Image description

কিছুদিন শান্ত থাকার পর ফের বাংলাদেশকে অস্থির করে তোলার চেষ্টা করছেন ছাত্র-নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভারতে লুকিয়ে থেকে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ৫ ফেব্রুয়ারি হাসিনা যে বক্তৃতা দিয়েছেন; সেটি তার নৃশংস কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতনে অবদান রাখা ছাত্রজনতাকে ফের ক্ষেপিয়ে তোলার প্রচেষ্টা হিসেবেই দেখা হচ্ছে। ওই দিন বক্তৃতায় হাসিনা তার কথিত অভিযোগের কথা তুলে ধরে বলেছেন, ‘অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখল করেছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার।’ তিনি তার সমর্থকদের অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘প্রতিহত’ করার আহ্বান জানিয়ে তাদের আবেগকে উস্কে দিতে চেয়েছেন।

বিক্ষোভকারীরা হাসিনার পিতা, স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির বাড়িটি ধ্বংস করে একটি বার্তা দেয়ার চেষ্টা করেছে। তাদের দাবি ধানমন্ডির ওই বাড়িটিকে ঘিরে হাসিনা তার শাসনামলে নিজেকে একজন কাল্ট হিসেবে গড়ে তুলেছেন।

 

যদিও সোশ্যাল মিডিয়া সাইট এক্স-এ আপলোড করা নিউজ ক্লিপগুলোতে  হাসিনার উস্কানিমূলক বক্তৃতার কোনো ফুটেজ ব্যবহার করা হয়নি। পরিবর্তে শেখ মুজিবের ভবনে বিক্ষোভকারীদের আগুন দেয়ার এবং দেয়ালে হাতুড়ি মারার দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। সম্ভবত হাসিনা এবং তার সমর্থকরা ছাত্রদের উস্কে দিতে চেয়েছিলেন। এ বিষয়টি স্পষ্ট যে, হাসিনার আওয়ামী লীগ দেশে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার প্রমাণ হিসেবে ঘটনাগুলোর ভিন্ন রূপ তুলে ধরেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছাত্রজনতার ক্ষোভের  জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেও ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।

যেমনটা আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় উল্লেখ করেছি, হাসিনা যেভাবে দেশের মাটিতে ঘৃণাকে উস্কে দিতে চেয়েছেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে এটা স্পষ্ট যে, হাসিনার লক্ষ্য- তার প্রতি ‘অকৃতজ্ঞ’ বাংলাদেশকে জ্বলতে দেখা। গত সপ্তাহের উত্তেজনা নির্বাচনের সময়সূচীর সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে। হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির ৬ মাসের মাথায় যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে দেশ এবং দেশের বাইরের অসংখ্য সুযোগ সন্ধানীরা ক্ষমতায় পুনর্বাসিত হওয়ার আশা করছেন। এতে ক্ষমতার ভারসাম্য তাদের দিকে ঝুঁকতে পারে বলে ধারণা করছেন তারা।


ফের দিল্লির সঙ্গে উত্তেজনা

হাসিনার ৫ ফেব্রুয়ারির ভাষণ এবং তার পরের ঘটনা ঢাকাকে ভারত সম্পর্কে আরও বেশি সন্দিগ্ধ করে তুলেছে। কারণ ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ভারতের আশ্রয়ে থেকেই সেদিন  তার বক্তৃতা দিয়েছেন। এই ঘটনাগুলো এমন সময়ে ঘটেছিল যখন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র  উপদেষ্টা একটি ভারতীয় সংবাদপত্রে বক্তব্য রেখেছিলেন।  ঢাকা এই অসহযোগী আচরণের জন্য নয়াদিল্লির কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছে, তবে অন্যান্য মিত্র রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন সংগ্রহ করে তার কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা এড়ানো উচিত। মিডিয়া রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, দুই প্রতিবেশী দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওমানের মাস্কাটে ১৬-১৭ ফেব্রুয়ারি একটি সম্মেলনের ফাঁকে মিলিত হতে পারেন।

 

