Image description

দেশের উচ্চশিক্ষার ৭০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। তার অধীনে দুই হাজার ২৫৭টি কলেজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করেন প্রায় সাড়ে ৩৪ লাখ শিক্ষার্থী। এসব শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার মান নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। বিশেষ করে বিগত আওয়ামী সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে এই শিক্ষা খাতটি বেশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

শর্ত পূরণ ছাড়াই দলীয় বিবেচনায় একের পর কলেজের অধিভুক্তি, মানহীন শিক্ষক নিয়োগ, ভর্তি পরীক্ষা বাতিল, ঠিকমতো ক্লাস না হওয়া, মন্ত্রণালয়-অধিদপ্তর ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, তুলনামূলক কম বাজেট বরাদ্দসহ নানা কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ অবস্থায় বড় এই উচ্চশিক্ষা খাতের মানোন্নয়নের বিষয়টি বেশ চ্যালেঞ্জের বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্যের নেতৃত্বে নতুন নতুন পরিকল্পনা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার মান নিশ্চিতের চেষ্টা চলছে। এরই অংশ হিসেবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় আকস্মিক কলেজ পরিদর্শন, বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ, শর্ত পূরণ না করা মানহীন কলেজের অধিভুক্তি বাতিলসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। তবে এ খাতে শিক্ষার মান বাড়াতে বড় ধরনের সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ জরুরি বলে মনে করছেন শিক্ষা-সংশ্লিষ্টরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোর শিক্ষার মান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএসএম আমানুল্লাহ নিজেই। শিক্ষকদের এক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, কলেজগুলোর শিক্ষার মানোন্নয়ন করতে না পারলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নত করা সম্ভব নয়। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মানোন্নয়নের পূর্বশর্তই হচ্ছে কলেজ শিক্ষার মানোন্নয়ন। কলেজগুলোর ব্যাপক সংস্কার ছাড়া উচ্চশিক্ষা সংস্কারে আশানুরূপ কোনো ফলাফল আসবে না।

শিক্ষার মানোন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে জানিয়ে উপাচার্য এএসএম আমানুল্লাহ আমার দেশকে বলেন, শিক্ষার্থীরা কী কারণে ক্লাসে অনুপস্থিত থাকে, তা আমরা চিহ্নিত করছি। বিভিন্ন উপায়ে ছেলেমেয়েদের কীভাবে ক্লাসে আনা যায়, কীভাবে ইনসেনটিভ দেওয়া যায়, সে বিষয়ে আমরা উদ্যোগ নিচ্ছি। আগামীতে ক্লাসে অংশগ্রহণ বাড়বে। তবে সব কলেজে উপস্থিতি কম-এটা বলা যাবে না। শতবর্ষী ও জেলা পর্যায়ের কলেজগুলোতে হাজিরা মেইনটেন করা হয়।

তিনি বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলের কলেজগুলোতে শিক্ষক-ছাত্রদের মেন্টাল হেলথ কর্মসূচি, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চালু করতে যাচ্ছি, যা অনেকটাই হারিয়ে গিয়েছিল। বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে এমইউ করেছি, তারাও কাজ করছে কীভাবে ক্লাসে উপস্থিতি বাড়ানো যায়।

উপাচার্য বলেন, বছরে প্রায় ১০ লাখ শিক্ষার্থী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন নিয়ে বের হচ্ছেন। তাদের কোথায় কোথায় ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে একাডেমিক লিংকেজটা নেই, কেন নেইÑসেটা দেখার চেষ্টা করছে আমাদের টিম।

শিক্ষক সংকট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকারি-বেসরকারি সব কলেজেই শিক্ষকস্বল্পতা আছে। এটা একটা রাষ্ট্রীয় ইস্যু। এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয় কাজ করছে। আমাদের কলেজ মনিটরিং টিম সারা দেশে কাজ করছে। আগামী ৬ মাসের মধ্যে একটি ভালো ফল দেখা যাবে বলে আশা করছি।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান সম্পর্কে পটুয়াখালী সরকারি কলেজের এক শিক্ষক জানান, তাদের কলেজে ১০ শতাংশেরও কম শিক্ষার্থী ক্লাসে উপস্থিত থাকে। অনার্সের সব বিষয়ের ক্লাসেই একই অবস্থা।

ওই শিক্ষক আরো জানান, শিক্ষার্থীদের অনেকে পড়ালেখার পাশাপাশি পারিবারিক বিভিন্ন কাজে বা পার্টটাইম চাকরিতে জড়িত। যে কারণে ক্লাসে অনুপস্থিত থাকে। অন্যদিকে গাইড বইয়ের সাজেশন পড়ে তারা পরীক্ষা দেয়। পরীক্ষার প্রশ্নও গৎবাঁধা হওয়ায় কিছু কৌশল নিয়ে পড়লেই তা কমন আসে। তাছাড়া পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নেও দুর্বলতা আছে।

