Image description

(মুমতাহিনা করিম মীম; অদম্য, সাহসী, আত্মপ্রত্যয়ী তরুণী। বিদেশে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন তার। সে অনুসারে নিয়েছেন তুমুল প্রস্তুতি। এর পর যুক্তরাষ্ট্রের ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন অফার লেটার। যুক্তরাষ্ট্রের হেনড্রিক্স কলেজের ‘হ্যাস মেমোরিয়াল বৃত্তি’ পেয়েছেন। সেখানেই আন্ডার গ্র্যাজুয়েটে পড়বেন। এ লেখায় তিনি তুলে নিজে ধরেছেন তার সংগ্রাম ও সাফল্যের গল্প।—বিভাগীয় সম্পাদক।)

আমার জন্ম চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার সরফভাটার ঐতিহ্যবাহী বড় বাড়িতে। বন্দরনগরীতেই কেটেছে শৈশব-কৈশোর। ছোটবেলা থেকেই শিল্পের প্রতি ছিল এক অদম্য আকর্ষণ। আমাদের ঘরের দেয়ালই ছিল আমার প্রথম ক্যানভাস। প্রতিদিন কিছু না কিছু আঁকতাম—কখনো রাজকন্যা, কখনো প্রকৃতি, কখনো নিজের কল্পনার কোনো চরিত্র। আম্মু বুঝে গিয়েছিলেন, আমার মধ্যে রয়েছে এক স্বাধীন শিল্পমন। তিনি আমাকে একটি আর্ট স্কুলে ভর্তি করালেন। কিন্তু স্কুলের ধরাবাঁধা নিয়ম-কানুনে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারিনি, কিছুদিন পরই স্কুলটা ছেড়ে দিই। পড়ালেখার পাশাপাশি আমি নিজের মতো করে আঁকাআঁকি চালিয়ে যেতে থাকি। সেখান থেকেই শুরু আমার একাকী আর্ট জার্নি—নিজের ছোট্ট স্টুডিও বানিয়ে রঙে-তুলিতে ডুবে থাকা। শিল্পের ভুবনে পথচলা। আঁকিবুঁকির নেশা যেন পেয়ে বসেছিল আমাকে। স্কুলের বন্ধুরা আমাকে ছুটির পর আটকে রাখত, যেন তাদের আর্ট করে দিই।

ছোটবেলা থেকে দেখতাম, আম্মু ফ্রিল্যান্সিং করতেন এবং প্রযুক্তির জগৎ সম্পর্কে যথেষ্ট জানতেন। একদিন তার ল্যাপটপ ঘাঁটতে ঘাঁটতে খুঁজে পেলাম আরেকটি ক্যানভাস—Paint। পেইন্ট সফটওয়্যারে ডিজিটাল আঁকাআঁকি শুরু করি। মাঝেমধ্যে মাকে প্রশ্ন করতাম, ‘ফাইল কীভাবে সেভ করব?’, ‘ইন্টারনেট কীভাবে চালাতে হয়?’, ‘ক্রোম কীভাবে ইউজ করব?’ ইত্যাদি নানা কৌতূহলভরা প্রশ্ন। আমার আগ্রহ দেখে আম্মু আমাকে ইউটিউব থেকে HTML ও CSS শেখার জন্য উৎসাহ দেন, যখন ক্লাস থ্রিতে। প্রথমে খুব একটা আগ্রহ পাইনি, কিন্তু পরে মায়ের অনুরোধে ল্যাপটপ খুলে কোডিং নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করি। তবে কোডিংয়ে সত্যিকারের আনন্দ খুঁজে পাই যখন দ্বিতীয়বার চেষ্টার পর নিজের প্রথম প্রোগ্রাম ‘হ্যালো ওয়ার্ড’ প্রিন্ট করি। আমি বুঝি, ট্যাপাট্যাপি করা কমান্ডগুলোও এক ধরনের শিল্প। নিজের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে সপ্তম শ্রেণিতে নিজের স্কুলের জন্য একটা ওয়েবসাইট তৈরি করেছিলাম। সেটা দেখে আমাদের আইসিটি টিচার খুব প্রশংসা করেন, আর অন্যদের বলেন আমার বানানো ওয়েবসাইটটা দেখতে। তখনও জানতাম না এই ছোট উদ্যোগগুলো একদিন আমাকে এত দূর নিয়ে যাবে।

একজন মেয়ে হয়ে প্রযুক্তির জগতে প্রবেশ করাটা ছিল চ্যালেঞ্জিং। অনেকেই বলতো, ‘এগুলো ছেলেদের জন্য।’ আবার কেউ কেউ সন্দেহ করত আমার দক্ষতা নিয়ে। নবম শ্রেণিতে আমি স্কুলে একটি প্রোগ্রামিং ক্লাব প্রতিষ্ঠা করি, যেখানে শুরুতে ৬৫ জন সদস্য ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তা আরও বড় হতে থাকে। আমি নিজে হাতে শিক্ষার্থীদের কোডিং শিখিয়েছি এবং আমার নেতৃত্বে আমাদের দল জাতীয় পর্যায়ে প্রথম স্থান অর্জন করে। কিন্তু চারপাশের মানুষজন বলত, ‘এগুলো মেয়েদের জন্য নয়, এসব শিখে কী হবে?’

চট্টগ্রামের অংকুর সোসাইটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ নিয়ে উত্তীর্ণ হই। করোনাকালীন সময়ে আমি নতুন করে আকৃষ্ট হই রোবটিক্সে। ইউটিউব দেখে ছোট ছোট প্রজেক্ট বানাতে শুরু করি। নিজের সঞ্চয় আর যাতায়াতের খরচ বাঁচিয়ে কিনে ফেলি একটা আরডুইনো কিট আর নানা রকম সেন্সর। আমার ছোট রুমটা হয়ে যায় একটা ল্যাব, আর সেখানেই বানাই আমার প্রথম ফুড-সার্ভিং রোবট ‘কিবো’।

আমার এসব কাজ অনেকেই সময় আর টাকার অপচয় মনে করত, কিন্তু আমার কাছে এগুলো ছিল ভালোবাসার জায়গা। কারণ এর মাঝে আমি নিজের আনন্দ খুঁজে পেতাম। কখনো ভাবিনি, এই ছোট ছোট প্রজেক্টগুলো একদিন আমার যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষার স্বপ্নপূরণের পথে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

কোডিংয়ের পাশাপাশি আমি শিল্প, সাহিত্য, বিতর্ক, সংগীত— সবকিছুতেই গভীরভাবে জড়িত ছিলাম। পেয়েছিলাম নানা পুরষ্কার। একজন বাংলাদেশি মেয়ে হিসেবে বিজ্ঞান, কোডিং বা রোবটিক্সের স্বপ্ন দেখা কখনোই সহজ ছিল না আমার জন্য। অনেকেই বলত, ‘মেয়ে হয়ে এত বড় স্বপ্ন দেখতে নেই।’ কিন্তু আমি বিশ্বাস করি সে ছেলে বা মেয়ে হোক, মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। তাই এইচএসসি শেষ করে যখন সবাই দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, আমি একা হাতে শুরু করি আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবেদন।

পরিবারের কেউ বিদেশে উচ্চশিক্ষার কথা ভাবেননি, তাই পুরো প্রক্রিয়াটা আমাকে একা শিখতে হয়। উল্টো স্কলারশিপ পাওয়াও কঠিন, অনেকে নিরুৎসাহিত এবং হাসি-ঠাট্টা করত। আর ভালো স্কলারশিপ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে পড়াশোনার খরচ বহন ছিল অসম্ভব। কিন্তু আমি চেষ্টা না করে থেমে যাওয়ার বিপক্ষে ছিলাম।

রাতের পর রাত জেগে অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করা, ইংলিশ প্রোফিসিয়েন্সি টেস্ট, একাধিকবার SAT দিতে হয়েছে। হাত খরচের জন্য একটি আমেরিকান কোম্পানিতে চাকরিও নিয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিদিন রাত জাগার কারণে অনেকে বাজে মন্তব্য করা শুরু করল। শেষমেশ কাজটা ছেড়ে পুরোপুরি এপ্লিক্যাশনে মনোনিবেশ করি। আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ আমার শিক্ষক মিজানুর রহমান স্যারের কাছে, যিনি আমাকে স্কুল, কলেজের পড়াশোনার পাশাপাশি SAT এর জন্যও পড়িয়েছেন।