দ্রুত নির্বাচনের আহ্বান 
কিছু ভাষ্যকার গত সপ্তাহের ঘটনার আলোকে অন্তর্বর্তী সরকারের দ্রুত অবসানের পূর্বাভাস দিতে শুরু করেছেন। তারা অনুমান করছেন, এ সুযোগটাই কাজে লাগাতে চাচ্ছে ভারত। চলতি সপ্তাহে ওয়াশিংটন সফরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে এ বিষয়ের ওপর জোর দেবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেখানে তিনি বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতীয় নীতির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করবেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। 

ভারত, আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মতো দেশের অন্যান্য প্রধান দল, সকলেই দ্রুত নির্বাচনের আহ্বান জানিয়ে আসছে, যদিও তাদের দাবির উদ্দেশ্য ভিন্ন। 
এদিকে নির্বাচনের আগে সংস্কার দেখতে বেশি আগ্রহী ছাত্ররা এবং কিছু উদীয়মান রাজনৈতিক দল। কিন্তু নোবেলজয়ী ড. ইউনূস ধারাবাহিকভাবে ১২ বা ১৮ মাস পরে নির্বাচনের পক্ষে কথা বলছেন, যাতে কিছু মৌলিক সংস্কার করা যায়।  

আওয়ামী লীগ ও তার সমর্থকরা মনে করতে পারে ভিকটিম কার্ড খেলে তারা এই রাউন্ডে জয়ী হয়েছে। কিন্তু ৫ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় উদ্ভূত আবেগগুলো তার বিরোধীদের ভবিষ্যতের নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনার দিকে ঠেলে দেয়ার পথকে আরও বেশি প্রশস্ত করেছে বলে মনে হয়। 

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একজন উপদেষ্টা (ব্যাপকভাবে ধারণা করা হচ্ছে যে তিনি ছাত্রদের রাজনৈতিক দল গঠনের সঙ্গে জড়িত) দাবি করেছেন যে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার জন্য অন্যান্য সকল দলের মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে।

হাসিনা বা তার দল শিগগিরই ক্ষমতায় ফিরবে বলে কেউ বিশ্বাস করে না। কারণ তিনি এবং তার দলের অন্য সদস্যদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও দুর্নীতির অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে।

আওয়ামী লীগ যেটা চায় তা হলো ছাত্রদের রাজনীতি থেকে দূরে রাখা এবং সংস্কার বাধাগ্রস্ত করা। এজন্য, হাসিনার দল তার দীর্ঘদিনের শত্রু, বিএনপির সাথে নিজের স্বার্থ  নিয়ে দেনদরবার করার চেষ্টা করবে বলে মনে হচ্ছে। বিএনপি পরবর্তী নির্বাচনে জয়ী হবে বলে ব্যাপকভাবে প্রত্যাশিত। আওয়ামী লীগ সম্ভবত আশা করছে যে, বিএনপি অতীতের অনুশীলনে ফিরে আসবে এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে বহিষ্কৃত দলটির(আওয়ামী লীগ) প্রত্যাবর্তনের মঞ্চ তৈরি করবে।

এতো কিছুর পরেও ড. ইউনূস এবং তার ছাত্র সমর্থকদের প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য যথেষ্ট শক্তি ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে। যেহেতু তারা বিশাল  ম্যান্ডেট নিয়ে সরকার চালানোর দায়িত্বে এসেছে। এই টালমাটাল পরিস্থিতি  বাংলাদেশের সকল গণতন্ত্রপন্থী শক্তির কাছে একটি অনুস্মারক হিসেবে কাজ করবে যে বাইরের হুমকি মোকাবেলায়  জাতীয় ঐক্য সময়ের দাবি রাখে।


লেখক : জন ড্যানিলোভিজ হলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সিনিয়র ফরেন সার্ভিস অফিসার যার দক্ষিণ এশিয়া সম্পর্কে  ব্যাপক অভিজ্ঞতা রয়েছে। তার কূটনৈতিক কর্মজীবনে তিনি ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসে ডেপুটি চিফ অব মিশন  হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

সূত্র :  বেনার নিউজ