Image description

বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় বহুদিন ধরে অবহেলিত ছিল প্রবাসী জনগোষ্ঠী। এবার প্রথমবারের মতো দেশের জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন কোটি প্রবাসী – বিশেষ করে যারা শ্রমিক হিসেবে কাজ করে দেশের অর্থনীতিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন।

নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, গালফ অঞ্চল, ইউরোপ, আমেরিকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় দেড় কোটি বাংলাদেশি প্রবাসী রয়েছেন। এই সংখ্যা দেশের মোট ভোটারের ১০ শতাংশেরও বেশি।

এই বিশাল জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশন ‘পোস্টাল ভোট বিডি’ নামে একটি অ্যাপের মাধ্যমে ডাকযোগে ভোটের ব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছে। এটি ২০২৪ সালে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের পতনের পর গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উদ্যোগে নেওয়া বড় ধরণের সংস্কারের অংশ – যেখানে নির্বাচনী, বিচারিক ও আইন প্রণয়ন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার চেষ্টা চলছে।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশি ভোটারদের জন্য কার্যকর ভোট ব্যবস্থার বাস্তবায়ন সহজ হবে না। স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ১১টি জাতীয় নির্বাচনের মধ্যে মাত্র চারটিকে ‘সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ’ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

নির্বাচনী সংস্কার কমিশনের প্রধান বাদিউল আলম মজুমদার আল জাজিরাকে বলেন, ‘এই প্রক্রিয়া অনেকটা কালো বাক্সের মতো। স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত না হলে পুরো নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়তে পারে।’ তিনি বলেন, ‘এটি অত্যন্ত জটিল একটি কাজ, এতে বড় ধরনের লজিস্টিক প্রস্তুতির দরকার। এক নির্বাচনেই সব দেশে বাস্তবায়ন সম্ভব না। তবে কোথাও না কোথাও থেকে শুরু করতেই হবে।’

কেন এতদিন প্রবাসীরা ভোট দিতে পারেনি?

বাংলাদেশের সংবিধান সরাসরি প্রবাসীদের ভোটাধিকার অস্বীকার করে না। ১২২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, ভোটার হতে হলে বাংলাদেশি নাগরিক হতে হবে এবং ভোটার তালিকায় নিবন্ধিত হতে হবে। তবে ১৯৮২ সালের একটি অধ্যাদেশে বলা হয়েছিল, ভোটার হতে হলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় ‘স্বাভাবিকভাবে বসবাসকারী’ হতে হবে।

এই অধ্যাদেশ পরে বাতিল করে ২০০৯ সালে কার্যকর হওয়া ‘নির্বাচনী রোল আইন’ চালু হয়। এতে বলা হয়, বিদেশে অবস্থানরত নাগরিকরা তাদের পূর্ববর্তী বাসস্থান অথবা পারিবারিক ঠিকানার এলাকার ভোটার হিসেবে গণ্য হবে।

তবে বাস্তবে তাদের ভোটাধিকার থাকলেও তা প্রয়োগের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ভোট দেওয়ার উপায় না থাকায় প্রবাসীরা অংশ নিতে পারেনি।

মজুমদার বলেন, ‘পূর্ববর্তী নির্বাচনে প্রবাসীদের নিয়ে নাটক হয়েছে – প্রকৃতপক্ষে তাদের অন্তর্ভুক্তির কোনো সদিচ্ছা ছিল না।’

হাসিনার পতনের পর গঠিত সংস্কার কমিশন বিভিন্ন বিকল্প বিবেচনা করে ডাকভোট এবং একটি মোবাইল অ্যাপের সমন্বিত ব্যবস্থার সিদ্ধান্ত নেয়।

কীভাবে কাজ করবে এই ডাকভোট ব্যবস্থা?

‘পোস্টাল ভোট বিডি’ অ্যাপটি নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই চালু হওয়ার কথা। প্রবাসীরা এই অ্যাপে জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর দিয়ে নিবন্ধন করবেন, যেটি নির্বাচন কমিশনের সার্ভারের সাথে সংযুক্ত থাকবে।

নিবন্ধন শেষে, ভোটারদের ঠিকানায় ডাকযোগে একটি খামে ব্যালট পেপার এবং একটি ফেরত খাম পাঠানো হবে। এই খামের ওপরে একটি কিউআর কোড থাকবে, যা স্ক্যান করলে অ্যাপে নিশ্চিত হবে যে ভোটার ব্যালট পেয়েছেন।

ভোটার ব্যালটে মার্ক করে খামে সিল করে যেকোনো ডাকঘর থেকে পাঠাতে পারবেন। ফেরত খামের ওপর থাকা বারকোডের মাধ্যমে ভোটাররা তাদের ব্যালট কোথায় আছে তা ট্র্যাক করতে পারবেন। ভোটপত্র সরাসরি সংশ্লিষ্ট এলাকার রিটার্নিং অফিসারের কাছে যাবে। এ প্রক্রিয়ায় দূতাবাস বা কূটনৈতিক মিশনের কোনো ভূমিকা থাকবে না।

আকতার আহমেদ, নির্বাচন কমিশনের জ্যেষ্ঠ সচিব, বলেন, ‘খাম খোলার অধিকার কেবল রিটার্নিং অফিসারের। কেউ যদি মাঝপথে খাম খোলে, সেটা সহজেই ধরা পড়ে যাবে।’

২০২৪ সালের আন্দোলনে প্রবাসীদের ভূমিকা কী ছিল?

২০২৪ সালের জুলাইয়ে যখন শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন শুরু করেন, তখন বিশ্বের নানা প্রান্তে অবস্থানরত বাংলাদেশি শ্রমিকরা রেমিট্যান্স বয়কটের ডাক দেন।

প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। হাসিনার পদত্যাগের পরের অর্থবছরে প্রবাসীরা রেকর্ড ৩০ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন।

তারা শুধু অর্থনৈতিক কর্মসূচিতেই নয়, রাজপথেও নেমেছিল। গালফ অঞ্চলে বিক্ষোভে অংশ নিতে গিয়ে অনেক শ্রমিককে গ্রেপ্তার হতে হয়েছে। শুধু সংযুক্ত আরব আমিরাতেই শতাধিক শ্রমিককে আটক করা হয়েছিল, যাদের অনেককেই পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হস্তক্ষেপে মুক্তি দেওয়া হয়।

এরপর থেকেই প্রবাসীদের ন্যায্য অধিকার এবং ভোটাধিকার নিয়ে সরকারিভাবে নীতিনির্ধারণী আলোচনা শুরু হয়।

মজুমদার বলেন, ‘প্রবাসী শ্রমিকরা আমাদের রেমিট্যান্স যোদ্ধা। তারা একজন স্বৈরাচারকে সরাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, তাই তাদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করাই উচিত।’

প্রবাসীদের ভোটে পাল্টে যাবে নির্বাচনের হিসাব?

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ বলেন, ‘প্রবাসীরা দেশের মোট ভোটারের ১০ শতাংশের বেশি। কিছু আসনে এই হার ২০ শতাংশ ছুঁই ছুঁই। আমাদের ব্যবস্থায় যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠতাই যথেষ্ট, তাই এই ভোট ফলাফল উল্টে দিতে পারে।’

তিনি বলেন, এই ভোটাররা শুধু সংখ্যায় নয়, প্রভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। তারা রাজনৈতিকভাবে সচেতন, আর্থিকভাবে স্থিতিশীল এবং নিজেদের এলাকার সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত। তারা পরিবার ও এলাকার ভোটারদেরও প্রভাবিত করতে পারেন।

তাই তাদের ভোট শুধু ব্যালটে নয়, নির্বাচনের সামগ্রিক আবহেই বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন তিনি।

এই নতুন ভোটারগোষ্ঠী রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যও এক নতুন চ্যালেঞ্জ। মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া এবং ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে থাকা কোটি ভোটারকে কাছে টানতে হবে।

ভুল তথ্য ও গুজব সামাজিক মাধ্যমে বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে। তবে সাইফুল্লাহর মতে, প্রবাসীরা সচেতন এবং অনলাইনেই বেশি সক্রিয়, তাই তারা ভুল তথ্য প্রতিরোধে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারবেন।

তার ভাষায়, ‘তারা কেবল গুজবের শিকার নয় – তারাই আমাদের সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধ।’

প্রবাসীরা কী চান – রাজনৈতিক দলগুলো কী বলছে?

