Image description
 

ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ ওয়াশিংটন ডিসিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ঘণ্টাব্যাপী দীর্ঘ বৈঠকের পর ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তি নিয়ে সুস্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই একটি শান্তি বা যুদ্ধবিরতি চুক্তি হতে পারে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর বৈঠকের বিস্তারিত বিবরণও তিনি তুলে ধরেন এবং এর সম্ভাব্য ফলাফল সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেন।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির খবরে বলা হয়েছে, ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে প্রেসিডেন্ট মাখোঁ পুরো ইউরোপের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন। কারণ, ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে ইউরোপের নিরাপত্তা নিয়ে তাদের উদ্বেগ অভিন্ন। গত সপ্তাহে মাখোঁ প্যারিসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন, সেই সময় রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেন ইস্যুতে সৌদি আরবে আলোচনা চালাচ্ছিল।

প্যারিসে বৈঠকে বসা ইউরোপীয় নেতারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন, যদি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া সরাসরি কোনো চুক্তিতে পৌঁছায়, তবে ইউরোপের নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগ উপেক্ষিত হতে পারে। তারা দাবি জানান, ইউক্রেন যুদ্ধের আলোচনায় ইউক্রেন ও ইউরোপের উপস্থিতি নিশ্চিত করতেই হবে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, তিন বছর ধরে চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই শেষ হবে, আর প্রেসিডেন্ট মাখোঁও তাঁর আশাবাদে একমত হয়েছেন। তিনি বলেছেন, ইউক্রেন সংকটের আলোচনায় ট্রাম্পের অংশগ্রহণ একটি ‘গেম-চেঞ্জার’। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ব্যাখ্যা করেন, ‘তিনি (ট্রাম্প) জানেন, কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ডিটারেন্ট বা প্রতিরোধ ক্ষমতাকে সম্পূর্ণভাবে কাজে লাগিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে পুনরায় আলোচনা শুরু করতে হয়।’

তবে মাখোঁ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে সতর্ক করেছেন, যেন তিনি মস্কোর সঙ্গে তাড়াহুড়ো করে কোনো চুক্তি না করেন। ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মাখোঁ বলেন, ‘২০১৪ সালে আমাদের রাশিয়ার সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি হয়েছিল। আমি এটি কাছ থেকে দেখেছি, কারণ আমি এবং একজন জার্মান প্রতিনিধি মিলে যুদ্ধবিরতির বাস্তবায়ন তদারকি করছিলাম। কিন্তু রাশিয়া প্রতিবারই চুক্তি লঙ্ঘন করেছে, আর আমরা কেউই সম্মিলিতভাবে প্রতিক্রিয়া জানাইনি। তাই মূল প্রশ্ন হলো, বিশ্বাস ও বিশ্বাসযোগ্যতা এবং এটি কীভাবে নিশ্চিত করা যায় যে, রাশিয়া আবার প্রতারণা করবে না।’

ফরাসি প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, ‘আমার মতে যুদ্ধবিরতির ধাপগুলো হওয়া উচিত এভাবে—প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে আলোচনা, তারপর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের মধ্যে আলোচনা। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আজ ঘোষণা করেছেন, তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গে স্বল্পমেয়াদি বৈঠক করতে রাজি। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’

মাখোঁ আরও বলেন, ‘আসলে, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই যুদ্ধবিরতি সম্ভব।’ তবে তিনি শর্ত দেন যে, ‘যুদ্ধবিরতি স্থলে, আকাশে এবং সমুদ্রে কার্যকর হতে হবে, সেই সঙ্গে ইউক্রেনের অবকাঠামো রক্ষার বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে এবং রাশিয়াকে এটি মেনে চলতেই হবে। যদি তারা তা না করে, তাহলে বোঝা যাবে যে মস্কো আদৌ শান্তি চায় না এবং ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করে না।’

যুদ্ধবিরতির সময় কী কী বিষয়ে আলোচনা হতে পারে সে বিষয়ে ফরাসি প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, ‘যুদ্ধবিরতির সময় আমরা আলোচনা করব—মস্কোর নিরাপত্তা গ্যারান্টি, ভূমি ও অঞ্চল পুনরুদ্ধার বা সমঝোতা নিয়ে। এটি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব হবে, যাতে কিয়েভের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে।’

তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ওয়াশিংটন বিরল খনিজ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদের বিষয়ে একটি চুক্তি নিশ্চিত করবে।’ তিনি উল্লেখ করেন, ফ্রান্স ও ইউরোপের বাকি দেশগুলো এতে সম্মত, কারণ ‘এটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, এবং এটি নিশ্চিত করবে যে, তারা ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে।’

যুদ্ধবিরতির পর কী হবে ফক্স নিউজের সঙ্গে সেই বিষয়েও কথা বলেন মাখোঁ। তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, ‘কিন্তু কীভাবে নিশ্চিত করা যাবে যে, রাশিয়া ভবিষ্যতে এই চুক্তি লঙ্ঘন করবে না?’ জবাবে তিনি বলেন, ‘ন্যাটোর বিষয়ে কোনো ঐকমত্য নেই, কিংবা ইউক্রেনকে এখনই নাটোর সদস্য করা সম্ভব নয়। কিন্তু যদি আমরা ইউক্রেনকে একা রেখে দেই, যেমন আমরা অতীতে করেছি, তাহলে আবারও রাশিয়ার আক্রমণের ঝুঁকি থেকে যাবে।’

মাখোঁ বলেন, ‘তাই যুদ্ধবিরতির পর আমাদের দেখতে হবে, নিরাপত্তা নিশ্চিতে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। একটি উপায় হতে পারে ইউক্রেনের সামরিক শক্তি বাড়ানো, যাতে তারা নিজেদের রক্ষা করতে পারে। আরেকটি বিকল্প হতে পারে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য যৌথভাবে একটি প্রস্তাব তৈরি করবে, যেখানে দুই দেশ ইউক্রেনে সেনা পাঠাবে—তবে সম্মুখসমরে নয়, বরং একটি নির্দিষ্ট চুক্তির আওতায় সম্মত স্থানে অবস্থান করবে। তাদের মূল লক্ষ্য হবে শুধু রাশিয়ার প্রতিশ্রুতির প্রতি নজর রাখা, যাতে রাশিয়া চুক্তি ভঙ্গ না করে। অবশ্যই, এটি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে হবে।’

এদিকে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অভিযোগ করেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধে ইউরোপের ‘যথাযথ ভূমিকা নেই’। এই প্রসঙ্গে মাখোঁ বলেন, ‘আমরা (ইউরোপ) ন্যায্যভাবে আমাদের দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত, কারণ এটি আমাদের অঞ্চলেই ঘটছে। আমি ইতিমধ্যে প্রায় ৩০ জন ইউরোপীয় নেতার সঙ্গে কথা বলেছি এবং তাদের অনেকেই এ ধরনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অংশ হতে আগ্রহী।’

তিনি বলেন, ‘তবে ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে একটি স্পষ্ট গ্যারান্টি ও সংহতি চায় এই বিষয়ে যে, যদি রাশিয়া চুক্তি লঙ্ঘন করে এবং ইউক্রেন বা ইউরোপ আক্রান্ত হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের পাশে থাকবে।’

সাক্ষাৎকারে মাখোঁ গতকাল মঙ্গলবার বলেন, ‘আজ (মঙ্গলবার) সকালে আমি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করেছি, এবং তিনি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের পাশে থাকবে। যদি আমরা এই গ্যারান্টি ও সংহতি পাই, তাহলে আমি মনে করি, আমরা একটি চুক্তির পথে আছি।’

উল্লেখ্য, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন যুদ্ধ তিন বছর পূর্ণ হয়। এই যুদ্ধে ইউক্রেনের কয়েক হাজার নাগরিক নিহত হয়েছে এবং ৬০ লাখের বেশি মানুষ শরণার্থী হিসেবে বিদেশে বসবাস করছে। সামরিক ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপক হলেও সেগুলো গোপন রাখা হয়েছে। রাশিয়ার আক্রমণের পর ইউক্রেনের অর্থনীতি পুনর্গঠনের আনুমানিক ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৫২৪ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৪ সালে ইউক্রেনের জিডিপির প্রায় প্রায় তিন গুণ।

বিষয়