এক পরীক্ষক সিস্টেম, পরীক্ষকদের খাতাপ্রতি পারিশ্রমিক কম দেওয়া এবং বেশি খাতা দেখার চাপ ও মান রক্ষা না করেই বেশি নম্বর দেওয়ার কারণে পাসের হার বেশিই থাকে। যে কারণে শিক্ষার্থীদের ক্লাসের প্রতি আগ্রহ দিন দিন কমছে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, আওয়ামী সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে কলেজগুলোর শিক্ষার যে মান বজায় রাখার দরকার ছিল, তা হয়নি। একইসঙ্গে করোনা পরিস্থিতি ও অটোপাসেরও প্রভাব পড়েছে শিক্ষায়।

এ সময় যথাযথ শর্ত পূরণ বা মান নিশ্চিত না করেই দলীয় বিবেচনায় ৮ শতাধিক অনার্স ও ডিগ্রি পর্যায়ের কলেজের অনুমোদন দেওয়া হয়। দলীয় বিবেচনায় অনেক শিক্ষকও নিয়োগ দেওয়া হয়।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, সরকারি কলেজগুলোর প্রিন্সিপাল নিয়োগ, বদলি, প্রমোশন-সংশ্লিষ্ট সব কাজ শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে। এক্ষেত্রে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সম্পৃক্ততা না থাকায় শিক্ষা কার্যক্রম নিশ্চিতের ক্ষেত্রে তাদের কোনো জবাবদিহিও থাকে না।

অপরদিকে বেসরকারি কলেজগুলো পরিচালিত হয় গভর্নিং বডির অধীনে। দলীয় রাজনীতির প্রভাবেই এসব কমিটি হয়ে থাকে। তারাও একাডেমিক বিষয়ে তেমন একটা মনিটরিং করে না। ফলে অনেকটা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ইচ্ছামতই চলে কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বিগত সময়ে সিলেবাস-কারিকুলাম যেভাবে যুগোপযোগী করার দরকার ছিল, তা হয়নি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যেভাবে কলেজগুলো মনিটরিং করার কথা ছিল, তাও সঠিকভাবে হয়নি।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন বিভাগের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) সাহাবউদ্দিন আহাম্মদ জানান, দেশের বিভিন্ন স্থানে আকস্মিকভাবে কলেজ ভিজিটে যাচ্ছে আমাদের টিম। এ সময় একাডেমিক ও প্রশাসনিক বিভিন্ন তথ্য যাচাই করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত শতাধিক কলেজ ভিজিট হয়েছে। এতে বিভিন্ন কলেজে বহু অনিয়ম ধরা পড়েছে। অনেক কলেজের অধিভুক্তি সঠিকভাবে হয়নি। শিক্ষক-ছাত্র সংখ্যা, অবকাঠামো, জমিসহ যেসব শর্ত পূরণ করার কথা, তাতে ঘাটতি আছে। শর্তভঙ্গকারী কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের সুপারিশ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে কয়েকটির অধিভুক্তি বাতিলও হয়ে গেছে। এ ধরনের মনিটরিং কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।

সাহাবউদ্দিন আহাম্মদ আরো জানান, কলেজ মনিটরিংয়ের জন্য একটি সফটওয়্যার প্রস্তুত করা হচ্ছে। এতে কলেজের সব তথ্য থাকবে। অনলাইনে মনিটরিংয়ের পাশাপাশি সরেজমিনে আমাদের টিম আকস্মিক পরিদর্শন করবে। জেলাভিত্তিকও মনিটরিং সেল গঠন করা হচ্ছে। এতে স্থানীয় স্টেকহোল্ডারদের সম্পৃক্ত করা হবে।

সংশ্লিষ্টরা আরো জানান, শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দিতে বাজেট অনুমোদন হয়েছে। শহীদ মুগ্ধর নামে বৃত্তি চালু করা হচ্ছে। চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকে ভর্তি পরীক্ষা চালু হয়েছে। আরো বেশকিছু উদ্যোগ নিচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান কর্তৃপক্ষ।

এছাড়া শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে বেসরকারি কলেজের গভর্নিং বডি গঠন, সরকারি কলেজ শিক্ষকদের জবাবদিহিতে আনা, শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতি বন্ধ করাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

সূত্রমতে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সারা দেশের অধিভুক্ত কলেজ ও পেশাগত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষা প্রদান করে। বর্তমানে এর অধীনে দুই হাজার ২৫৭টি কলেজ রয়েছে, যার ৫৫৫টি সরকারি এবং ৮৮১টি কলেজে অনার্স কোর্স চালু রয়েছে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনুযায়ী এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি ও বেসরকারি মিলে এক হাজার ৯২১টি স্নাতক পাস (ডিগ্রি), ৮৮১টি স্নাতক, ১৭৬টি স্নাতকোত্তর, ৩১৭টি পেশাদার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। যাতে ৩৪ লাখ ২৫ হাজার ৮৩২ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে।