সুপ্রিয় পাঠক, আপনি যদি দেখেন ঘোর বর্ষায় পুকুরের বাঁধানো ঘাটের সিঁড়িতে আপনার বিবেক স্তম্ভিত বসে আছে, তখন আপনার কণ্ঠে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কি একটি শব্দ বেরিয়ে আসবে না, যে শব্দটি বেরিয়ে এসেছে মাহবুবুল হক শাকিলের ফেসবুকের স্ট্যাটাসে? Ñ ‘ছিঃ!’ সুপ্রিয় পাঠক, যদি আপনি দেখেন মূল্যবোধের প্রতীক সন্তানের হাতে নির্মমভাবে প্রহƒত হয়ে বিপন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, তখন কি আপনার কণ্ঠ থেকে ঘৃণা উদ্গীরিত সেই শব্দটি বেরিয়ে আসবে না, যা এককালের অত্যন্ত তুখোড় ছাত্রনেতা মাহবুবুল হক শাকিলের ফেসবুকের স্ট্যাটাসে অত্যন্ত তীক্ষèভাবে বেরিয়ে এসেছিল? - ‘ছিঃ!’
এ শব্দটি এখন আর শাকিলের একার শব্দ নয়, আমার শব্দ, আমাদের শব্দ। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ঘটনা ঘটল ক’দিন আগে, তা চুপচাপ মেনে নেয়ার কি কোনো যুক্তি আছে? পত্রপত্রিকার খবরে, টেলিভিশনের খবরে এবং কথাবার্তায় যাদের দুষ্কর্মের কাহিনী ফলাও করে কয়েক বছর ক্রমাগত বেরিয়ে চলেছে এবং যার মাত্রা বাড়তে বাড়তে রীতিমতো অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে, তাদের ব্যাপারে আমরা কি কেবল ক্ষোভ প্রকাশ করেই ক্ষান্ত থাকব? এটা হয় না, হতে পারে না, এটা চলতে পারে না। এই জাফর ইকবাল তাঁর জীবনের স্বর্ণময় মুহূর্তগুলো নিবেদন করেছেন ছাত্রদের কল্যাণে, তরুণ প্রজšে§র মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মশাল জ্বালিয়ে তাদের মনের জমাটবাঁধা অন্ধকার দূর করার মহান ব্রত নিয়ে পথ চলছেন অত্যন্ত বলিষ্ঠকণ্ঠে ‘জয়বাংলা’ সেøাগান উচ্চারণ করেÑ সেই জাফর ইকবাল ও ইয়াসমিন হককে কেন ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি শুনে শঙ্কিত হতে হবে? আমরা কেন এবং কাদের কারণে ভয় পেতে থাকব ছাত্রলীগকে, ভয় পেতে থাকব ‘জয়বাংলা’ সেøøাগান ধ্বনিকে? কেন এবং কারা ছিনতাই করল ছাত্রলীগ নামের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটিকে, কারা লুণ্ঠন করে ফেলল ‘জয়বাংলা’ সেøাগানটিকেও?
ছাত্রলীগের নেতাদের যিনি বা যারা যখন নেতৃত্ব পদে থাকেন, তারা একটি মধুনিঃসৃত বাণী আমাদের নিয়মিত শোনান যে, দুর্বৃত্তদের কোনো দল নেই কিংবা আমরা সন্ত্রাসকে প্রশ্রয় দেই না বলেই অনেককে দল থেকে বহিষ্কার করেছি কিংবা আইনের হাতে সোপর্দ করেছি। গত সাতটি বছর এই বাণী শুনতে শুনতে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি এবং দেখছি ধ্বংসের নৃশংস দূত শুধু অস্ত্রের মহড়া কিংবা চাঁদাবাজির মধ্যেই আটকে থাকছে না, ওরা শাবল আর গাঁইতি দিয়ে ছাত্রলীগের ঐতিহ্য এবং ভাবমূর্তির ভিতটিকে পর্যন্ত উপড়ে ফেলার চেষ্টা করে চলেছে। এসব ব্যাপারে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-মন্ত্রী উদ্বিগ্ন হয়েছেন, স্বয়ং সাধারণ সম্পাদক পর্যন্ত উষ্মা প্রকাশ করে পরিণতির ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক সঙ্কেত উচ্চারণ করেছেন। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়নি। শেষ পর্যন্ত দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা কঠোর মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ থেকে আগাছা উপড়ে ফেলার। কিন্তু তিনি তো এই সতর্কবাণী প্রথমবারের মতো উচ্চারণ করেননি। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় এসে তিনি বলেছিলেন, আমরা ছাত্রদের হাতে বই তুলে দিতে চাই। সে সময়ও তিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন লেখাপড়ার ওপর, জ্ঞান বিকাশের ওপর। এরপর এত বছর ধরে তো বার বার একই কথা বলেই যাচ্ছেন তিনি। কিন্তু কী লাভ হচ্ছে? প্রধানমন্ত্রী তো এ কথাও বলেছিলেন যে, আওয়ামী লীগের মধ্যে যাতে ছদ্মবেশীদের প্রবেশ না ঘটতে পারে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে মূল প্রবেশদ্বারটি বন্ধ থাকলেও খিড়কি দরজা রাখা হয়েছে উন্মুক্ত। এর ফলে যা স্বাভাবিক তাই তো হচ্ছে।
