
সাধারণত কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন বিভাগ প্রতিষ্ঠা কিংবা ভবন বা স্থাপনা নির্মিত হলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই সেগুলোর দায়-দায়িত্ব নেয়। কিন্তু একজন শিক্ষক নিজেই উদ্যোগী হয়ে যুগের চাহিদায় বিভাগ প্রতিষ্ঠা, বিভাগের স্বার্থ নিয়েই ধ্যান-ধারণা করা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে সারাজীবনের উপার্জন বিসর্জন দেওয়ার মতো মানুষের সংখ্যা বিরল। এমনই একজন শিক্ষক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগে। তিনি বিভাগটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও খ্যাতনামা মৎসবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শফি। ২০২২ সালে এ প্রথিতযশা অধ্যাপকের প্রয়াণ হলেও তার কাজ ও অবদানের জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন।
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শফি বিভাগটির নিজস্ব ভবন নির্মাণ ও একাধিক ট্রাস্ট ফান্ড প্রতিষ্ঠাসহ নানা কাজে সারাজীবনের উপার্জন থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভাগে প্রায় ১ কোটি টাকা দান করেছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবসর গ্রহণের পরও বিভাগের স্বার্থে দেড় দশকেরও বেশি সময় শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিয়েছেন এবং গবেষণায় সহায়তা করেছেন। শুধু তাই নয়, সততা, সময়ানুবর্তিতা ও সহজ-সরল জীবনযাপনের জন্যও তিনি অনন্য এক উদাহরণ ও স্মরণীয় হয়ে আছেন। তার শিক্ষকতার জীবনের শুরু থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত কখনো ক্লাসে দেরিতে যাননি বলে জানিয়েছেন তার ছাত্ররা। তাছাড়াও মৎস্যবিজ্ঞানের ওপরে তার লিখিত বিভিন্ন গবেষণা প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও বই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পড়ানো হয়।
‘উনার পেনশনের টাকা বিভাগে দান করেছেন। বিভাগে উনার অর্থায়নে স্কলারশিপও চালু রয়েছে। অবসর গ্রহণের পরও উনি বিভাগে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিতেন এবং খুব অ্যাক্টিভ লাইভ লিড করতেন। উনার সবসময় শিক্ষা ও গবেষণাকেন্দ্রিক চিন্তা-ভাবনা ছিল। পাঠদানের বিষয়ে শফি স্যারের কোনো কার্পণ্য ছিল না’ -চেয়ারম্যান, মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
জানা যায়, খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং অর্থনীতিতে মৎস্যখাতের গুরুত্ব বিবেচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন অধ্যাপক মোহাম্মদ শফি। এর আগে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সুপারিশে ১৯৯৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মৎস্য শাখাকে স্বতন্ত্র বিভাগ হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব পেশ করা হয়, যা পরে ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট কর্তৃক অনুমোদিত হয়। তখন প্রাণিবিদ্যা বিভাগের মৎস্য শাখার অন্যতম বিশিষ্ট শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক শফি।
যদিও শুরুতে এর নাম ছিল অ্যাকুয়াকালচার অ্যান্ড ফিশারিজ বিভাগ। ২০২৩ সালের ২৯ মার্চ সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তে পরিবর্তন করে রাখা হয় ফিশারিজ বা মৎস্যবিজ্ঞান। ১৯৯৭-১৯৯৮ শিক্ষাবর্ষে অর্থাৎ ১৯৯৮ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদের অধীনে বিভাগটির একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে এ বিভাগে দুই শতাধিক স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এমফিল ও পিএইচডি শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত আছেন এবং ২৩ জন শিক্ষক কর্মরত আছেন।
