ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বর্তমানে একটি আলোচিত-সমালোচিত বাহন। এর সুবিধাও যেমন আছে, তেমনই রয়েছে নানা বিতর্ক। তবে এই রিকশা এখনও কোনও নির্দিষ্ট আইনি কাঠামোর আওতায় আসেনি। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন কিংবা বিআরটিএ (বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ)— কোনও পক্ষই এই যানবাহনের দায়িত্ব নিচ্ছে না।এদিকে সুনির্দিষ্ট কোনও সমাধান না দিয়ে হাইকোর্ট থেকে একাধিকবার ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের নির্দেশনা দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। ফলে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চলাচল নিয়ে সিটি করপোরেশন ও বিআরটিএ’র দ্বিধাদ্বন্দ্ব এবং হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়নে ব্যর্থতা সড়ক ব্যবস্থাপনায় বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন অনেকে।
সিটি করপোরেশন ও বিআরটিএ’র ভিন্ন অবস্থান
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্টরা বলছে, তারা কেবল পা-চালিত রিকশার লাইসেন্স দিয়ে থাকে এবং ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা তাদের আওতার বাইরে। অপরদিকে, বিআরটিএ বলছে, তাদের তালিকায় এমন যানবাহনের কোনও জায়গা নেই। তাদের দায়িত্ব শুধু সিএনজি অটোরিকশার নিবন্ধন প্রদান করা। ফলে এই রিকশা নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলায় আনতে কোনও উদ্যোগ নেই কোনও পক্ষেরই।উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়ে আমাদের কোনও পরিকল্পনা নেই। এটি যান্ত্রিক না অযান্ত্রিক—সেটিই তো এখনও সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। আমরা কেবল অযান্ত্রিক যান, যেমন- রিকশা এগুলোর নিবন্ধন দেই। এটা আমাদের আইন কভার করে।’তিনি বলেন, ‘হাইকোর্টে বেশ কয়েকটি মামলা দায়ের করে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার জন্য লাইসেন্স চাওয়া হয়েছিল। আমরা প্রত্যেকটা মামলা জিতেছিলাম এবং বলেছিলাম— আমরা লাইসেন্স দেবো না। ঢাকায় এ ধরনের অটোরিকশা চলবে না। পরে আবার হাইকোর্ট থেকে বিষয়টি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলো। এখন মন্ত্রণালয় কী সিদ্ধান্ত নেবে, তা দেখতে হবে।’এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান মো. ইয়াসীন বলেন, ‘এটি আমরা দেখছি না। এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হবে। তবে এখনও কিছু জানতে পারিনি। আশা করছি খুব শিগগিরই এ বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত আসবে।’
প্রধান সড়কে দৌরাত্ম্য ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি
২০১৭-১৮ সালের দিকে রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলতে শুরু করে। প্রথমদিকে গলিপথে সীমাবদ্ধ থাকা এসব রিকশা এখন প্রধান সড়কেও বেপরোয়া গতিতে চলাচল করছে। দিন দিন এই রিকশার সংখ্যা বাড়ছে, যা সড়কে যানজট ও দুর্ঘটনা বৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক সমীক্ষা বলছে, গত এক বছরে সড়ক দুর্ঘটনার ১৩ শতাংশের জন্য এই ব্যাটারিচালিত রিকশা দায়ী। সড়কে এই অটোরিকশার দৌরাত্ম্যের কারণে সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। অনেকে পঙ্গুত্ববরণ করছেন, এমনকি মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।
হাইকোর্টের নির্দেশনা ও বাস্তবায়নের ব্যর্থতা
ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধের জন্য হাইকোর্ট থেকে একাধিকবার নির্দেশনা এসেছে। কিন্তু চালক ও শ্রমিক সংগঠনের বিরোধিতার কারণে এই নির্দেশনা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। বরং সরকারের উদ্যোগের অভাবে এই রিকশার সংখ্যা ও কার্যক্রম দিন দিন আরও বেড়ে চলছে। কেবল হাইকোর্টের নির্দেশনা অমান্যই নয়, ট্রাফিক আইনেরও তোয়াক্কা করছেন না এই অটোরিকশার চালকরা। এ নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই রাজধানীবাসীর।তারা বলছেন, অটোরিকশা মন্দ না। তবে অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলার কারণে প্রায়শই দুর্ঘটনা ঘটছে। পাড়ামহল্লার অলিগলিতেও এদের কারণে সাবলীল চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।এ বিষয়ে মিরপুরের স্থানীয় বাসিন্দা কামরুল ইসলাম বলেন, ‘এসব রিকশা এখন বিরক্তির কারণ। আগে রিকশা ডেকে পাওয়া যেতো না। এখন এদের সংখ্যা এত বেড়েছে যে এক জায়গায় দুই মিনিট দাঁড়ালে অন্তত পাঁচটা রিকশা এসে জিজ্ঞাসা করে যাবো কিনা। যাত্রীর চেয়ে এখন রিকশা অনেক বেশি।’‘হাঁটার মতো পরিস্থিতিও নেই’ জানিয়ে মালিবাগ এলাকার বাসিন্দা রুকাইয়া রহমান বলেন, ‘হাঁটাহাঁটির অভ্যাস ছিল। বর্তমানে ব্যাটারিচালিত রিকশা এমনভাবে চলে, মনে হয় গায়ের ওপর এসে পড়বে। বুক কেঁপে ওঠে। হাঁটার সময় সতর্ক থাকতে হয়। কিন্তু কতদিন? প্রায়ই তো দুর্ঘটনার খবর পাই।’
নতুন নীতিমালার প্রতিশ্রুতি
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা এই অটোরিকশার জন্য নতুন নীতিমালা তৈরির কাজ শুরু করেছে। তবে এখনও কোনও সুনির্দিষ্ট কাঠামো নির্ধারণ হয়নি।এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. সালাউদ্দিন বলেন, ‘ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়ে শিগগিরই বৈঠক হবে। এই পরিবহন নিয়ে কোনও আইন বা নীতিমালা করা হবে কিনা, এ বিষয়ে আলোচনা হবে।’