
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণ আজ। ভোটের আগের দিন নিজ বাসায় নির্বাচনের নানা দিক নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল মামুন।
৩৩ বছর আগে সর্বশেষ ১৯৯২ সালে জাকসু নির্বাচন হয়েছিল। এবারের নির্বাচনটি ঐতিহাসিক। এ নির্বাচন আয়োজন করতে গিয়ে কী ধরনের অভিজ্ঞতা হলো?
কামরুল আহসান: দীর্ঘ সময় গণতন্ত্রের অনুপস্থিতির কারণে আমরা সর্বস্তরে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের একটা তাগিদ অনুভব করি। আমাদের সৌভাগ্য যে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের যে চেষ্টা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হচ্ছে, জাকসু তার মধ্যে অন্যতম। সে কারণে জাকসুর আলোচনা যখনই আসছে, দীর্ঘ সময় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামের অংশ হিসেবে আমি এটা বড় প্রাপ্তি মনে করেছি। বিষয়টা যে খুব সহজ ছিল, তা নয়। শিক্ষার্থীরা গণ-অভ্যুত্থানে কিন্তু দলমত–নির্বিশেষে সবাই প্রাণ দিয়েছে। তাদের এই যে ত্যাগ, তার বিনিময়ে আমরা দেখেছি যে দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে এবং দেশের রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, যাঁরা জুলুমের শিকার হয়েছেন, তাঁরা মুক্তি পেয়েছেন। শিক্ষার্থীদের অগ্রভাগে থাকা এই আন্দোলনটি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের তীর্থ সময়ের আন্দোলনকে পরিণতি দিয়েছে। সে জন্য আমার মনে হয়েছে যে শিক্ষার্থীদের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এ নির্বাচনটা করা যায়।
এর আগে যাঁরা উপাচার্য হয়েছেন, অনেকেই জাকসু নির্বাচনের আশ্বাস দিয়েছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত নির্বাচন দেননি। আপনার পক্ষে এত বড় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন কীভাবে সম্ভব হলো?
কামরুল আহসান: গণ–অভ্যুত্থানের পর যখন দায়িত্ব পেয়েছি, আমরা দেখেছি যে অনেকগুলো জায়গায় সংস্কার প্রয়োজন। শিক্ষার্থীরা জুলাই আন্দোলনে যে অবদান রেখেছে, তাদের এই ঋণ শোধ করার অনেক বড় একটা দায়িত্ব আমার ঘাড়ে। জাকসু হচ্ছে শিক্ষার্থীদের এমন একটি সংসদ, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ল মেকিং যে বডি, সিনেটে পাঁচজন সদস্য যায়। জাকসুর প্রতিনিধি যখন সিনেটে থাকবে, তখন শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি সেখানে সরাসরি থাকছে। তখন শুধু বাইরে নয়, আইন প্রণয়নকারী যে সংস্থা, যে বডিটা আছে, সেখানে তারা নিজেরা সদস্য হিসেবে ভূমিকা রাখার সুযোগ পাবে। শুধু প্রস্তাব নয়, সেখানে অংশগ্রহণ ও সিদ্ধান্ত তৈরি করার জায়গা থাকবে। এটা আমাকে আসলে খুবই প্রভাবিত করেছে যে শিক্ষার্থীদের ঋণ শোধ করার অনেকগুলো উপায়ের মধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অন্য জায়গাগুলো দেখার পাশাপাশি তাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সার্বিক সুবিধাগুলো দেখার জন্য তারা যে চেষ্টাটা করে, সেটার জন্য জাকসু হচ্ছে একটা উপযুক্ত ফোরাম।
উদ্যোগটি আপনার নাকি শিক্ষার্থীদের চাওয়ার কারণে; নাকি সরকারের পক্ষ থেকে জাকসু নির্বাচন আয়োজন করতে বলা হয়েছে?
কামরুল আহসান: মূলত প্রথমত এটি শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল। দ্বিতীয়ত, আমার যে অঙ্গীকার, সেটার সঙ্গে এ দাবির সম্পর্ক ছিল। তৃতীয়ত, যখন এ বিষয়ে আমরা সরকারের সঙ্গে কথা বলেছি, তখন তারা এ সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেছে।
জাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আপনি তিনবার তফসিল পিছিয়ে ছিলেন। অনেকে বলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে পিছিয়ে ছিলেন?
কামরুল আহসান: আমরা নানা পর্যায়ে নানা মানুষের সঙ্গে কথা বলি। কিন্তু জাকসুর বিষয়টা হচ্ছে সম্পূর্ণভাবে, একেবারে পরিপূর্ণভাবে জাহাঙ্গীরনগরের বাস্তবতাকে মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কোনো জায়গা থেকে প্রভাবিত হওয়ার প্রশ্নই আসে না। তবে এই জাকসু নির্বাচনের যে অর্জন, এটা পরিপূর্ণভাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশীজনদের এবং তাদের এই চাওয়া, আমাদের চেষ্টা এবং আমার সহকর্মীদের সহযোগিতা এগুলোই আসলে মূল নির্ণায়ক ছিল জাকসুর ক্ষেত্রে।
নির্বাচনে কোনো আশঙ্কা দেখছেন কি? আপনার চোখে আশঙ্কা কী কী?