বিভাগটি চার বছর মেয়াদি ‘ব্যাচেলর অব সায়েন্স (অনার্স) ইন ফিশারিজ’ ডিগ্রি এবং এক বছর মেয়াদি তিনটি বিষয়ে ‘স্নাতকোত্তর বা মাস্টার অব সায়েন্স (এমএস)’ ডিগ্রি প্রদান করে। এ বিভাগে রয়েছে সাতটি গবেষণাগার, একটি আধুনিক কম্পিউটার ল্যাব, অডিটোরিয়াম, ইনডোর ও আউটডোর অ্যাকুয়াকালচার এবং মৎস্য গবেষণার সুবিধা এবং দুই হাজারেরও বেশি বই সমৃদ্ধ একটি সেমিনার লাইব্রেরি।
‘আমি বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলাম। তখন বিভাগের উনি ছাড়া আর কোনো শিক্ষক ছিলেন না। তখন দেখতাম, উনি নিজহাতে উনার অফিস পরিস্কার করতেন এবং অন্যান্য কাজ করতেন’ -শিক্ষক, মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বিভাগের দুটি প্রধান ভবনের একটি হলো পাঁচ তলা প্রফেসর মোহাম্মদ শফি ফিশারিজ বিল্ডিং, যেখানে বিভাগীয় প্রধান কার্যালয় ও স্নাতক প্রোগ্রাম পরিচালিত হয়। অন্যদিকে, কার্জন হল ভবনের পূর্বাংশে পরিচালিত হয় স্নাতকোত্তরের তিন প্রোগ্রাম (এমএস ইন অ্যাকুয়াকালচার, ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিক্স ও ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট)। তবে প্রতিষ্ঠার প্রথম দেড় দশকেও বিভাগটির এত বিস্তৃতি ছিল না। প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘদিন যাবৎ শিক্ষার্থীদেরকে ক্লাস করতে হতো শ্রেণি সংকট মোকাবেলা করে। বিভিন্ন সময়ে তাদেরকে ক্লাস করতে হয়েছে প্রাণিবিদ্যা আর অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের শ্রেণিকক্ষে।
এর দরুণ শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনায় নিজস্ব ভবন করতে ২০০০ সালে মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগকে ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সেই অর্থে পাঁচ তলার ভিত্তিসহ একতলা পর্যন্ত নির্মাণ করা সম্ভব হয়। অর্থাভাবে প্রায় ১৫ বছর আটকে ছিল ভবন সম্প্রসারণের কাজ। ২০১৪ সালে নিজের সঞ্চিত অর্থ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে দুই দফায় প্রায় ৭০ লাখ টাকা দেন অধ্যাপক শফি। এতে থমকে থাকা সেই কাজ আবার শুরু হয়। পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও সেখানে অর্থায়ন করে।
এরপর নির্মাণ কাজ শেষের দিকে আবারও কিছু অর্থ প্রদান করেন অধ্যাপক শফি। তিনি তার জীবনের সঞ্চয় উৎসর্গ করায় বর্তমান পাঁচ তলা ভবনটির নামকরণ করা হয়েছে ‘প্রফেসর মোহাম্মদ শফি ফিশারিজ বিল্ডিং’।
‘শফি স্যার বলতেন, শিক্ষিত যারা তাদেরকে অবশ্যই ভাল মানুষ হওয়া জরুরি। কারণ, একজন খেটে খাওয়া মানুষের মাধ্যমে বড় কোনো অনিয়মের সম্ভাবনা বেশি না থাকলেও কোনো মেধাবী ব্যক্তি অসৎ হলে বা ভাল মানুষ না হলে তার মাধ্যমে দেশের ক্ষতি বেশি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি’ - অধ্যাপক মোহাম্মদ শফির সাবেক ছাত্র।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০০৫ সালে অবসরে গেলেও শরীরের প্রাণশক্তি থাকা পর্যন্ত তিনি শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিয়েছেন। শিক্ষকতার জীবনে তিনি কখনো কোনো রাজনৈতিক দলে যুক্ত হননি। নিজ হাতে গড়া ও সাজানো বিভাগ ও শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং গবেষণায় কেটেছে তার সময়। নিজ বিভাগের ভবন নির্মাণের জন্য এত টাকা দেওয়ার বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে কেউ কেউ এ প্রশ্ন তোলার চেষ্টা করেন যে, ‘একজন শিক্ষক হয়ে এত টাকা অধ্যাপক শফি কোথায় পেলেন?’
