
নারীরা যখন পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হয়ে ওঠেন, তখন অনেক পুরুষের আত্মসম্মান ও মানসিক স্বাস্থ্য আক্রান্ত হয়। এমনটাই উঠে এসেছে বিবিসি‘র এক গবেষণাধর্মী প্রতিবেদনে। যেখানে বলা হয়েছে, বহু বছর ধরে সমাজে ধারণা প্রচলিত—পুরুষরাই হবে পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী। কিন্তু সময় বদলেছে। এখন অনেক নারীর আয় পুরুষ সঙ্গীর চেয়েও বেশি।
বলা হচ্ছে, সমাজের এই পরিবর্তন অনেক ক্ষেত্রে পুরুষদের মনে অস্বস্তি তৈরি করছে। তাদের আত্মসম্মান ক্ষুণ্ন হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে মানসিক চাপ।
একজন স্বামী বলেন, ‘স্ত্রী যখন উপার্জন বেশি করে, মনে হয় নিজের মর্যাদা কমে গেছে।’
আরেকজন জানান, ‘আমি একজন পুরুষ, অথচ ঘরে বসে থাকি। অনেকে ভাবে আমি হয়তো দুর্বল পুরুষ।’ তিনি পরিবারে একজনের কাছে ‘হাউস বিচ’ বলেও অপমান শুনেছেন বলে জানান।
এমন ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে। গবেষণা বলছে, পুরুষরা যখন স্ত্রীদের চেয়ে কম আয় করেন, তখন তাদের আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরে।
টাকার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ক্ষমতা:
গবেষকরা বলছেন, টাকা মানেই ক্ষমতা। যিনি টাকা উপার্জন করেন, তিনি পরিবারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাবশালী হন। তাই পুরুষরা যখন আয়হীন থাকেন কিংবা স্ত্রীর চেয়ে কম আয় করেন, তখন তারা নিজেকে ক্ষমতাহীন ভাবেন।
এটি তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অনেক সময় দাম্পত্য কলহ এবং বিচ্ছেদের ঝুঁকিও বাড়ে।
চাকরি না থাকলে পুরুষদের হতাশা বেশি:
পুরুষরা যখন কর্মহীন হন, তখন তাদের মধ্যে বিষণ্ণতার হার বেশি দেখা যায়। নারীদের চেয়ে পুরুষদের তুলনামূলক সামাজিক বা পারিবারিক যোগাযোগ কম। তাই কর্মহীন অবস্থায় তারা একাকীত্বে ভোগেন বেশি। বিশেষ করে যারা হুট করে চাকরি হারিয়ে ফেলেন, তাদের মানসিক চাপ তৈরি হয় বেশি।
গবেষণার ভয়ঙ্কর চিত্র:
সুইডেনের এক দশকের গবেষণায় দেখা গেছে, যখন স্ত্রী আয় বেশি করতে শুরু করে, তখন পুরুষদের মধ্যে মানসিক রোগের প্রবণতা বেড়ে যায়। নারীদের ক্ষেত্রেও এমন কিছু লক্ষণ দেখা যায়, তবে পুরুষদের মধ্যে এর হার বেশি—প্রায় ১১%।
গবেষক ডেমিড গেটিকও বলছেন, পুরুষরা এখনও মনে করেন, নারীদের চেয়ে অবশ্যই তাদের আয় বেশি হওয়া উচিত। পরিবারে কর্তৃত্ব ধরে রাখার জন্যও এমন মানসিকতা থাকে তাদের।
প্রতারণা ও সম্পর্ক ভাঙনের শঙ্কা:
আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব পুরুষের স্ত্রী বেশি উপার্জন করে, তাদের মধ্যে পরকীয়ার প্রবণতা বেশি।গবেষকরা বলছেন, এটি পুরুষদের একটি ‘পুরুষত্ব রক্ষা’ করার কৌশল হতে পারে। তারা হয়তো নিজেদের নিয়ন্ত্রণ হারানোর প্রতিক্রিয়ায় এই পথ বেছে নেন।
পিতৃত্ব ও পরিবারের ভূমিকা:
যদিও কিছু পুরুষ আজকাল এমন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছেন। যুক্তরাজ্যে এখন অনেক বাবা নিজের কাজ কমিয়ে এবং পরিকল্পনা করেই সন্তানদের সঙ্গে বেশি সময় কাটান।
গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ঘরে থাকেন, তারা সন্তানদের বেশি সময় দেন। তবে ঘরের অন্যান্য কাজে তাদের অংশগ্রহণ এখনও নারীদের তুলনায় কম।
পুরুষত্বের নতুন সংজ্ঞা:
রাজনীতিবিদ রোজি ক্যাম্পবেল বলছেন, আমাদের স্কুলস্তরেই আলোচনা করা উচিত—পুরুষত্ব ও নারীবাদের প্রকৃত অর্থ কী। তিনি মনে করেন, পুরুষদের সামনে এমন রোল মডেল থাকা প্রয়োজন, যারা একাধারে যত্নশীল, দায়িত্ববান ও সহানুভূতিশীল।
অস্ট্রেলিয়ার গবেষক কার্লা এলিয়ট বলেন, ‘যত্নশীলতা এখন নতুন পুরুষত্বের অংশ। পুরুষরা যত বেশি এই দায়িত্ব গ্রহণ করবে, ততই সমাজে সমতা বাড়বে।’
সমাধান কী?:
অনেকে মনে করেন, নীতিগত পরিবর্তনের পাশাপাশি আমাদের মানসিকতায় পরিবর্তন আনা জরুরি। পুরুষরা যদি স্ত্রীর আয়ে নিজের আত্মসম্মান হারায়, তাহলে প্রশ্ন তোলা উচিত—কেন এমনটা অনুভব হচ্ছে? কারণ পরিবারে নারী ও পুরুষের সমান অংশগ্রহণ থাকা জরুরি। উপার্জনের ক্ষেত্রে কারও কম বা বেশি হতেই পারে। তাই নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগার সুযোগ নেই।
আত্মসমালোচনা ও সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমেই পুরুষরা নিজেদের ভূমিকা নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারবেন। বিশেষ করে সন্তানদের সামনে এমন দৃষ্টান্ত তৈরি করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে সমান দায়িত্ব গ্রহণের মানসিকতা তৈরি হয়।