কামরুল আহসান: নির্বাচন নিয়ে কোনো আশঙ্কা দেখছি না। নির্বাচন নিয়ে মতবিনিময় হয়েছে। আচরণবিধি লঙ্ঘন করার বিষয়গুলো যখন শিক্ষার্থীদের চোখে পড়েছে, তখন তারা কমিশনের নজরে আনছে। তাঁরা চেষ্টা করছেন দেখভাল করার। কিন্তু এত অল্প সময়ে এত কাজ করা প্রত্যাশা অনুযায়ী অনেক সময় হয় না। আশঙ্কার ক্ষেত্রে আমি যেটা বলি, প্রতিটি সংগঠন অংশগ্রহণ করার কারণে এবং একটা আনন্দমুখর পরিবেশে আসলে নির্বাচনটা হচ্ছে।
আপনি বলেছিলেন, জাকসু নির্বাচন হলে ক্যাম্পাসে লাশ পড়বে। সেসব নিয়ে শিক্ষার্থীদের লেখালেখিও আমরা দেখেছি। এখনো সেই আশঙ্কা আছে কি?
কামরুল আহসান: নিজেরা যদি আমরা নির্বাচন করার ক্ষেত্রে অগুরুত্ব ইস্যু নিয়ে জঞ্জাল ও ঝগড়ায় লিপ্ত হই, আমরা যদি সবাই মিলে সহযোগিতা না করি, তাহলে তৃতীয় শক্তি পরিস্থিতিকে ভিন্ন দিকে নিয়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে আমাদের প্রাণনাশের ঝুঁকিও থাকতে পারে। বিষয়টি সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে বলা। কিন্তু শুধু একটি অংশ দিয়ে এটির প্রচারে মনে হচ্ছে বিকৃত হয়েছে।
আমরা যতটুকু জেনেছি, ভোট গণনা হবে স্বয়ংক্রিয় মেশিনে। প্রার্থীদের অনেকে অভিযোগ করছেন মেশিনে ভোট গণনায় ম্যানিপুলেটের (কারচুপি) সুযোগ থাকবে।
কামরুল আহসান: মেশিন কখনোই নিজেকে নিজে ম্যানিপুলেট করে না। যাঁরা মেশিন পরিচালনা করেন, তাঁরা সে জন্যই দায়িত্বে থাকেন। এ ব্যাপারে অতন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, আমি ব্যক্তিগতভাবে এটা নজরদারি করতে চাই। কোনো অবস্থায় কোনো জায়গায় যদি এ ধরনের কোনো কিছু দেখা যায়, তাহলে সর্বোচ্চ শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে এবং কোনো অবস্থাতেই এটা করার সুযোগ নেই।
আপনি জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের আহ্বায়ক ছিলেন। অনেকে বলছেন, নির্বাচনে আপনি নির্দিষ্ট কোনো দলের পক্ষে সমর্থন দিচ্ছেন। কতটুকু সত্য?
কামরুল আহসান: দেখুন, প্রত্যেক মানুষেরই একটা রাজনৈতিক পরিচয় থাকে। যখন আমি উপাচার্য হই, তখন আমি সুনির্দিষ্টভাবে শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে এ কথাগুলো বলেছিলাম যে আমার একটি সংশ্লিষ্টতা আছে। শিক্ষার্থীরা তাদের পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আমাকে এই সীমাবদ্ধতা বা এই পরিচয়টা মাথায় রেখেই আসলে চেয়েছিল যে আমি দায়িত্বটি নিই। বিষয়টি আমি নিজেও ভেবেছিলাম যে এ বিষয়টি আমার কর্মের ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব বিস্তার করবে কি না। তবে উপাচার্য হিসেবে আমার দায়িত্ব হচ্ছে সবার অভিভাবক হওয়া।
সব ভোটার কি ভোট দিতে আসতে পারবেন? অনেককে আবার কোনো ট্যাগ দিয়ে মারধরের ঘটনা ঘটবে না তো?
কামরুল আহসান: নির্বাচন হচ্ছে আসলে প্রতিনিধি পাঠানোর নির্দিষ্ট একটা ফোরাম। আমরা কেন নির্বাচনের জন্য যাচ্ছি; মানুষের মতামত নেওয়ার জন্য। কেউ যদি এ ধরনের মানুষের মতামত তৈরিতে বাধা তৈরি করে, নিশ্চয়ই তাহলে গণতান্ত্রিক মানসিকতা থাকে না আর কোনোভাবেই সেটা কাম্য নয়। প্রশাসন এ বিষয়ে সর্বাধিক সজাগ থাকবে, এ ধরনের অধিকার হরণের কোনো ঘটনা ঘটলে অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।
জাকসু নির্বাচন কি প্রতিবছর হবে?
কামরুল আহসান: আমি পরের দিন বাঁচব কি না, জানি না। যদি আমি থাকি, আমি বিশ্বাস করি যে একটি প্রক্রিয়া শুরু করলেই হয় না, সেটিকে চলমান রাখলে অভ্যাসে পরিণত হয়। যদি আমার থাকা হয়, নিশ্চয়ই আমার থাকার সঙ্গে আমার যে প্রত্যাশা তা সহগামী হবে এবং জাকসু আমার প্রত্যাশার একটি জায়গা।