Image description

২৬ ফেব্রুয়ারি, বুধবার। খেয়েদেয়ে রাত ৯টার দিকে শুয়েছেন জাকারিয়া। দুই চোখের পাতা এক হচ্ছে না। ফেসবুক স্ক্রল করতে গিয়ে বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশের খবর পেলেন।

তবে নেটওয়ার্ক বড্ড দুর্বল। রেজাল্টের পিডিএফশিটটা  খোলা যাচ্ছে না। অনেক কসরত করে যাও বা খুললেন, মেধা তালিকায় নিজের নামটা খুঁজে পেলেন না। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল—এত পরিশ্রম সব জলে! চোখে নামল জলের ধারা।

এমন সময় বুয়েটের এক বড় ভাইয়ের ফোন—‘অভিনন্দন, তুমি মেধাতালিকায় ৩৮৩তম হয়েছো। ট্রিপল ই (ইইই) পেয়েছো!’
নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না জাকারিয়া। পরে এক বন্ধুর মাধ্যমে নিশ্চিত হলেন—সত্যিই, বুয়েটের দরজা খুলে গেছে তোর জন্য।

জাকারিয়া অমনি ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন মা মমতাজ বেগমকে।

আবেগ জড়ানো কণ্ঠে বললেন, ‘মা, আমি বুয়েটে চান্স পেয়েছি।’

শয্যাশায়ী বাবার কপালে চুমু খেলেন। ততক্ষণে তিনজনের চোখে আনন্দের নহর। আশপাশের তিন গ্রামে এই প্রথম একজন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) পড়ার সুযোগ পেয়েছে। খবরটা ছড়াতে দেরি হলো না।

জাকারিয়াদের ভাঙা ঘরে একে একে আসতে লাগলেন প্রতিবেশীরা। সবার একটাই কথা—মমতাজ বেগমের কষ্টের দিন আর থাকবে না।

শত কষ্টেও হাল ছাড়েননি

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার প্রত্যন্ত চরকাদাই গ্রামে জন্ম জাকারিয়া হোসেনের। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। সাত সদস্যের বড় পরিবার। বুঝতে শেখার পর থেকে জাকারিয়া দেখছেন সংসারজুড়ে অভাব। একমাত্র রোজগেরে বাবা নাছির উদ্দীন। নিজের জমি নেই। ধান রোপণ ও ফসল তোলার মৌসুমে ভালো মজুরির আশায় চলে যেতেন ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ বা টাঙ্গাইলে। সঙ্গে নিতেন বড় ছেলে মামুনকে।

অভাবের কারণে হাই স্কুলেই থেমে যায় জাকারিয়ার দুই বোনের পড়াশোনা। তিনবেলা ভরপেট ভাত জুটত না। ‘রোজা রেখেছেন’ বলে মা যে কতবেলা না খেয়ে থেকেছেন, হিসাব নেই। খুব ছোট থাকতেই জাকারিয়া বুঝে গিয়েছিলেন এই অভাব তাড়াতে পড়াশোনার বিকল্প নেই। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় অন্যের জমিতে মজুরি খেটেছেন। কালেভদ্রে নতুন জামা উঠত গায়ে। বেশির ভাগ সময় চাচাতো ভাইদের পুরনো জামাকাপড় পরতেন। স্কুল ড্রেসের জন্য স্যারদের বকুনিও কম খাননি। একবার ইউনিফরম পরে যাননি বলে পরীক্ষার হলে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এত প্রতিকূলতার মধ্যেও জাকারিয়া হাল ছাড়েননি। ক্লাসে সব সময় প্রথম সারিতে থাকত তাঁর নাম। বেলতৈল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং শাহজাদপুর সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন জিপিএ ৫ পেয়ে।

খরচ বাঁচাতে বিস্কুট-পানিতে রাত পার : ‘আমার ভাঙা ঘরের ভাঙা চালা/ভাঙা বেড়ার ফাঁকে/অবাক জোছনা ঢুইকা পড়ে/হাত বাড়াইয়া ডাকে।’

জাকারিয়াদের ঘর দেখলে হুমায়ূন আহমেদের এই গানটার কথা মনে পড়বে। মা-বাবা, ভাই-বোন মিলে ছোট্ট একটা টিনের ঘরে থাকেন। ঘরের চালায় ফুটো। তা দিয়ে অবাধে বৃষ্টির জল আর ‘অবাক জোছনা ঢুইকা পড়ে’। আসবাব বলতে একটা মাত্র খাট আর শোকেস। মোটেও পড়াশোনার পরিবেশ নেই। এখানেই জাকারিয়া অসাধ্য সাধন করেছেন।

কলেজে ভর্তির পর মেসে ওঠেন জাকারিয়া। মাসে খরচ প্রায় চার হাজার টাকা। টিউশনি করে পেতেন হাজার তিনেক। বাকি এক হাজারের ঘাটতি মেটাতে মাঝেমধ্যেই রাতে মেসের মিল বন্ধ রাখতেন। দুটি বিস্কুট আর পানি পান করে ঘুমিয়ে পড়তেন।

