
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু)-এর ২৩টি পদের মধ্যে ভিপি-এজিএসসহ ২০টিতে জয় পেয়েছে শিবির সমর্থিত সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট। হলগুলোতেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের ব্যাপক ভরাডুবি হয়েছে। রাকসুর একটি মাত্র পদ ছাড়া আর কেউ বিজয়ী হতে পারেনি। ভোটের হিসাবে তাদের প্রাপ্তিও হতাশাজনক। মূলত চারটি প্রধান কারণেই প্যানেলটির এমন ভরাডুবি হয়েছে বলে মনে করছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, ছাত্রদল প্যানেলের প্রার্থীসহ সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, এগুলো হচ্ছে-অসংগঠিত নেতাকর্মী ও দায়সারা প্রচারণা, ক্যাম্পাসের বাইরে নেতাদের বসবাস, ক্যাম্পাসে দীর্ঘদিন অনুপস্থিতি এবং তফশিলের পর রাবি কমিটি গঠন। এসব কারণে ছাত্রদলের প্রতি শিক্ষার্থীদের আস্থার ঘাটতি সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে শিবিরের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও কৌশল, সুসংগঠিত প্রচারণা ও বিশাল কর্মীবাহিনী, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ, পরোক্ষভাবে প্রশাসনিক আনুকূল্য এবং শক্তিশালী আর্থিক ভিত্তি তাদের ভূমিধস বিজয় এনে দিয়েছে। রাকসুতে জিততে নগরী ছাড়াও আশপাশের জেলাগুলো থেকে জামায়াত ও শিবিরের নেতাকর্মীদের রাজশাহীতে এনে ক্যাম্পাসের বাইরের মেসগুলোতে প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এসএম হলের একটি পদে পরাজিত এক ছাত্রদল নেতা বলেন, রাকসুতে ছাত্রদলের পরাজয়ের কিছু বাস্তব কারণ আছে। আমরা অনেকেই পদ হারানোর ভয়ে বলতে পারছি না। শিবির জিতেছে, কারণ তারা শিক্ষার্থীদের আস্থা অর্জন করতে পেরেছে। কিন্তু ছাত্রদল কোনোভাবেই শিক্ষার্থীদের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করেনি। পরাজয় শুধু সময়ের ব্যাপার ছিল মাত্র।
দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা গেছে, রাকসু নির্বাচনের আগে থেকেই ছাত্রদল নেতাকর্মীরা ক্যাম্পাসে দীর্ঘদিন অনুপস্থিত ছিল। গত সরকারের আমলে তাদের ওপর ব্যাপক দমন-পীড়ন ঘটেছে। তবে এর মধ্যেই শিবির বিভিন্ন ফরমেটে ক্যাম্পাসে গোপনে সাংগঠনিক কাজ করে গেছে। ছাত্রদল রাবিতে পুরোপুরি অসংগঠিত থেকেছে। এমনকি নির্বাচনি প্রচারণাতেও তারা ঐক্যবদ্ধ ছিল না। তারা বলেন, যাদের রাকসু ও হল সংসদে প্রার্থী করা হয়েছিল তাদের অধিকাংশই ক্যাম্পাসে থাকেন না। অধিকাংশই ক্যাম্পাসের বাইরে বসবাস করেন। বিপরীতে শিবিরের প্রতিটি নেতাকর্মী বিভিন্ন হলে থাকেন। ক্যাম্পাসে ও হলগুলোতে নিয়মিত তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চলেছে। শিবির এক বছর আগে থেকেই রাকসুমুখী কার্যক্রম চালিয়েছে। গত বছর ৫ আগস্টের পর শিবির পুরোপুরি ক্যাম্পাসে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। ছাত্রদল নেতাকর্মীরা তা করতে পারেনি।
ভোট প্রচারণা শুরুর পরও ক্যাম্পাস ও হলগুলোতে ছাত্রদলের ঐক্যবদ্ধভাবে কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রম তো ছিলই না। বরং একেকজন একেকভাবে চলেছেন। ছাত্রদলের প্রচারণা ছিল দায়সারা। ছাত্রদলের ভিপি নূর উদ্দীন আবির ও জিএস প্রার্থী নাফিউল পৃথকভাবে প্রচারণা করেছেন। তাদের মধ্যেও সমন্বয় ছিল না। হলগুলোতেও ঐক্যবদ্ধ প্রচারণা করতে পারেনি ছাত্রদল।
রাকসুর গুরুত্বপূর্ণ একটি পদের ছাত্রদল প্রার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ছাত্রদলের রাবি সভাপতি সুলতান রাহী মাঝে মাঝে ক্যাম্পাসে আসেন। থাকেন শহরে। সংগঠনের বাইরে নানান কাজে ব্যস্ত থাকেন। রাকসুর প্রচারণায় সময় দিতে পারেননি। অনেক শিক্ষার্থী ছাত্রদলের সভাপতিকেই চেনেন না। অন্য প্রার্থীদেরও তারা ভোটের আগে চিনতেন না। শিক্ষার্থীরা এ কারণে ছাত্রদলের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। শিবির ছাত্রদলের ঠিক উলটো কাজগুলো করে শিক্ষার্থীদের মন জয় করে নিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাকসুতে পরাজিত আরেক ছাত্রদল প্রার্থী বলেন, সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা আমাদের পরাজয়ের বড় কারণ। রাকসু নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। গত ২৮ জুলাই ঘোষণা করা হয় তফশিল। তফশিল ঘোষণার আগে রাবি ছাত্রদলের কোনো কমিটিই ছিল না। তফশিল ঘোষণার একদিন পর কেন্দ্র থেকে তড়িঘড়ি করে ১১ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। ছিল না কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রমও। কমিটির ৬ জনেরই ছাত্রত্ব ছিল না। সভাপতি সুলতান রাহী ২০০৯-১০ সেশনের শিক্ষার্থী। কয়েক বছর আগেই শিক্ষাজীবন শেষ করে ক্যাম্পাস ছাড়েন। কমিটি ঘোষণার আগে তিনি একটি সান্ধ্যকোর্সে ভর্তি হন। অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক সরদার জহুরুল ২০১১-১২ সেশনের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। রাবি ছাত্রদলে পদ পেতে তড়িঘড়ি করে রাবিতে একটি ভাষা কোর্সে ভর্তি হন। পরে ১১৩ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা হলেও কমিটির সদস্যদের অধিকাংশই ক্যাম্পাসের বাইরের বাসিন্দা ছিলেন। এই সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলার কারণে শিক্ষার্থীরা রাকসুতে ছাত্রদল প্রার্থীদের সমর্থন দেয়নি।
ছাত্রদলের সৌরভ হোসেন নামের এক কর্মী বলেন, প্রচারণায় ছাত্রদল, শিবিরের তুলনায় হাজারগুণ পিছিয়ে ছিল। একটি হলের পরাজিত জিএস প্রার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ছাত্রদলের প্রচারণা ছিল দায়সারা। হলগুলোতে শিবির পরিচিতি সভা করলেও ছাত্রদল করতে পারেনি। হলের নেতারাও ক্যাম্পাসের বাইরের বাসিন্দা হওয়ায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের সংযোগ গড়ে ওঠেনি। তিনি আরও বলেন, হলের শিক্ষার্থীরা আমাদের প্যানেলের অধিকাংশকেই চিনতেন না। ব্যাপক প্রচারণার জন্য যে টাকা-পয়সার দরকার ছিল তার জোগান ছিল না। বিপরীতে শিবির দুহাতে টাকা খরচ করেছে। শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন উপহার সামগ্রী ও নিয়মিত খাবার দিয়েছে। শিক্ষার্থীরা এসব কারণে আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়েছে।
রাবি প্রশাসনে জামায়াত সমর্থক শিক্ষকদের আধিপত্যকে ছাত্রদলের পরাজয়ের আরও একটি কারণ হিসাবে দেখছেন মহানগর বিএনপির নেতারা। রাজশাহী মহানগর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা এরশাদ আলী ইশা বলেন, রাবির পুরো প্রশাসনের অধিকাংশ পদে জামায়াতের শিক্ষকরা আসীন। শিবিরকে তারা নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, শিবিরের নেতাকর্মীরা শিক্ষার্থীদের মাঝে বিভিন্ন ধরনের উপহার সামগ্রী ও নিয়মিতভাবে খাবার বিতরণ করতেন। এসব দেখেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। রাবি প্রশাসনের পক্ষপাতের কারণে ছাত্রদল ঠিকভাবে প্রচারণা করতে পারেনি। কারণ রাবির পুরো প্রশাসনের বিভিন্ন জায়গায় জামায়াতের শিক্ষকরাই পদায়িত হয়েছে গত বছর ৫ আগস্টের পর।
অন্যদিকে রাবি ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৮৮ ও ১৯৯০ সালে ছাত্রশিবির রাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন। ওই বছর কোনো পদেই তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পারেননি। সর্বশেষ ১৯৯০ সালের ২৯ জুলাই অনুষ্ঠিত রাকসু নির্বাচনে শহীদ শামসুজ্জোহা হলের ভিপি-জিএসসহ সবগুলো পদেই শিবির বিজয়ী হয়েছিল। রাবির ইতিহাসে একটি হল সংসদে প্রথমবার জয় ছিল শিবিরের একমাত্র অর্জন। ১৯৮১ সালে ইসলামী ছাত্রশিবির রাবিতে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করে। এরপর গত ৪৪ বছরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের রাজনীতি নানান চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এগিয়েছে। ব্যাপক সাংগঠনিক কার্যক্রমের মাধ্যমে শিবির রাবিতে বৃহৎ ছাত্রশক্তি হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।