ট্রয় নগরীর পতন হয়েছিল কাঠের ঘোড়া নগরীর মধ্যে ঢোকানোর কারণে। সেই কাঠের ঘোড়ার ভেতরে লুকিয়ে থাকা দুর্ধর্ষ শত্রুসৈন্যরা ঘুমন্ত ট্রয়বাসীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পেরেছিল সহজে। কাহিনী বলে, যারা সেই বিশাল কাঠের ঘোড়া টেনে নিয়ে গিয়েছিল নগরীর ভেতরে তাদের ধারণাই ছিল না এর ভেতরে কী ভয়ঙ্কর মৃত্যুদূত লুকিয়ে আছে। ছাত্রলীগ, যুবলীগ কিংবা আওয়ামী লীগের লক্ষ লক্ষ সাধারণ নিরীহ কর্মী হয়তো ধারণাই করতে পারছে না যে, সুকৌশলে শত্রুরা কতিপয় বিশালাকৃতির ট্রয়ের ঘোড়া বানানোর আয়োজন করছে এবং সেইসব ঘোড়া ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগের দুর্গপ্রাচীরের অভ্যন্তরে পাঠানোর জন্য গুপ্ত বাহিনী নিয়োগ করার ব্যবস্থা করছে। আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা দল এবং এর অঙ্গ সংগঠনগুলোর ভেতর থেকে আগাছা উপড়ে ফেলার নির্দেশ দেয়ার ঘণ্টাতিনেকের মধ্যে চারজন ছাত্র নেতাকে বহিষ্কার করা হলো। এই উদ্যোগকে প্রশংসা করে বলা যায় এ রকম অনেক বহিষ্কার তো অতীতেও করা হয়েছে, বরং বলা যায় অন্য যে কোনো রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠনের মধ্যে অবস্থানকারী দুষ্কৃতদের বিরুদ্ধে সেইসব দলের পক্ষ থেকে যে ব্যবস্থা নেয়া হয়ে থাকে আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনগুলোর অপকর্মকারী সদস্যদের বিরুদ্ধে কয়েকগুণ বেশি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু তাতে কি ওরা ক্ষান্ত কিংবা হতোদ্যম হয়েছে?
তাহলে খুঁজতে হবে সমস্যাটা কোথায়? যত দিন যাচ্ছে ততই ওরা কেন বেপরোয়া এবং অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে? ওরা বাড়তে বাড়তে কি এমনই পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে, শেষ পর্যন্ত শিক্ষকরাও তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি! আমার স্পষ্ট মনে আছে দুটো ঘটনার কথা। প্রথম ঘটনা ষাটের দশকের একদম শুরুতে। সেকালের ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথ কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল ছিলেন প্রফেসর এইচ পি রায় বা হরি প্রসন্ন রায়। সে সময় আইয়ুবের সামরিক শাসন প্রবলভাবে জেঁকে বসেছিল। সামরিক গোয়েন্দারা খুঁজে বেড়াচ্ছিল আইয়ুব-অনুগত সুবিধাবাদী ছাত্রদের। এই ধরনের এক উঠতি স্বঘোষিত ছাত্রনেতা হঠাৎ কুৎসিত সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করে বসল অতিশ্রদ্ধেয় অধ্যাপক এইচ পি রায়কে লক্ষ্য করে। এই ঘটনা মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে গেল জগন্নাথ কলেজের ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে। তখন প্রিন্সিপাল ছিলেন প্রয়াত আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দিনের পিতা শরফুদ্দিন আহমদ। আইয়ুবভক্ত সেই কথিত ছাত্রনেতা তো বহিষ্কৃত হলোই, এমনকি জগন্নাথ কলেজের ত্রিসীমানায়ও তাকে আর কোনোদিন দেখা গেল না। আর একটি ঘটনা ঘটেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. আবু মাহমুদের ওপর আইয়ুব অনুগত এনএসএফ বা আইয়ুব-মোনায়েম সৃষ্ট পেটোয়া ছাত্র সংগঠন ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফ্রন্টের গু-াবাহিনীর হামলা নিয়ে। এই ঘটনায় শুধু ছাত্রসমাজই উত্তাল হয়েছিল তাই নয়, নিন্দামুখর হয়েছিল রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবীসমেত সর্বমহল।
আমার ছাত্রজীবনের এই দুটি ঘটনার উল্লেখ এই কারণেই করলাম যে, শিক্ষক যে সমাজের সবচাইতে মর্যাদাবান অঙ্গÑএই বোধের পুনর্জাগরণ প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। আমার আশঙ্কা, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন শিক্ষকের সংখ্যা তো ক্রমান্বয়ে সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে। কমে আসছে ড. আনিসুজ্জামান, ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালদের মতো প্রতীকদের সংখ্যা। সেই পাকিস্তানী আমলে উপাচার্য পদটি প্রথম রাজনীতি দ্বারা কলুষিত করেছিলেন ড. এমও গণিÑযেজন্য তিনি আজ বিস্মৃত। ছাত্রদের একাংশকে ব্যবহার করে ক্ষুদ্রস্বার্থ চরিতার্থ করার ফলে ছাত্রসমাজে সেই যে সুদীর্ঘ ক্ষতির সূত্রপাত ঘটেছিল, এখন কি তা বিশাল মহীরুহে পরিণত হতে চলল? জাফর ইকবাল, ইয়াসমিন হকরা তাঁদের ক্ষীণশক্তি দিয়ে প্রাণপণে অনৈতিকতার পাহাড় সরানোর চেষ্টা করছেন বটে, কিন্তু এ কাজ সহজতর হবে যদি নীতিজ্ঞানসম্পন্ন মানুষরা তাঁদের পাশে দাঁড়ান।
আমি ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষকতা পেশার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। হয়তো প্রাচীন আমলের মানুষ বলেই আমি মনে করি যিনি এই পেশার সঙ্গে নিজেকে স্বেচ্ছায় সংযুক্ত করেন তিনি মানুষ গড়ার ব্রত হƒদয়ে ধারণ করেনÑ এই সত্যটিই বিশ্বাস করে এসেছি আমার এই দশ সপ্তক জীবনে। আজ যাঁরা শিক্ষকতা পেশায় আনুষ্ঠানিকভাবে অবস্থান করছেন তাঁদের প্রায় সকলেই বয়সের বিচারে আমার অনুজতুল্য হলেও পেশাগত কারণে আমার শ্রদ্ধেয়। কাজেই যখন শুনি কোনো কোনো ছাত্রকে কেউ কেউ নিজের স্বার্থসিদ্ধির সোপান হিসেবে ব্যবহার করছেন, তখন তাঁর প্রতি আর শ্রদ্ধা দেখাতে পারি না। আমি কল্পনা করতে পারি না কোনো শিক্ষকের কাছে আত্মসম্মান, ছাত্র কিংবা সহকর্মীদের অনাস্থার চাইতে পদ কিংবা পদবি অধিকতর আরাধ্য হতে পারে।
তবে আমি হতাশ নই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সবকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে (আমি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলছি) অনেক শিক্ষক আছেন যাঁরা আমাদের আশার প্রদীপ এখনো জ্বালিয়ে রেখেছেন। তাঁদের কাছে আমার বিনীত নিবেদন, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন শিক্ষকতা পুনঃপ্রবর্তনে একত্রিত হোন। শিক্ষক যদি প্রশ্রয় না দেন, তাহলে ছাত্র নষ্ট হতে পারে না। জাফর ইকবালের মতো আমিও বিশ্বাস করি শিক্ষাঙ্গনে কেউ নিজেকে ধ্বংস করতে আসে না, গড়তে আসে।
এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন ড. মাহমুদ হোসেন। তিনি ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. জাকির হোসেনের অনুজ। মুসলিম লীগ সরকারের আমলেও ড. মাহমুদ হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে পুলিশকে প্রবেশ করতে দেননি। ছাত্রদের স্বার্থকে তিনি অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন, মুক্তচিন্তার আবহ সৃষ্টি করেছিলেন, মেধার উৎকর্ষসাধনে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন।
এতোসব উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত থাকার পরেও কেন আমাদের জাফর ইকবালের গলায় দড়ি দিয়ে মরার ইচ্ছে ব্যক্ত করতে হবে? কেন এককালের মেধাবী ছাত্রনেতা মাহবুবুল হক শাকিলকে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে ‘ছিঃ’ শব্দটি লিখতে হবে? কেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বারংবার কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করতে হবে? এই নোংরা সংস্কৃতির উৎপাটন কি এতই কঠিন?
লেখক : সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন