আর নৃশংসতার জন্য কুখ্যাত ছিলেন। ১৯৮৬ সালে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন ও পরিবারসহ যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান। তারপর থেকে তার পরিবারের সদস্যরা, বিশেষ করে তার ছেলে বংবং মার্কোস, দীর্ঘদিন ধরে ফিলিপিন্সের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করেছেন।
ফিলিপিন্সে ২০২২ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা ছিল না মি. দুতের্তের। তবে তার মেয়ে সারা দুতের্তে যথেষ্ট জনপ্রিয় ও শক্তিশালী প্রার্থী ছিলেন। সেসময় সারা ছিলেন দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর দাভাওয়ের মেয়র।
ঐ নির্বাচনে বংবং মার্কোসও শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। তার পেছনে আন্তর্জাতিক ও ঘরোয়া সমর্থনও ছিল।
সেসময় দুই পরিবার এক চুক্তি করে। চুক্তি হয় যে, দুই পরিবার মিলে নির্বাচনের জন্য লড়বে এবং বংবং হবেন ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট। আর এই নির্বাচনে সারা ভাইস প্রেসিডেন্ট হলেও ২০২৮ সালে পরবর্তী নির্বাচনে সারা প্রেসিডেন্ট হবেন আর বংবং মার্কোস তাকে সমর্থন দেবেন ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে।
দুই পরিবারের জোট সফল হয় ও ২০২২ সালে দুই প্রার্থীই বড় ব্যবধানে জয় পায়।
স্বাভাবিকভাবেই, রদ্রিগো দুতের্তে আশা করেছিলেন যে তিনি যখন ক্ষমতায় থাকবেন না, এই জোট তার বিতর্কিত প্রেসিডেন্সিকালীন সময় ও সেসময় তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো থেকে তাকে রক্ষা করবে।
মি. দুতের্তের বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুতর হুমকি ছিল তার বিরুদ্ধে চলতে থাকা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের তদন্ত। ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর মাদক-বিরোধী অভিযানে হাজার হাজার বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়েছিল তার নির্দেশে। এছাড়া ২০১১ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত তিনি যখন দাভাওয়ের মেয়র ছিলেন তখনও তার বিরুদ্ধে এ ধরনের অপরাধের অভিযোগ ছিল।
মি. দুতের্তে প্রেসিডেন্ট থাকার সময় ফিলিপিন্সকে আইসিসির আওতা থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু আইসিসির কৌসুলিদের বক্তব্য ছিল যে আইসিসি'র আওতাধীন থাকা অবস্থায় যেহেতু ফিলিপিন্সে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ উঠেছে, পরবর্তীতে আইসিসির আওতাধীন না থাকলেও সেসময়কার ঘটনার জন্য মি. দুতের্তেকে তদন্তের সম্মুখীন হতে হবে।
এর ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালে আইসিসি মি. দুতের্তের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত শুরু করে।
ভাঙন, মার্কোসের অবস্থান পরিবর্তন
আইসিসি ২০২১ সালে মি. দুতের্তের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত শুরু করার কিছুদিন পর, ২০২২ সালের জুনে, ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট হন বংবং মার্কোস।
ক্ষমতায় গিয়ে প্রেসিডেন্ট মার্কোস জানান যে আইসিসির তদন্তে ফিলিপিন্স আনুষ্ঠানিকভাবে সহায়তা করবে না।
কিন্তু তার এই সিদ্ধান্ত নাটকীয়ভাবে পরিবর্তন হয় মার্কোস-দুতের্তে জোট ভেঙে যাওয়ার পর।
জোটে ভাঙনের শুরুটা হয় বংবং মার্কোস ক্ষমতা নেয়ার কিছুদিন পর থেকেই। মন্ত্রণালয় বরাদ্দের সময় সারা দুতের্তে চেয়েছিলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। কিন্তু তার ভাগ্যে জোটে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
প্রেসিডেন্ট মার্কোসের নৈতিক অবস্থানও ছিল তার আগের প্রেসিডেন্টের চেয়ে আলাদ। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ফিলিপিন্সের সম্পর্কে উন্নয়ন করেন, বিতর্কিত সমুদ্রসীমা ইস্যু নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেন এবং আগের প্রেসিডেন্টের শাসনামলে মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ফিলিপিন্সে যে রক্তক্ষয়ী অভিযান চলেছে তা পুরোপুরি বন্ধ করেন।
মূলত, এটি ছিল ফিলিপিন্সের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্য নিয়ে দুটি ক্ষমতালোভী, অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিবারের নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব।
আর এই দ্বন্দ্ব চূড়ান্ত রূপ নেয় গত বছর সারা দুতের্তের এক ঘোষণার পর। তিনি ঘোষণা দেন যে তার কিছু হলে প্রেসিডেন্ট মার্কোসকে ছেড়ে দেয়া হবে না। এমনকি এরকম ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টকে হত্যা করার জন্য আততায়ী ভাড়া করেছেন বলেও জানান তিনি।
এরপর গত বছরের শেষ দিকে ফিলিপিন্সের কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ, যেটি মার্কোসের বিশ্বস্তদের দিয়ে পরিচালিত, ভাইস প্রেসিডেন্ট সারা দুতের্তেকে অভিশংসন করার একটি আবেদন উত্থাপন করে। এ বছরের মাঝামাঝি সময় ঐ আবেদনের প্রেক্ষিতে সেনেটে শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।
অভিশংসিত হলে সংবিধান অনুযায়ী তিনি কোনো উচ্চ সরকারি পদে আসীন থাকতে তো পারবেনই না, সেই সাতে তার প্রেসিডেন্ট হওয়ার দীর্ঘদিনের আশাও ভেস্তে যাবে। আর সেরকম হলে ফিলিপিন্সের রাজনীতিতে দুতের্তে পরিবারের প্রভাবও যে অনেকটাই সীমিত হয়ে যাবে, সেটিও স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায়।

ছবির উৎস,Reuters
মধ্যবর্তী নির্বাচনের অপেক্ষা
এ বছরের মে মাসে হতে যাওয়া মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে প্রেসিডেন্ট মার্কোস বেশ সুকৌশলে তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে দমন করার পরিকল্পনা করেছেন। কিন্তু তার এই কৌশল যে ঝুঁকিমুক্ত, তা নয়।
দুতের্তেরা ফিলিপিন্সের অনেক জায়গাতেই এখনো বেশ জনপ্রিয়। সাবেক প্রেসিডেন্টের গ্রেফতারের প্রতিবাদে বিভিন্ন জায়গায় বড় ধরনের বিক্ষোভ আয়োজন করার সক্ষমতাও রয়েছে তাদের।
সারা দুতের্তে এরই মধ্যে বিবৃতি দিয়ে অভিযোগ তুলেছেন যে তার বাবাকে 'বিদেশি শক্তি'র হাতে তুলে দিয়ে ফিলিপিন্সের সার্বভৌমত্ব ঝুঁকির মুখে ফেলেছে সরকার।
রদ্রিগো দুতের্তেকে গ্রেফতার ও তাকে নেদারল্যান্ডসে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘিরে সাংবাদিকদের কাছে প্রেসিডেন্ট মার্কোস বলেছেন যে তিনি ইন্টারপোলের প্রতি, যারা আইসিসির পরোয়ানা ফিলিপিন্সের কাছে হস্তান্তর করেছে, তার দেশের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন।
কিন্তু তিনি যে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত, আইসিসি'র পরোয়ানার ভিত্তিতে মি. দুতের্তের গ্রেফতারে সহায়তা করেছেন, এই বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। কারণ তিনি জানেন যে ফিলিপিন্সের অনেক নাগরিকই এই প্রশ্নটি তুলবেন, যে আইসিসি'র আওতার বাইরে চলে যাওয়ার পরও ফিলিপিন্সের ভেতরে কার্যক্রম চালানোর কতটা যৌক্তিক ভিত্তি তাদের আছে।
এসব বিষয় ঘিরে ফিলিপিন্সের মানুষের মধ্যে এই দুই পরিবারের কার পক্ষে কতটা জনমত রয়েছে, তার একটা ধারণা পাওয়া যাবে মে মাসে হতে যাওয়া মধ্যবর্তী নির্বাচনে।
তবে মজার বিষয় এটাই যে, যে বিষয়টি হওয়ার কথা ছিল গুরুতর আন্তর্জাতিক অপরাধের অভিযোগে একজন অভিযুক্ত অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনার পথে প্রথম পদক্ষেপ, সেটি এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে ফিলিপিন্সের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা দুই প্রভাবশালী পরিবারের রাজনৈতিক হাতিয়ার।