বিভাগ সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, তিনি আগে থেকেই পারিবারিকভাবে স্বচ্ছল ছিলেন। যার কারণে ঢাবিতে শিক্ষকতার বেতনের ওপর নির্ভর করতে হয়নি। তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি দেশে-বিদেশে বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ইরাকের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষকতা ও গবেষণা করেছেন। সেখানে তিনি সম্মানজনক বেতন পেতেন বলে জানা গেছে।
বিভাগের শুধু ভবন নির্মাণে অর্থ প্রদানের মতো কাজই নয়, তিনি আরও অনেক কল্যাণমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০১০ সালে বিভাগের স্নাতক শিক্ষার্থীদের জন্য তিন লাখ টাকায় গঠন করেন ‘আমেনা-লতিফ ট্রাস্ট ফান্ড’। সেখান থেকে প্রতি বছর তিনজন মেধাবী শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দেওয়া হয়। পরের বছর নিজের নামে গঠন করেন ‘ড. মোহাম্মদ শফি ট্রাস্ট ফান্ড’, সেখান থেকেও স্নাতকোত্তরের দুজন কৃতী শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দেওয়া হয়।
তাছাড়া, অধ্যাপক শফি তার বাড়ি বগুড়ার সান্তাহারে বিপি হাইস্কুলে ২০০১ সালে বাবার নামে চালু করেন ‘আবদুল লতিফ ছাত্রবৃত্তি কল্যাণ ফান্ড’। এ স্কুল থেকেই তিনি ১৯৫৫ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেছিলেন। মায়ের নামে পাশের কলসা আহসানউল্লাহ ইনস্টিটিউশনে চালু করেন ‘আমেনা খাতুন ছাত্রীবৃত্তি কল্যাণ ফান্ড’।
বেঁচে থাকতে অধ্যাপক শফি গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, মানুষের জীবন দুই ধরনের। এক. আদর্শ জীবন। দুই. সুখী জীবন। সুখী জীবনে কেবল বর্তমানকে নিয়েই বেঁচে থাকা। আর আদর্শ জীবনে অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতের অস্তিত্ব। ভবিষ্যতের জন্য ভবনটি নির্মিত হচ্ছে। এতেই আমার সমস্ত সুখ।
তার অবদানের ব্যাপারে অনুভূতি প্রকাশ করে মহিউদ্দিন মোহাম্মদ নামে এক লেখক বলেন, একজন শিক্ষক, যিনি সমাজের অন্যান্য শ্রেণী-পেশার মানুষ থেকে আয়-উপার্জনে অনেক পিছিয়ে আছেন, তিনি কি না তার বেতন ও পেনশনের সমুদয় টাকা ভালোবাসার বিশ্ববিদ্যালয়টিকে দান করে ফেললেন— এমন খবর এই অন্ধকারে জোনাকি পোকা ছাড়া কী হতে পারে? ১০০ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অজস্র কোটিপতি তৈরি করেছে। অসংখ্য প্রভাবশালী রাজনীতিক, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবী, মন্ত্রী, সাংসদ, প্রবাসী, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। তারা যদি অন্তত সামান্য হাত নিয়ে এই অধ্যাপক মোহাম্মদ শফির মতো এগিয়ে আসতেন, তাহলে আমাদের ছেলেমেয়েরা কয়েক বছরেই একটি অসাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় পেতো।
তিনি বলেন, শুধু যে টাকা দিতে হবে, এমন নয়। নানাভাবে সাবেক ছাত্ররা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারেন। সরকারের সাথে দেন-দরবার করাটাও একটি বড় ভূমিকা হতে পারে। এ ভবন শত শত বছর ধরে বয়ে বেড়াবে শফি স্যারের নাম।
মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৬-১৭ সেশনের শিক্ষার্থী রোকেয়া মুনা দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমি যখন প্রথম বর্ষে ছিলাম তখন অধ্যাপক শফি স্যার আমাদের ক্লাস নিতেন। তখন উনার শরীরের অবস্থা ভাল ছিল না, প্রোপারলি হাঁটতে-চলতে পারতেন না। তারপরও তিনি সময়মতো ক্লাসে এসে সর্বোচ্চটা দিয়ে আমাদেরকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে পড়াতেন।
তিনি একটি ঘটনার স্মৃতিচারণ করে আরও বলেন, ‘একদিন আমি দেখলাম উনি বইপত্র হাতে সিঁড়ি বেঁয়ে অনেক কষ্টে উপরের দিকে উঠছেন ক্লাস করানোর জন্য। বিষয়টি আমার দেখে অনেকটা খারাপ লাগল। তখন আমি স্যারকে বললাম, ‘স্যার, কিছু মনে না করলে আপনার হাতের বইগুলো আমি নিয়ে দিতাম’। জবাবে স্যার বললেন, ‘তোমাকে ধন্যবাদ। কিছু মনে করিও না, আমি নিজের কাজ নিজে করতেই পছন্দ করি। সহজে কারো সহযোগিতা নিই না‘।
