Image description

একটা সময় ছিল, যখন সন্ধ্যা নামার আগেই টেলিভিশনের সামনে বসে যেত পরিবারের সবাই—চোখে-মুখে থাকত অপেক্ষা আর কৌতূহলের আলো। তখন বিটিভিই ছিল দেশের একমাত্র টিভি চ্যানেল। সেই একমাত্র জানালা দিয়েই ঘরে ঢুকত রঙিন এক জগৎ, আর সেই জগতের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল বিজ্ঞাপন। বিটিভির সেই স্বর্ণযুগে প্রচারিত বিজ্ঞাপনগুলো যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হঠাৎ ভেসে ওঠে, তখন অনেকেই যেন ফিরে যান নিজেদের শৈশব-কৈশোরে। বিশেষ করে নব্বইয়ের দশক বা একবিংশ শতকের শুরুর দিকের প্রজন্মের কাছে এই বিজ্ঞাপনগুলো জীবন্ত এক স্মৃতি।

বর্তমানে বিজ্ঞাপন মানেই যেন বিরক্তির বিরতি—ইউটিউবের স্কিপ বাটন অথবা টিভির রিমোট চেপে চ্যানেল বদলানোর তাড়না। অথচ এক সময় বিজ্ঞাপন ছিল নিজেই এক রকম বিনোদন। বিজ্ঞাপনগুলো ছিল নিজেই এক গল্প; তাতে ছিল গান, অভিনয় আর আবহসঙ্গীতে গাঁথা এক দৃষ্টিনন্দন নির্মাণ। সেই জিঙ্গেল, সেই সংলাপ, সেই হাসিমাখা মুখগুলো আজও মনে হলে বুকের ভেতর কেমন যেন করে ওঠে। এক মায়াবী শিহরণ জাগে—যাকে বলে নিখাদ স্মৃতিকাতরতা।

নব্বইয়ের দশকে বিজ্ঞাপন নির্মাতারা যেন প্রকৃত শিল্পী। মাত্র ত্রিশ সেকেন্ডে তারা বলতেন একটি গল্প—একজন মা সন্তানের জন্য বাজার থেকে বিস্কুট কিনছেন, কেউ গ্রামে ফিরছেন নতুন ফ্রিজ নিয়ে, কিংবা কোনো শিশু খাচ্ছে দুধমিশ্রিত চকলেট। প্রতিটি দৃশ্য ছিল জীবনেরই অনুবাদ। অভিনয় ছিল সাবলীল, সংলাপ ছিল হৃদয়স্পর্শী আর আবহসংগীত ছিল কালজয়ী।

বিটিভির বিজ্ঞাপন ব্যবস্থাপনায়ও ছিল কঠোর মান নিয়ন্ত্রণ। বিজ্ঞাপন তৈরি হতো পেশাদার নির্মাতাদের হাতে, জিঙ্গেলে কণ্ঠ দিতেন সময়ের সেরা শিল্পীরা। তখন বিজ্ঞাপন শুধু পণ্যের প্রচার ছিল না—ছিল মানুষের অনুভব, স্বপ্ন আর সম্পর্কের প্রতিচ্ছবি। 

৯০-এর দশকের সেই বিজ্ঞাপনগুলো এখন আর নেই। কিন্তু তাদের ছাপ মুছে যায়নি। সোশ্যাল মিডিয়ায় যখন কেউ পুরোনো কোনো বিজ্ঞাপন শেয়ার করেন, তখন হাজার হাজার মানুষ কমেন্টে ফিরে যান তাদের শৈশবে। কেউ লেখেন, “এইটা যখন চলত, আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি... মা পাশে থাকতেন।” কেউ বলেন, “বিকেলবেলা মাঠ থেকে এসে এইটাই দেখতাম, কখনো বিরক্ত লাগেনি।”

