
ভাই গেছে, সেই কষ্ট এখনো বুকে? এর ভেতর তারা কিভাবে আমার থ্রেট দেয় নিহতের পরিবারের অন্যান্য শিক্ষার্থীদের ক্লাস করার জন্য। ক্লাসে না গেলে ৫০০ টাকা করে জরিমানা করারও হুমকি দিচ্ছে। আমাদের ভাইটা নাই, এর মধ্যে তারা আমাদের হ্যারেজমেন্ট করতেছে কেন। মাইলস্টোন কি টাকা ছাড়া কিছু বোঝে না?’— সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের কাছে কথাগুলো বলছিলেন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহত মাহিদ হাসান আরিয়ানের বড় বোন।
গত ৩ আগস্ট নিহতদের স্মরণে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে অনুষ্ঠিত হয় মিলাদ ও দোয়া মাহফিল। এর পর ৪ আগস্ট স্কুলটিতে ছুটে যান বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের স্বজনরা। আর সেখানেই নানান অভিযোগ জানান তারা।
আরিয়ানের বড় বোন আরও বলেন, ‘আমার বোন আফরিন এই কলেজের ইন্টারমেডিয়েটে পড়ে। আরেকটি ছোট ভাই আবির সেও পড়ে। আমার বোন আফরিনকে ফোন দিয়ে স্কুলে আসতে বলে, না এলে ৫০০ টাকা জরিমানা করবে বলে জানায়। কিন্তু আমার বোন কলেজের গেট দিয়ে আর ঢুকতে পারে নাই। কারণ, কান্না করতে করতে সে অসুস্থ হয়ে গেছে।’
গত ২১ জুলাই দুপুরে কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করা যুদ্ধবিমানটি যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মাইলস্টোন স্কুলের ভবনে বিধ্বস্ত হয়। দুর্ঘটনায় বিমানচালক, স্কুলের ভেতরে থাকা বহু শিশু শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক হতাহত হন। এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৩৪ জন, যাদের অধিকাংশই শিশু। বিমান দুর্ঘটনার পরই প্রশ্ন ওঠে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ নির্মাণে অনুমতি এবং বিধ্বস্ত ভবনটির বৈধতা নিয়েও।
দুর্ঘটনার পর বাচ্চারা এখনও ক্লাস করার জন্য প্রস্তুত না জানিয়ে নিহত ফাতেমার মামা লিওন মীর সারাবাংলার এই প্রতিবেদকে বলেন, ‘অনেকের ২টা সন্তানের একটা মারা গেছে। সেসব শিক্ষার্থীদের অভিভাবককে স্কুল থেকে ফোন দিয়ে ক্লাস করার জন্য আরেক বাচ্চাকে পাঠাতে বলতেছে। এমনকি, স্কুলে না পাঠালে প্রতিদিনের জন্য ৫০০ টাকা জরিমানা করার কথাও বলছে স্কুল থেকে। দুর্ঘটনার পর বাচ্চারা এখনো ক্লাস করার জন্য প্রস্তুত না। যাদের একটা বাচ্চা মারা গেছে তারা তাদের আরেকটি বাচ্চাকে সেই স্কুলে পাঠাতে এখনো প্রস্তুত না। যে বাচ্চা তার ভাই বা বোনকে হারিয়েছে সে ক্লাস করতে এখনো প্রস্তুত না।’
নিহত শিক্ষার্থী আফিয়ার মা সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্কুল আমাদের ভেতরে ঢুকতে দিতে চায় না। স্কুল কী লুকাচ্ছে? এতগুলো বাচ্চা মারা গেল, আহত হইল; এই বিষয়ে তো স্কুল কোনো পদক্ষেপ নিল না। স্কুলের নুরুন নবী স্যার ও তার মেয়ে- তারা কেউই কোনো কথা বলতেছে না। আমরা কোথায় যাব? আমার বাচ্চা মারা গেছে, আমাকে সে কিছু বলবে না? আমি তো বিচার চাই। স্কুল কোনো বিচার করে নাই, কিছু বলেনি। এমনকি বাচ্চাদের কাছে যেসব ডকুমেন্ট ছিল সেগুলো তারা নিয়ে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘মিলাদের জন্য স্কুলের কাছে অভিভাবকদের ফোন নম্বর চাওয়া হয়েছিল, তারা সেটিও দেয়নি। স্কুল নাকি কোচিং করায় না, আমার মেয়েকে ফোন দিয়ে কেন কোচিংয়ে নেওয়া হলো। আমার বাচ্চাকে আজ পর্যন্ত কোনো কোচিংয়ে দিই নাই। তারা জোর করে কোচিং করায়। তাদের কি টাকায় হয় না, কত টাকা লাগে মাইলস্টোনের? ক্লাসে বাচ্চাদের ঠিক মত পড়ালে কেন কোচিং লাগবে?’
নিহত সায়মার বাবা সারাবাংলাকে বলেন, ‘কথা বলার মতো মনমানসিকতা বা শক্তি কোনোটাই নেই। এতগুলো বাচ্চা মারা গেল, কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বিবৃতি, শান্ত্বনা বা আমাদের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। স্কুলের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো বিবৃতি নাই। বাচ্চাকে স্কুলে পাঠানো কি অন্যায় হয়ে গেছে?’
প্রতিষ্ঠানটির গাড়ি থাকার পরও রিকশায় করে দুর্ঘটনাকবলিত বাচ্চাদের হাসপাপতালে নেওয়ার অভিযোগ তুলে নিহতদের কয়েকজন মা বলেন, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে অনেক গাড়ি ভেতরেই থাকে। কিন্তু দুর্ঘটনার পর আমাদের অনেক বাচ্চাকে রিকশায় করে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। কত কষ্ট করে রিকশায় শোয়াইয়া হাসপাতালে নিয়েছে। একটা গাড়ি দেওয়া হয়নি সেসময়। তারা খালি গাড়িগুলো বের করে দিয়েছে। তারা কি পারতো না এই গাড়িতে করে বাচ্চাদের হাসপাতালে নিতে? তাদের কি কোনো দায়িত্ব ছিল না? আমরা তো বাচ্চা তাদের হাতে তুলে দিয়েছিলাম।
এ বিষয়ে মাইলস্টোন কলেজের ডিরেক্টর কাজী বিলকিস আরা আইরিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘তাদের এ ধরনের অভিযোগ বা তথ্য একটাও সঠিক হওয়ার কোনো সুযোগ নাই। এই তথ্য তিনশত ভাগ মিথ্যা। আমাদের খোঁজ নিতে বলা হচ্ছে, যেন আমরা তাদের সঙ্গে কানেক্টেড থাকি। এত শিক্ষার্থীদের মধ্যে হয়তো মাত্র কয়েকজনের ভাই বা বোন হতাহত হয়েছেন। এখন আমরা যখন ক্লাস শুরু করব তখন তো আমাদের জানতে হবে কার ভাই-বোন হতাহত হয়েছে। এত শিক্ষার্থীদের মাঝে তো আমাদের জানা সহজ না কার ভাই-বোন দুর্ঘটনা কবলিত হয়েছে। যারা আঘাতপ্রাপ্ত তাদের এখন ভালো থাকার কথা না। কিন্তু আমরা তাদের সঙ্গে কানেক্টেড আছি।’
স্কুল থেকে এই ঘটনায় কোনো বিচার চাওয়ার কথা বলা হচ্ছে না- অভিভাবকদের এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি একটি জাতীয় ইস্যু। এখানে এয়ার ফোর্স জড়িত, সরাসরি প্রধান উপদেষ্টা জড়িত এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জড়িত। অনেকগুলো কমিটি করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির কাজ চলছে। বিচারের কাজগুলো তাদের পর্যায় থেকে দেখা হচ্ছে। যে সিদ্ধান্ত উপর থেকে আসে, সেগুলো আমি কাজে লাগানোর চেষ্টা করছি।’
সারাবাংলা