ধীরে ধীরে ডিসিশন লেটার আসতে শুরু করে। অপেক্ষার সেই সময়টা ছিল মানসিকভাবে খুব কঠিন। প্রতিদিন মনে হতো—‘আমি পারব তো?’, ‘আমার ভবিষ্যৎ কী?’—এমন হাজারটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেত মাথায়। দিনের পর দিন গবেষণা, সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার চাপ, আর না জানার ভয়—সবকিছুর মাঝেই অফার লেটার পেতে থাকি।

আমি যুক্তরাষ্ট্রের ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয় ও লিবারেল আর্টস কলেজ থেকে পড়াশোনার জন্য অফার লেটার পাই। এর মধ্যে রয়েছে Hendrix College, Franklin and Marshall College, Colorado University Boulder, Penn State University, Knox College, Spelman College, Clemson University সহ আরও অনেক নামকরা প্রতিষ্ঠান। সবচেয়ে বিশেষ ছিল Hendrix College থেকে পাওয়া Hays Memorial Scholarship—একটি প্রেস্টিজিয়াস ফুল-রাইড স্কলারশিপ যা প্রতি বছর সারা পৃথিবী থেকে মাত্র ৪ জনকে দেওয়া হয়। আর আমি সেই সৌভাগ্যবান ৪ জনের একজন, এবং বাংলাদেশ থেকে দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে এই সম্মান অর্জন করি। একদিন ইমেইলের মাধ্যমে আমাকে জানানো হয়েছিল আমি এই বৃত্তির জন্য ফাইনালিস্ট হয়েছি এবং ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাক পড়ে। ভালোই হয়েছিল। তারপর ইন্টারভিউয়ের কয়েকদিন পর আমাকে কলেজ কর্তৃপক্ষ মিটিং এ ডেকে জানায় আমি এই স্কলারশিপ এর জন্য নির্বাচিত হয়েছি। 

পাশাপাশি, Franklin and Marshall College থেকে পেয়েছি ৩.৬ কোটি টাকার স্কলারশিপ, Colorado Boulder থেকে ১.২ কোটি, Rhodes College থেকে ২.৫ কোটি এবং Knox College থেকে প্রায় ৩ কোটি টাকার অফার পেয়েছি।

আমার পথচলায় বারবার হতাশা এসেছে, ব্যর্থতা এসেছে। কিন্তু আমি সবসময় বিশ্বাস করেছি—পরিশ্রমের আগুনে নিজেকে পুড়াতে পারলে, একদিন ঠিকই হীরায় পরিণত হওয়া যায়। রবার্ট দ্য ব্রুস যেভাবে গুহার মধ্যে মাকড়সার জাল দেখে বারবার চেষ্টা করেছিলেন, ঠিক তেমনই আমিও চেষ্টার বন্ধন ছাড়িনি। ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালামের সেই বিখ্যাত উক্তিই আমার প্রেরণা হয়ে দিয়েছে, ‘স্বপ্ন সেটা নয়, যেটা মানুষ ঘুমিয়ে দেখো। স্বপ্ন সেটাই, যেটা পূরণের প্রত্যাশা মানুষকে ঘুমাতে দেয় না।’

আমার পুরো যাত্রায় আমি একটা জিনিস বুঝেছি— স্বপ্ন কখনও বড় বা ছোট হয় না। যত চ্যালেঞ্জই আসুক, যদি মনোবল দৃঢ় থাকে, পরিশ্রম করার মানসিকতা থাকে, তবে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। যদি লেগে থাকা যায়, যদি বিশ্বাস রাখা যায়, তাহলে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে উঠে এসে যে কেউ সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছাতে পারে।

আমি আজও স্বপ্ন দেখি, আজও পুড়ি কয়লার মতো। কেননা, আমি জানি একদিন আমিও হব হীরা। এই পথ শুধু আমার একার নয়—এটা সেই সমস্ত সাহসী মেয়েদের গল্প, যারা শিল্প, বিজ্ঞান, আর ভালোবাসার আলোয় গড়ে তুলতে চায় এক নতুন ভবিষ্যৎ।