খ্যাতিমান শিল্পী নচিকেতার কণ্ঠে একটা বিজ্ঞাপন ছিল ইস্পাহানি মির্জাপুর চায়ের। অসাধারণ ছিল সেই বিজ্ঞাপন, মনকাড়া ছিল জিঙ্গেলের কিছু কথা। “বৃষ্টিদিন নাও ভাসে/ মন মাতে ইস্পাহানি চায়ের সাথে...।” বিজ্ঞাপনটি যেন এক গল্প। তাতে যেন ভেসে উঠেছিল বৃষ্টিদিনের গল্প। নৌকা করে মাছ ধরা। বর্ষাদিনে বসার ঘরে চায়ের সঙ্গে আড্ডা ইত্যাদি। সেই আবেগঘন জিঙ্গেল আজও বহুজনের হৃদয়ে উঁকি দেয়। চায়ের কাপ হাতে ঘরের উঠোনে বসে থাকা মানুষ, আর পাশে বসে থাকা পরিবার—চিত্ররূপকথার মতো মুহূর্তগুলো ভেসে ওঠে চোখে।

নচিকেতার জিঙ্গেলে একসময় জনপ্রিয় হয়েছিল ইস্পাহানি মির্জাপুর চায়ের বিজ্ঞাপন। ছবি: ভিডিও থেকে সংগৃহীত

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের এক পেইজ ‘নস্টালজিয়া’। তারা শেয়ার করেছে ইস্পাহানি চায়ের পুরোনো দিনের সেই বিজ্ঞাপন। সেখানে অসংখ্য মানুষ লিখেছেন তার ফেলে আসার স্মৃতির কথা, আগের দিনে বিজ্ঞাপনটি দেখার কথা। সেখানে কমেন্ট বক্সে একজন লিখেছেন, “২০০২-২০০৩ সালের স্মৃতি মনে পড়ে গেল। সেই সময় পড়ার টেবিলে বসে পাশের রুম থেকে রাত আটটা বাংলা সংবাদের পর বিটিভিতে এই বিজ্ঞাপনগুলোর শব্দ শুনা যেত।আহ কী যে অনুভূতি যা আজ ও মনের করিডর নাড়া দেয়।” অন্য একজন লিখেছেন “ অনেক প্রিয় ছিল এটা। নচিকেতার একটি নির্দিষ্ট ধরন আছে। ছোট্ট এটি জিঙ্গেল কিন্তু তাতেই তার নিজস্বতা বোঝা যায়।”

“তুমি চেয়ে আছ তাই, আমি পথে হেঁটে যাই” গানের সঙ্গে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল সিটিসেলের বিজ্ঞাপন। ছবি: ভিডিও থেকে সংগৃহীত

মোবাইল সেবাপ্রতিষ্ঠান সিটিসেল, যেটির মাধ্যমে দেশের মানুষ প্রথমবারের মতো মোবাইল ফোন ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছিল। সিটিসেলের একটা বিজ্ঞাপন ছিল, তাতে উঠে এসেছিল অত্যন্ত জনপ্রিয় গান—“তুমি চেয়ে আছ তাই, আমি পথে হেঁটে যাই।” পুরোনো দিনের সেই বিজ্ঞাপন দেখলে এখনো অনেকের মনে ভেসে উঠবে ফেলে আসা শৈশবের কথা।

বিটিভির সেই স্বর্ণযুগে নির্মিত ও প্রচারিত হয়েছিল অসংখ্য বিজ্ঞাপনচিত্র। তাদের মধ্যে অনেক বিজ্ঞাপনই হয়েছিল জনপ্রিয়, বিজ্ঞাপনের কথা কিংবা জিঙ্গেল তখন ফিরত মানুষের মুখে মুখে। সময়ের আবর্তনে বিজ্ঞাপনের ভাষা বদল হয়েছে, আঙ্গিক পরিবর্তন হয়েছে, তবে এখনও পুরোনো দিনের বিজ্ঞাপনগুলোকেই সেরা মনে করেন অনেকেই। কেননা, সেসব বিজ্ঞাপন মনে করিয়ে দেয় এক অন্য রকম জীবনের কথা, যখন ছোট ছোট মুহূর্তেই ছিল আনন্দ আর ভালোবাসার ছোঁয়া। 

আজকের ডিজিটাল দুনিয়ায় দাঁড়িয়ে পুরোনো দিনের সেই অনুভূতি হয়তো আর ফিরে পাওয়া যাবে না, কিন্তু স্মৃতির আয়নায় তারা এখনো ঝকঝকে রঙে জ্বলজ্বল করে। বিটিভির পুরোনো বিজ্ঞাপন মানে শুধু একটা প্রচারণা নয়, সেটা আসলে এক ইতিহাস, এক আবেগ, এক ভালোবাসা।