
ঢাকায় তখন মুষলধারে বৃষ্টি। বর্ষণ উপেক্ষা করেই অনেকে এলেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। লালনের গানের ভক্ত রইস উদ্দীন বললেন, ‘গানের পাখি’ ফরিদা পারভীনের মৃত্যুতে ‘আকাশও যেন কাঁদছে’।
রাজধানীর মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শনিবার রাত সোয়া ১০টায় মারা যান ফরিদা পারভীন। তার বয়স হয়েছিল ৭১ বছর।
কথা ছিল, শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের এই আয়োজন শুরু হবে রোববার সকাল সাড়ে ১০টায়। তবে তেজকুনি পাড়ার বাড়ি থেকে ফ্রিজিং গাড়িতে করে কফিন পৌঁছাতে বেলা সোয়া ১১টা বেজে যায়।
ততক্ষণে শিল্প ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রতিনিধিরা সেখানে জড়ো হয়েছেন। ফরিদা পারভীনের গানের ভক্তরাও অনেকে এসেছেন শহরের নানা প্রান্ত থেকে।
পরে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনায় শুরু হয় শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব। জাতীয় কবিতা পরিষদ, সত্যেনসেন শিল্পী গোষ্ঠী, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক দল- জাসাস, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, জাতীয় জাদুঘর, শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এবং সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয় শিল্পীর কফিনে।
এই শিল্পীর কথা স্মরণ করতে গিয়ে ভক্তদের অনেকের চোখ ভিজে এল, কণ্ঠে ভর করল আবেগ।
কেরানীগঞ্জ থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসেছিলেন 'তৌহিদের পাঠশালা' নামে একটি ভাববাদী প্রতিষ্ঠানের প্রধান খাদেম আলী আরিফ আকবর। ভাবতত্ত্বের এই অনুরাগী বলছিলেন, বাংলার সহজীয়া যে ভাববাদের চর্চা, তাকে বিশ্ব দরবারে নিয়ে গিয়েছেন ফরিদা পারভীন। গুরুবাদী শিক্ষা, মুর্শিদ ভজনের শিক্ষার প্রচার করেছেন আজন্ম। এজন্যই তিনি ফরিদা পারভীনকে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছেন।
আখড়াবাড়ি থেকে মধ্যবিত্তের ঘরে ফরিদা পারভীন
শ্রদ্ধা জানাতে এসে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "ফরিদা পারভীন দুইটা ক্ষেত্রে অত্যন্ত বড় শিল্পী। সংগীতজীবনের প্রথম দিকে তিনি আধুনিক গানের চর্চা করেছেন। পরে তিনি লালন সংগীতের সাধনায় নিজেকে নিমগ্ন করেন।
"লালনের গান পরিবেশনায় উনার যে গায়কী, তাতে একটা 'মধ্যবিত্ত ভাব' আছে। এই ভাব দিয়েই তিনি মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে গিয়েছেন। লালনসংগীতশিল্পী হিসেবে তিনি মধ্যবিত্তের কাছে এমন উচ্চতায় গিয়েছিলেন, তার কোনো তুলনা আসলে হয় না। শেষের দিকে তিনি আসলে লালন সাধক হিসেবেই জীবনযাপন করেছেন।"
তিনি বলেন, "আরেকটা বিশেষ দিক বলা যায়, একজন শিল্পীই যে সংস্কৃতির একটা ভিন্ন মাত্রা তৈরি করতে পারেন, তার উদাহরণ কিন্তু খুব বেশি নেই। ফরিদা পারভীন আমাদের সেরকম উদাহারণ, তিনি একাই ঘরানা তৈরি করতে পেরেছেন।"
লালনের গান আখড়াবাড়ি থেকে তুলে এনে ফরিদা পারভীন প্রতিটি বাঙালীর ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন বলে মন্তব্য করেন গবেষক তপন বাগচী।
শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের ফাঁকে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "আখড়ার শিল্পীদের আপত্তিকেও ফরিদা পারভীন কখনো কখনো তোয়াক্কা করেননি। তার গায়কি আখড়ার ঘরানা থেকে কিছুটা আলাদা হলেও সাধারণ মানুষ গ্রহণ করার মত উপকরণ তিনি তৈরি করতে পেরেছিলেন।"
লালনের গান গাওয়ার পাশাপাশি তার আরেকটি পরিচয় হারিয়ে গেছে মন্তব্য করে তপন বাগচী বলেন, "আমরা তাকে চিনতাম আধুনিক গানের অনেক বড় একজন শিল্পী হিসেবে। 'তোমরা ভুলেই গেছ মল্লিকাদির নাম' গানটি তার কণ্ঠে ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল। এই গানটির গীতিকার আবু জাফর তার প্রথম স্বামী। তাকেও আজকের দিনে স্মরণ করি। কারণ গীতিকার জাফরের লেখা গানেই রাজশাহী বেতারের মাধ্যমে তিনি সংগীতশিল্পী হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন।"
২০০৮ সালে জাপান সরকারের ‘ফুকুওয়াকা এশিয়ান কালচার’ পুরস্কার পান ফরিদা পারভীন।
তপন বাগচী বলেন, "এই পুরস্কার দেওয়ার সময় ফরিদা পারভীনের কণ্ঠ বিজ্ঞানসম্মতভাবে একটি টুলস ব্যবহার করে ওই পুরস্কার কর্তৃপক্ষ দেখিয়েছিলেন যে বিশ্বের সেরা সংগীতশিল্পীদের কাতারেই উনি।
"ফরিদা পারভীন সংগীতের একটি বড় ধারার সাধক। তিনি শুধু গান গাওয়া নয়, গানের স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি লালনের নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা অনেক দূর এগিয়েছিলেন। সেই পরিকল্পনা এখন কতটা বাস্তবায়ন হবে, তা জানি না। তার মত একজন গুণি মানুষকে শ্রদ্ধা জানাই।"
শ্রদ্ধা জানাতে এসে জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক চিত্রনায়ক উজ্জ্বল বলেন, "কিংবদন্তি একজন সংগীতশিল্পীকে হারালাম আমরা। এই শূন্যতাকে পূরণ করার জন্য আমাদেরকে সম্মিলিতভাবে সচেষ্ট হতে হবে।
"উনার কোনো রিপ্লেসমেন্ট হবে না। কিন্তু এমন গুণি শিল্পী যেন আমরা আরো পেতে পারি, তার জন্য সবাইকে নিয়ে পরিবেশ গড়তে হবে। শহীদ জিয়াউর রহমান নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শিশুদের প্রতিভাকে সামনে আনার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। বর্তমান সরকার নতুন কুঁড়ি আবার শুরু করেছে। শিশুদের নিয়ে আমাদের এরকম আরো কাজ করতে হবে।"
চলচ্চিত্র নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমন বলেন, "শিল্পচর্চা যে সাধনার বিষয়, এই ব্যাপারটা আমরা ভুলেই গেছি। ফরিদা পারভীন এমন একজন মানুষ, যিনি জীবনটা সাধনার মধ্যেই কাটিয়েছেন। ফরিদা পারভীন আজকে যে অবস্থানে এসেছেন, তা হওয়ার জন্য অন্তত ৫০ বছর পার করতে হয়েছে।
"আমি এখানে এসে এটাই কেবল ভাবছিলাম, যে আমাদের মহান মানুষগুলো আমাদের ছেড়ে একে একে চলে চলে যাচ্ছেন। আমাদের প্রজন্মের কেউ কি এমন উচ্চতায় কখনো যেতে পারব? এমন সাধনায় নিমগ্ন থাকা কি আমাদের মধ্যে আছে? ফরিদা পারভীনের কাজগুলো নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিত এবং তার ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে জানানোত জন্য তার কাজগুলো সংরক্ষণের উদ্যেগ নেওয়া উচিত।"
বৃষ্টি উপেক্ষা করেও ফরিদা পারভীনকে শ্রদ্ধা জানাতে যারা উপস্থিত হয়েছিলেন, তাদের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বক্তব্য দেন ফরিদা পারভীনের স্বামী বংশীবাদক গাজী আবদুল হাকিম।
তিনি জানান শহীদ মিনার থেকে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে। সেখানে বাদ জোহর জানাজার পর কুষ্টিয়ায় নিয়ে যাওয়া হবে কফিন। সেখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন ফরিদা পারভীন।
লালনের গানে এক জীবন
১৯৫৪ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর নাটোরে জন্ম নেওয়া ফরিদা বেড়ে ওঠেন কুষ্টিয়ায়। বাবা ছিলেন চিকিৎসক, মা গৃহিনী। সাংস্কৃতিক আবহে বড় হওয়া ফরিদার গানে হাতেখড়ি পাঁচ বছর বয়সে। বাবা-মায়ের উৎসাহে শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নেওয়া ফরিদার ইচ্ছা ছিল নজরুলসংগীতের শিল্পী হওয়ার। এগোচ্ছিলেনও সেই পথেই।
রাজশাহী বেতারে নজরুলগীতির শিল্পী হিসেবে গান গাইতে শুরু করেন ১৯৬৮ সালে। গেয়েছেন আধুনিক ও দেশের গানও। তরুণ বয়সে লালনের গান একরকম ‘উপেক্ষিতই’ ছিল তার কাছে। তবে সংগীতের অন্য সব ধারাকে পাশে সরিয়ে কীভাবে, কোন তাড়নায় তিনি লালনের গানে নিজেকে বিলিয়ে দিলেন সেই গল্প ফরিদা শুনিয়েছিলেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে।
ফরিদা বলেছিলেন, স্বাধীনতার বছরখানের পর কুষ্টিয়ার ছেঁউরিয়াতে দোল পূর্ণিমার উৎসবে গুরু মোকছেদ আলী তাকে অনুরোধ করেছিলেন লালনের গান গাইতে।
তার ভাষ্য ছিল, “তখন আমি খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললাম ঠিক আছে আমাকে একটা গান শিখিয়ে দেন।”
এরপর ‘বড় অনিচ্ছায় কেবল গুরুর মান রাখতে’ লালনের ‘সত্য বল সুপথে চল’ গান ফরিদা করেছিলেন।
ওই গানই তার শিল্পী জীবনের বাঁক বদলে দেয় ফরিদার। নিজের ভেতরে এক ধরনের ‘অনুরণন’ অনুভব করেন বলে ভাষ্য ছিল তার।
ফরিদা বলেছিলেন, “যেটা ঐশ্বরিক অনুরণন। আমি শান্তি পাচ্ছিলাম না। আমার মনে হল আমাকে এই গান আরও করতে হবে, এই গান শিখতে হবে। এরপর গুরু আমাকে একটা একটা করে গান শেখাতে লাগলেন। আর এভাবেই লালন গানের শুরু। এখন এই লালন ফকিরই আমাকে সবার প্রাণের মধ্যে উপস্থাপন করেছে। এই গান দিয়ে আমাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন বলেই সেদিন 'সত্য বল সুপথে চল' গানটি আমাকে দিয়ে করিয়েছিলেন।”
অনেকে তাকে লালনের গানের 'রানি বা সম্রাজ্ঞী' বললেও, এ ধরনের উপাধি পছন্দ করতেন না ফরিদা।
তার কথায়, “এসব আমি একদমই পছন্দ করি না। কেউ যদি লালনের বাণীগুলো অন্তর থেকে আত্মস্থ করতে পারে সে সামনের দিকে এগিয়ে যাবেন। এসব নাম দেওয়ার কোনো যুক্তি নেই।”
ফরিদা পারভীনের আক্ষেপ ছিল, নতুন প্রজন্ম ‘শুদ্ধভাবে লালন চর্চা করছে না’। লালনের গান উপস্থাপনার হালের প্রবণতাও ‘সঠিক নয়’ বলে তার ভাষ্য। তার মতে, হৃদয়ের গভীর উপলব্ধি থেকে লালন চর্চার কোনো বিকল্প হতে পারে না।
লালনের গান ছাড়াও ফরিদা পারভীনের গাওয়া বেশ কয়েকটি আধুনিক ও দেশের গান জনপ্রিয় হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে আছে ‘তোমরা ভুলে গেছ মল্লিকা দির নাম’, ‘এই পদ্মা এই মেঘনা’। বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রের গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন এই শিল্পী।
নানা রোগ সয়েও লালন চর্চায় নিবেদিত ছিলেন তিনি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে লালন চর্চা ছড়িয়ে দিতে প্রায় ১৬ বছর আগে ঢাকার তেজকুনি পাড়ায় প্রতিষ্ঠা করা 'অচিন পাখি সংগীত একাডেমি।
কিন্তু ফরিদা পারভীনের শারীরিক অসুস্থতা, প্রতিষ্ঠানের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়া এবং নিজস্ব ভবন না থাকায় এ প্রতিষ্ঠানটিও ধুকছে টিকে থাকার লড়াইয়ে।
লালনের গান গেয়ে ফরিদা কেবল নিজেই জনপ্রিয় হননি, এই সংগীতকে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চেও পৌঁছে দিয়েছেন। সংগীতের সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত রেখে পেয়েছেন একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ নানা সম্মাননা।
সংগীতাঙ্গনে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৮৭ সালে একুশে পদক পান ফরিদা পারভীন। ২০০৮ সালে জাপান সরকারের ‘ফুকুওয়াকা এশিয়ান কালচার’ পুরস্কার পান তিনি। সেরা প্লেব্যাক গায়িকা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৯৩ সালে।