অধ্যাপক মোহাম্মদ শফির সরাসরি ছাত্র ছিলেন মৎসবিজ্ঞান বিভাগের বর্তমান সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. হাসান ফারুক। তিনি অধ্যাপক শফির সঙ্গে বই লেখা ও গবেষণার কাজ করেছেন। তিনি স্মৃতিচারণ করে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘স্যারকে আমি শিক্ষক হিসেবেও পেয়েছি এবং কলিগ হিসেবেও পেয়েছি। ক্লাসরুম থেকে উনার মধ্যে অনুকরণীয় যে বিষয়টি আমি দেখেছি, সেটা হল সময়ানুবর্তিতা। উনি কখনো ক্লাসের নির্ধারিত সময়ের এক মিনিট পরেও আসতেন না, জাস্ট টাইমে আসতেন। আবার সময় শেষ হওয়ার সাথে সাথে ক্লাস থেকে চলে যেতেন। এক্ষেত্রে উনার যুক্তি ও নীতি ছিল- ১০ মিনিট দেরিতে আসলে এবং ক্লাসের সময় শেষ হওয়ার পরও পড়াতে থাকলে শিক্ষার্থী ও পরের ক্লাসের শিক্ষক উভয়েই বিরক্ত ও ক্ষতিগ্রস্থ হয়।’
তিনি বলেন, ‘কলিগ হিসেবে দেখেছি, ব্যবহারিক পরীক্ষার সময় ক্লাস টিচার হিসেবে যেকোনো একটি পরীক্ষার ডিউটিতে উনার থাকতে হতো। ওই পরীক্ষার ডিউটি শেষে আমরা যখন বলতাম, স্যার আপনি চলে যেতে পারেন। তখন তিনি বলতেন, ‘আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় যে ২০০০-২৫০০ টাকা সম্মানী দেয়, সেটা সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকেল ৩টার জন্য। তার আগে যাওয়া তো আমার জন্য ঠিক হবে না, তিনি সময় শেষ হওয়ার আগে যেতেন না। শিক্ষক হিসেবে আমাদের এই নৈতিকতাটা আসলে থাকা উচিৎ।’
অধ্যাপক শফির উদারতার কথা স্মরণ করিয়ে হাসান ফারুক বলেন, ‘বার্ধক্যজনিত ও শারীরিক অসুস্থতার কারণে উনি এক পর্যায়ে সপ্তাহে একদিন ক্লাসে আসতেন। তখন তিনি তৎকালীন চেয়ারম্যানকে এবং শিক্ষক ফোরামে জানিয়েছিলেন যে, তার অফিস কক্ষটা যেন রুম না থাকা কোনো এক জুনিয়র শিক্ষককে বরাদ্দ দিয়ে দেওয়া হয়। তিনি বলেছিলেন, আমি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে সম্মান করে আমার জন্য রুম রাখার দরকার নেই। আমরা সচারচর দেখি, অনেক শিক্ষকের মধ্যে সহজে রুম ছাড়তে না চাওয়ার একটি প্রবণতা আছে বা দীর্ঘদিন তালাবদ্ধ থাকে অনেক রুম। কিন্তু শফি স্যার এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন।’
তিনি আরও বলেন, স্যারের সঙ্গে একটা বই লেখার কাজ করার সুযোগ হয়েছে। তখন তিনি সবসময় আমাকে বলতেন, ভাল শিক্ষক হওয়ার পাশাপাশি ভাল মানুষ হওয়াটা অনেকবেশি জরুরি। তিনি বলতেন, শিক্ষিত যারা তাদেরকে অবশ্যই ভাল মানুষ হওয়া জরুরি। কারণ, একজন খেটে খাওয়া মানুষের মাধ্যমে বড় কোনো অনিয়মের সম্ভাবনা বেশি না থাকলেও কোনো মেধাবী ব্যক্তি অসৎ হলে বা ভাল মানুষ না হলে তার মাধ্যমে দেশের ক্ষতি বেশি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
অধ্যাপক শফির আর্থিক অবদানের কথা জানিয়ে ড. হাসান ফারুক বলেন, অধ্যাপক শফি স্যার অনার্স ও মাস্টার্সে শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদানে জন্য বিভাগে দুটি ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছেন। যেটা থেকে প্রতিবছর প্রতি ব্যাচের নির্দিষ্টসংখ্যক মেধাবী শিক্ষার্থীকে সম্মানজনক পরিমাণে অর্থ প্রদান করা হয়। এছাড়া তিনি বিভাগের ৫ তলা ভবন নির্মাণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে ৭০ লাখ টাকা দিয়েছিলেন, এ সময় চার তলা পর্যন্ত সম্পন্ন হয়। পরে ওপরের তলার কাজের সময় আর্থিক সংকট দেখা গেলে তিনি আরও কিছু টাকা ডোনেট করেন এবং ৫ তলার কাজ শেষ হয়। হিসেব করলে দেখা যাবে, বিভাগে তিনি সরাসরি ১ কোটির বেশি টাকা দিয়েছেন।’
মৎসবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন বিভাগটির বর্তমান অধ্যাপক ড. মো. মনিরুল ইসলাম। তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘অধ্যাপক শফি স্যারের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। প্রথমত, দায়িত্ববোধ ও সময়ের কাজ সময়ে করা। দ্বিতীয়ত, মহৎ হওয়া এবং ইগো কম হওয়া। উনি শিক্ষার্থীবান্ধব একজন শিক্ষক ছিলেন। এখনকার শিক্ষকদের মধ্যে যেমন বিভিন্ন ধরনের স্থলন দেখা যায়, উনার মধ্যে সেটা কখনো ছিল না। আমি বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলাম। তখন বিভাগের উনি ছাড়া আর কোনো শিক্ষক ছিলেন না। তখন দেখতাম, উনি নিজ হাতে উনার অফিস পরিস্কার করতেন এবং অন্যান্য কাজ করতেন। তার কয়েক মাস পরেই অবশ্য অন্য শিক্ষক ও কর্মকর্তার নিয়োগ হয়। তার আগ পর্যন্ত তিনি ওয়ান ম্যান ছিলেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘শুরুর দিকে ক্লাসরুম সংকটের কারণে বিভাগের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমান অধ্যাপক শফি ভবনের এক তলা পর্যন্ত নির্মাণ করে দিয়েছিল। যা প্রয়োজন অনুযায়ী যথেষ্ট ছিল না। তখন স্যার বড় অংকের একটা ডোনেশন করলেন (দুই দফায়) এবং বিশ্ববিদ্যালয়ও কন্ট্রিবিউট করে পাঁচ তলা ভবন নির্মাণ সম্পন্ন করল। স্যারের টাকাটা না হলে আদৌ ভবনটা এত তাড়াতাড়ি হত বলে মনে হয় না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ মামুন চৌধুরী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘অধ্যাপক শফি স্যার বিভাগের জন্য যা করেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে কোনো শিক্ষক এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বলে আমার জানা নেই। স্যার অনেক সৎ ছিলেন এবং সততাই উনার বড় একটি শক্তি ছিল। কেউ কেউ উনার আর্থিক উৎস নিয়ে প্রশ্ন তুলেন, যা সমীচীন নয়। কারণ, স্যার দীর্ঘ ৪ বছর ইরাকে শিক্ষকতা ও গবেষণা করেছেন, তখন বেশ ভালো পরিমাণে উপার্জন হয়েছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘উনার পেনশনের টাকা বিভাগে দান করেছেন। বিভাগে উনার অর্থায়নে স্কলারশিপও চালু রয়েছে। অবসর গ্রহণের পরও উনি বিভাগে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিতেন এবং খুব অ্যাক্টিভ লাইভ লিড করতেন। উনার সব সময় শিক্ষা ও গবেষণাকেন্দ্রিক চিন্তা-ভাবনা ছিল। পাঠদানের বিষয়ে শফি স্যারের কোনো কার্পণ্য ছিল না।’
অধ্যাপক মোহাম্মদ শফি ১৯৬৯ সালে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। দেশে ফিরে ১৯৭২ সালে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরের বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন তিনি। চার বছরের অবৈতনিক ছুটি নিয়ে ১৯৭৮ সালে ইরাকের বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে মাছের ওপর গবেষণা ও শিক্ষকতা করেন। দেশে ফিরে আবার বিভাগে যোগ দেন। করোনা-পরবর্তী শারীরিক জটিলতায় দুই মাস আইসিইউতে চিকিৎসাধীন থাকার পর ২০২২ সালের ২৪ এপ্রিল রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর।
বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিক মৎস্যশিক্ষা ও গবেষণার সূচনা হয় ১৯৬৭ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে মৎস্য অনুষদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। পরে ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সামুদ্রিক বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট চালু করে এবং ১৯৯১ সালে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় মৎস্য ও সামুদ্রিক বিজ্ঞান শাখা প্রতিষ্ঠা করে।
এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ মৎস্যবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রদান করত, যা প্রাণিবিদ্যার একটি শাখা হিসেবে পরিচালিত হয়। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে এ বিভাগের শিক্ষকরা বুঝতে পারেন যে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মৎস্যবিজ্ঞানে স্নাতক পর্যায়ের একটি পূর্ণাঙ্গ ডিগ্রি প্রবর্তন অত্যন্ত জরুরি ও সময়োপযোগী। ফলে, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের মৎস্য শাখার শিক্ষকবৃন্দ একটি নতুন বিভাগ স্থাপনের উদ্যোগ নেন, যা অধ্যাপক শফির হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়।