Image description

এখন বৈশাখ মাস চলছে। সময়টা এমন যে, কখনও বৃষ্টি আবার কখনও চড়া রোদ। আর এই ভ্যাপসা গরমে জীবন একেবারে নাজেহাল। তীব্র গরমের কারণে অতিরিক্ত ঘাম তৈরি হয়, ফলে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। একই সাথে শরীরে সোডিয়াম ও পটাশিয়ামের ঘাটতি থেকে হিটস্ট্রোকের মতো বিপত্তি দেখা দিতে পারে, যা বাড়াতে পারে হৃদরোগের ঝুঁকি। আবার গরমের দিনে বদহজম, ডায়রিয়া, বমি, কলেরা ইত্যাদি হজমজনিত জটিলতা বেশি হয়, যা রক্তচাপ তথা হার্টের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।

রক্তচাপের পরিবর্তন হলে বা হৃদ্স্পন্দন অনিয়মিত হতে শুরু করলেই হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। আবার ধমনি ব্লক হয়ে গেলে অক্সিজেনযুক্ত পরিশুদ্ধ রক্ত হার্টে পৌঁছাতে পারে না, ফলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ে। তার উপরে কর্মব্যস্ত জীবনের বাড়তে থাকা মানসিক চাপ এবং চাপা উদ্বেগও হৃদরোগের অন্যতম কারণ। গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের অকালমৃত্যু হয় তার অন্তত চার ভাগের এক ভাগের মৃত্যুর জন্যে দায়ী হৃদ্‌রোগ, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব।

মানুষের শরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলো হার্ট। বয়স বাড়ার সাথে সাথে হার্টের যত্ন নেওয়া আরও জরুরি। অবশ্য এখন যেকোনো বয়সেই হতে পারে হার্টের সমস্যা। তাই গরমকালে যারা ইতিমধ্যে হৃদ্‌রোগে ভুগছেন অথবা যাদের হৃদরোগের ঝুঁকি রয়েছে তাদের স্বাস্থ্যের বিশেষ যত্ন নেওয়াটা খুবই দরকারি।

নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে এবং অবহেলা না করে প্রাথমিক অবস্থাতেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। গরমে ক্লান্ত লাগলে ভারী শরীরচর্চা না করলেও সন্ধ্যার পর হাঁটাহাঁটি করতে হবে। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের মতে, দিনে ৩০ মিনিট হাঁটলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমানো যায়। প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টার কম ঘুমালে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ডিপ্রেশনের মতো ক্রনিক অসুখ হতে পারে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

পাশাপাশি মানসিক চাপ কমাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ধূমপান ও মদ্যপান অভ্যাস থাকলে তা ত্যাগ করতে হবে। হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে অবশ্যই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। পুরুষের কোমর যদি ৩৭ ইঞ্চি আর নারীর কোমর ৩১ দশমিক ৫ ইঞ্চির বেশি হয় তাহলে ওজন কমাতে হবে।

গরমের দিনে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে। শরীরের তাপমাত্রা যত স্বাভাবিক থাকবে হিটস্ট্রোকের ঝুঁকিও তত কমবে। এই সময়ে চা, কফি, কোমল পানীয় ইত্যাদি একদম কম খাবেন। এগুলো শরীরে পানির পরিমাণ আরও কমিয়ে দেয়।

গরমে যত হালকা খাবার খাবেন, ততই হার্টের জন্য ভালো। অতিরিক্ত মসলাদার বা গুরুপাক খাবার হজমে সমস্যা তৈরি করতে পারে। মাছ, মাংস, দুধ, ডিম যাই খান পাশাপাশি বেশি পরিমাণে শাকসবজি ও ফলমূল অর্থাৎ ফাইবারযুক্ত খাবার খেতে হবে। খাবারের ফাইবার কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমাতে সাহায্য করে, তাই হৃদরোগের ঝুঁকি কমে।

স্যাচুরেটেড ফ্যাট বা জমাটবাঁধা চর্বি জাতীয় খাবার কম খেতে হবে। কারণ এসব খাবার শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। উচ্চমাত্রায় স্ট্যাচুয়েটেড ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবারগুলো হল বিভিন্ন প্রকার লাল মাংস, পূর্ণ চর্বিযুক্ত দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য, মাখন, নারকেল তেল, আইসক্রিম, বেকারির খাবার। এছাড়াও ট্রান্সফ্যাট সমৃদ্ধ খাবারও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। ট্রান্সফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার হলো বিভিন্ন রকম বেকারিপণ্য যেমন– কেক, কুকিজ, উচ্চমাত্রায় প্রক্রিয়াজাত খাবার যেমন–চিপস, ফ্রোজেন খাবার, ভাজাপোড়া খাবার, ফাস্টফুড যেমন– ফ্রাইড চিকেন, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, ডালডা দিয়ে তৈরি বিভিন্ন খাবার।

তাই হৃদ্‌রোগ নিয়ন্ত্রণে আনসাচুয়েটেড ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে। এসব খাবারের মধ্যে রয়েছে, তেল সমৃদ্ধ মাছ, বাদাম ও বীজ। এছাড়া অলিভ, কেনলা, সানফ্লাওয়ার, রাইস ব্রাইন অয়েল ইত্যাদি স্বাস্থ্যসম্মত। দুধের বেলায় স্কিমড বা সেমি-স্কিমড (দুধ থেকে চর্বি সরিয়ে নেওয়া) দুধ খেতে হবে। লাল মাংসের বদলে চামড়া বাদে মুরগির মাংস খাওয়া যেতে পারে। গরুর মাংস বা খাসির মাংস খেলে তার উপর থেকে চর্বি ফেলে দিয়ে রান্না করতে হবে। সপ্তাহে অন্তত একদিন তৈলাক্ত সামুদ্রিক মাছ খেতে হবে।

বাড়তি লবণ খাওয়া যাবে না। করণ লবণ বেশি খেলে শরীরে রক্তচাপ বেড়ে যায়, ফলে বৃদ্ধি পায় হৃদ্‌রোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকিও। একজন প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৫ গ্রাম (এক চা চামচের পরিমাণ) লবণ খেতে পারেন। লবণ কম বা বেশি খাওয়া একটি অভ্যাসের ব্যাপার। এই অভ্যাস বদলাতে মাত্র চার সপ্তাহের মতো সময় লাগে। লবণ যতো কম খাওয়া হবে তার চাহিদাও ততো কমে যাবে।

ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে, যা আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং পটাশিয়াম উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ করে। তাই প্রতিদিন অন্তত পাঁচটি ফল বা সবজি খাওয়া উচিত। হার্টের স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য কিছু খাবার খাদ্য তালিকায় রাখতেই হবে। ভিটামিন ই থাকে বাদাম ও বীজ জাতীয় খাবারে। ভিটামিন বি থাকে মাছ, দুগ্ধজাত খাবার ও হোলগ্রেইনে। পটাশিয়াম থাকে কলা, আলু এবং ডালে। ম্যাগনেসিয়াম থাকে ডাল ও হোলগ্রেইনে। ক্যালসিয়াম থাকে দুগ্ধজাত খাবারে,সবুজ পাতাযুক্ত শাকসবজিতে, মাছ ও সামুদ্রিক খাবারে।

লেখকনিউট্রিশন অফিসার, ন্যাশনাল হেলথকেয়ার নেটওয়ার্ক, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি