
প্রতিবছর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের লাখো মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে, প্রাণ হারায় অনেকে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য এ ভাইরাস এখনো এক বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ ডেঙ্গুর কার্যকর ও নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তবে এবার ডেঙ্গু মোকাবিলায় নতুন আশার আলো জ্বেলেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) একদল গবেষক। তাদের গবেষণা ডেঙ্গু ভাইরাস প্রতিরোধে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে।
গবেষণায় সিডিকে১ (CDK1), বিরসি৫ (BIRC5), টিমস (TYMS), কেআইএফ২০এ (KIF20A), সিসিএনবি২ (CCNB2), সিডিসি ২০ (CDC20), অরকেবি (AURKB), টিকেও১ (TK1) এবং পিটিইএন (PTEN)—এ নয়টি জিনকে ‘হোস্ট কী-জিন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি জিন সরাসরি ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমণ বাড়াতে ভূমিকা রাখে বলে গবেষকরা উল্লেখ করেছেন। এই জিনগুলো ভাইরাসকে কোষ বিভাজন প্রক্রিয়া দখল করতে এবং ইন্টারফেরন সংকেত দমন করতে সাহায্য করে, ফলে সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
গবেষণায় আরও পাওয়া গেছে, ফক্সসি১ (FOXC1), রেলা (RELA), গাটা২ (GATA2), টিপি৫৩ (TP53) এবং পিপিএআরজি (PPARG) নামের ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টরগুলো ডেঙ্গু-সম্পর্কিত জিনগুলোর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া মাইক্রো-আরএনএ মি-আর-১০৩এ-৩পি (miR-103a-3p) ভাইরাসের প্রতিলিপি প্রক্রিয়াকে বাড়িয়ে দেয়।
সবশেষে, মলিকুলার ডকিং বিশ্লেষণের মাধ্যমে এ গবেষণায় তিনটি সম্ভাব্য ওষুধ—এনট্রেকটিনিব (Entrectinib), ইমাটিনিব (Imatinib) এবং কিউএল৪৭ (QL47)—শনাক্ত করা হয়েছে, যেগুলো ভবিষ্যতে ডেঙ্গুর চিকিৎসায় কার্যকর হতে পারে বলে মনে করছেন গবেষকরা। এ ওষুধগুলো ভাইরাসকে সরাসরি নয়, বরং মানবদেহের ভেতরে ভাইরাসের ‘সহযোগী’ জিনগুলোকে টার্গেট করবে—যা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এক ভিন্ন কৌশল।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী গবেষক মো. আব্দুল লতিফ। আব্দুল লতিফ গবেষণার পাশাপাশি নিজের প্রতিষ্ঠিত অনলাইন গবেষণা শিক্ষা প্ল্যাটফরম ‘স্টেটএক্স’-এর প্রধান নির্বাহী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। তার গবেষণায় সহযোগিতায় ছিলেন একই বিভাগের মো. আল নোমান ও মো. ফয়সাল আহমেদ। গবেষণায় তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে ছিলেন পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ড. নুরুল হক মোল্লা। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে শুরু করে এ গবেষণা ২০২৫ সালের ৭ অক্টোবর আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক জার্নাল প্লোজ ওয়ান (PLoS ONE)-এ একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রকাশ করেছেন তারা। ইন-সিলিকো (কম্পিউটার-ভিত্তিক) বিশ্লেষণের মাধ্যমে তারা মানবদেহের নয়টি জিন শনাক্ত করেছেন, যেগুলো ডেঙ্গুর সংক্রমণ, কোষচক্রের ব্যাঘাত ও রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার দুর্বলতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
গবেষক মো. আব্দুল লতিফ বলেন, আমাদের এ গবেষণা ডেঙ্গু সংক্রমণের পেছনের জিনগত প্রক্রিয়া উন্মোচন করেছে এবং হোস্ট-নির্ভর চিকিৎসা উদ্ভাবনের নতুন দ্বার খুলে দিয়েছে। ভবিষ্যতে এ তথ্যগুলো ব্যবহার করে কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি তৈরি সম্ভব।
তিনি আরও জানান, আমাদের গবেষণায় আমরা ডেঙ্গু সংক্রমণের পেছনের জিনগত কার্যপ্রক্রিয়া উন্মোচন করেছি। এটি স্পষ্ট করেছে কীভাবে ভাইরাস মানবদেহের কোষের জিন নিয়ন্ত্রণ করে নিজের প্রতিলিপি তৈরি করে এবং সংক্রমণ বাড়ায়। এ আবিষ্কার ভবিষ্যতে হোস্ট-নির্ভর ওষুধ ও চিকিৎসা উদ্ভাবনের এক নতুন পথ দেখাবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। এছাড়া চিহ্নিত তিনটি সম্ভাব্য ওষুধ ডেঙ্গু ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ ও এর চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে বলে আশা গবেষকদের।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে গবেষণাটির তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক ড. নুরুল হক মোল্লা জানান, ডেঙ্গু নিয়ে এখন পর্যন্ত এমন কোনো গবেষণা হয়নি, যার মাধ্যমে ওষুধের সংখ্যা কমিয়ে রোগীর আরও উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করা যায়। আমরা এমন কিছু জিন শনাক্ত করেছি, যেগুলো ডেঙ্গু ভাইরাসের জন্য দায়ী। মানুষের শরীরে লক্ষাধিক জিন থাকে—এর মধ্যে কোন কোন জিনে ভাইরাস আক্রমণ করে, তা আমরা আইডেন্টিফাই করতে পেরেছি।
তিনি আরও বলেন, তবে এখনো কিছু কাজ বাকি আছে। এই জিনগুলোর ওয়েট ল্যাব এক্সপেরিমেন্ট সম্পন্ন করতে পারলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। একইভাবে ওষুধের ক্ষেত্রেও আমরা কম্পিউটারের মাধ্যমে সম্ভাব্য ওষুধগুলো শর্টলিস্ট করেছি, যাতে সেগুলোর মধ্যে সেরা প্রার্থী নির্ধারণ করা যায়।
রাবির এ গবেষক মনে করেন, এসব এক্সপেরিমেন্টের জন্য বিশাল বাজেট প্রয়োজন। আমাদের প্রাথমিক কাজটি ছিল জিন ও ওষুধের সম্ভাব্য সম্পর্ক নির্ধারণ করা, যা আমরা সম্পন্ন করেছি। এখন ওয়েট ল্যাব-এ কাজ করা গবেষকদের সঙ্গে সমন্বয় করে আমাদের শর্টলিস্ট করা ওষুধগুলোর চূড়ান্ত প্রার্থী খুব দ্রুতই নির্ধারণ করা সম্ভব হবে।