কলেজে প্রথমদিকে বই কিনতে পারেননি। লাইব্রেরিতে গিয়ে দিনের পড়া শেষ করে আসতেন। পরে পুরনো বই জোগাড় করেছিলেন। খরচ বাঁচাতে কম দামে পরিত্যক্ত কাগজ কিনে লিখতেন। বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র জাকারিয়া। কখনো প্রাইভেট পড়ার সুযোগ পাননি। উচ্চতর গণিত বা পদার্থ বিজ্ঞানের কোনো অধ্যায় নিয়ে সমস্যায় পড়লে নিজে নিজে সমাধানের পথ খুঁজতেন।

করোনাকালে দশম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন জাকারিয়া। স্মার্টফোনের অভাবে অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারছিলেন না। তাঁর বড় ভাই মামুন তখন বোর্ড বৃত্তি পেয়েছিলেন। সেই বৃত্তি আর এক চাচার কাছ থেকে নেওয়া মোট আট হাজার টাকায় একটা স্মার্ট ফোন কেনেন। ইউটিউবে অনুপ্রেরণামূলক ভিডিও দেখতেন। গণিত, পদার্থ বিজ্ঞান ও রসায়নের সেরা শিক্ষকদের ক্লাস দেখারও সুযোগ করে দিয়েছিল ফোনটি।

অনুপ্রেরণা জোগানো ছবি

স্কুলজীবন থেকেই প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন জাকারিয়ার। কলেজে পড়ার সময় পণ করেছিলেন—বুয়েটে চান্স পেতেই হবে। এইচএসসির পর সহপাঠীরা প্রায় সবাই ঢাকা বা জেলা শহরে ভর্তির কোচিংয়ে ব্যস্ত। কিন্তু জাকারিয়া অত টাকা পাবেন কোথায়?

এ সময় তাঁর বড় বোনের বিয়ে ঠিক হলো। তখন জমি বিক্রি করে জাকারিয়াদের পাশে দাঁড়ালেন তাঁর ফুপু। সেই অর্থ থেকে কিছু টাকা নিয়ে একটা কোচিংয়ে অনলাইন কোর্সে ভর্তি হলেন জাকারিয়া। বড় বোন ও দুলাভাই গার্মেন্টসে চাকরি করেন। ভর্তির প্রস্তুতির সময়টায় তাঁরা টাকা পাঠাতেন জাকারিয়াকে। তত দিনে তাঁর বাবার যক্ষ্মা ধরা পড়ে। জাকারিয়া বলেন, ‘সব সময় মা-বাবার ছবি থাকে ফোনের ওয়ালপেপারে। মন খারাপ হলে সেই ছবি দেখতাম। এত কষ্টের মধ্যেও সেটা অনুপ্রেরণা জোগাত।’

তিনটিতে সুযোগ
বুয়েট, কুয়েট আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলেন। ঢাকা কিংবা খুলনায় কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই। তাই ভর্তি পরীক্ষার আগে খুব চিন্তায় থাকতেন। বাসে চড়ার মতো টাকা ছিল না। ঢাকা বা খুলনা যেতে ট্রেনই ভরসা। বলতে গেলে পুরোটা পথই দাঁড়িয়ে যেতেন। টিকিট মাস্টারকে নিজের অবস্থা বুঝিয়ে বলতেন। তাঁরা বিনা টিকিটে ভ্রমণের সুযোগ দিতেন। এভাবে তিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়ে তিনটিতেই সুযোগ পেয়েছেন জাকারিয়া। বুয়েটে ৩৮৩তম, কুয়েটে ৯১০তম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর মেধাক্রম ছিল ১৮৭৬তম। শেষে ভর্তি হয়েছেন বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে।

বিত্তবানদের পাশে চান
প্রতিষ্ঠিত হয়ে তাঁর মতো দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে চান জাকারিয়া। ১২ এপ্রিল থেকে বুয়েটজীবন শুরু হয়েছে। তাঁর ঠিকানা এখন কাজী নজরুল ইসলাম হল। ঢাকায় একেবারে নতুন এই তরুণ এখনো টিউশনি জোটাতে পারেননি। জাকারিয়ার বাবা নাছির উদ্দিন বলেন, ‘অভাবের কারণে দুই মেয়েকে পড়াতে পারিনি। ছেলেটাকে (জাকারিয়া) কখনো ভালো কিছু খাওয়াতে-পরাতে পারিনি। ও অনেক কষ্ট করেছে। নিজের খরচ নিজে চালাইছে। সামনে কিভাবে পড়াশোনার খরচ চালাবে, তা নিয়েই এখন চিন্তা।’

তবে নিজের চেয়ে জাকারিয়ার বেশি চিন্তা এখন বাবাকে নিয়ে। মেধাবী এই তরুণ বললেন, ‘দারিদ্র্যকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। এক টাকার মূল্য কত—আমি বুঝি! সব সময় ভাবতাম, বড় হয়ে পরিবারের দায়িত্ব নেব। বাবাকে একটু বিশ্রাম দেব। অসুস্থতার কারণে বাবা এখন শয্যাশায়ী। টাকার অভাবে চিকিৎসাও করাতে পারছি না। একদিকে বাবার চিকিৎসা, অন্যদিকে নিজের পড়াশোনার খরচ—কিভাবে চলবে, ভেবে পাচ্ছি না।’