গালফ অঞ্চলে থাকা প্রবাসী শ্রমিক তাহসিন শাকিল বলেন, প্রবাসীদের প্রতি যে অবহেলা তারা দীর্ঘদিন ধরে সহ্য করছে, বিশেষ করে বিমানবন্দর ও দূতাবাসগুলোতে, তা বন্ধ হওয়া উচিত।

তিনি জানান, বিমানবন্দরে প্রবাসীদের ঘন্টার পর ঘন্টা জেরা করা হয়, লাগেজ নিয়ে হয় ইচ্ছামতো জব্দ, এবং দূতাবাসের কর্মকর্তারা প্রায়ই অসহযোগিতা করেন – যেমন পাসপোর্ট নবায়ন বা কাজের কাগজের ক্ষেত্রে।

‘দেশের অর্থনীতি আমাদের ওপর দাঁড়িয়ে, অথচ আমাদের তৃতীয় শ্রেণির নাগরিকের মতো ব্যবহার করা হয়,’ বলেন শাকিল।

জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)

 সাইফুল্লাহ বলেন, প্রবাসীদের কেবল রেমিট্যান্স প্রেরণকারী হিসেবে নয়, রাষ্ট্র পুনর্গঠনে অংশীদার হিসেবে দেখার সময় এসেছে।

তাদের ইশতেহারে বলা হয়েছে, প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা, বিমানবন্দর ও দূতাবাসে হয়রানি বন্ধ, বিপদে পড়লে তাৎক্ষণিক সহায়তা, ডিজিটাল সেবা, ফেরত আসা প্রবাসীদের জন্য পুনর্বাসন এবং প্রবাসীদের সরাসরি নীতিনির্ধারণে অংশগ্রহণের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)

বিএনপি চেয়ারপারসনের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির বিশেষ সহকারী ড. সাইমুম পারভেজ বলেন, প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য বিদেশে জীবনযাত্রার মান উন্নয়নকে তারা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবে।

তার ভাষায়, ‘বিএনপির দৃষ্টিভঙ্গি হলো—বিশ্বের প্রতিটি বাংলাদেশ দূতাবাস প্রবাসীদের কল্যাণে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে। যাতে তারা আর হয়রানির শিকার না হয়। একইসাথে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য জোরদারের দিকেও আমরা কাজ করবো।’

তিনি বলেন, বিএনপি ইতিমধ্যেই বিশ্বজুড়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। ‘বিএনপির পৃথিবীব্যাপী ডায়াসপোরা কমিটি রয়েছে। এই গড়ে ওঠা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রবাসী ভোটারদের কাছে পৌঁছানো কঠিন হবে না।’

তিনি আরও বলেন, বিএনপি এখন নীতিনির্ভর রাজনীতির ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে, যার লক্ষ্য সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়ন। ‘আমরা ইতোমধ্যে কৃষি, কর্মসংস্থান এবং শিক্ষা নিয়ে নীতি ঘোষণা করেছি। সামনে আমরা দেখাবো, এই নীতিগুলো কীভাবে সাধারণ মানুষের জীবন বদলে দেবে। এই কারণেই আমি বিশ্বাস করি, প্রবাসীরা বিএনপিকেই সমর্থন করবেন।’

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী

 সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও জামায়াতের প্রার্থী শিশির মানির বলেন, ‘জামায়াত প্রথম দল যারা প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিয়ে কথা বলেছে।’

তিনি সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছিলেন, যাতে নির্বাচন কমিশন কার্যকর ব্যবস্থা নেয় – আদালত তা গ্রহণও করে।

তিনি জানান, ইউকে ও গালফে প্রবাসীরা জামায়াতে ভোট দিতে আগ্রহী। তিনি একধরনের ‘ওয়ান-স্টপ সার্ভিস’ চালু করার প্রতিশ্রুতি দেন – বিশেষ করে জমি সংক্রান্ত জটিলতা বা মামলা পরিচালনায় সহায়তা করার জন্য।

এছাড়া ঢাকার বিমানবন্দরে লাগেজ জটিলতা ও দুর্ব্যবহার দূর করতেও প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।