জঙ্গি নাটক ও আলী আজমের ডাণ্ডাবেড়ি
31 December 2022, Saturday
সরকার আবারো জঙ্গি ইস্যু সাজাবার চেষ্টা করছে। এর আগে ২০১৩ সালে জঙ্গি নাটক সাজিয়ে ভালোই ফল পেয়েছিল তারা। সেই সূত্র ধরে অনেক মানুষকে ক্রসফায়ারে দেয়া হয়েছিল। সেসব ক্রসফায়ারের কোনো জবাবদিহি নেই। কিন্তু ক্রমেই সারা পৃথিবীর গণতান্ত্রিক সমাজগুলো বুঝতে পারছিল যে, জঙ্গি দমন আসলেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার সরকারি একটি অস্ত্র। তখন পৃথিবীতে ইসলামের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের কাল। ফলে প্রথম দিকে বিশ্বব্যাপী বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিল।
সরকার টুপি-দাড়িওয়ালাদের ধরে বলছিল, এ হলো জঙ্গি। যাদেরকে টেলিভিশনের সামনে দেখানো হয়েছে তাদের কেউ কেউ ফিনিশ। কেউ কেউ আহতাবস্থায় জেলের ঘানি টানছেন। সে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল বাংলাদেশে। জঙ্গি দমনের নামে কার্যত মুসলিম আলেম-ওলামাদের নানাভাবে গুম, খুন করা হচ্ছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বরাবরই দাবি করে আসছিল যে, যারা খুন হয়েছে বা যাদের ক্রসফায়ারে দেয়া হয়েছে তাদের প্রায় সবাই পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছিল। পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি চালিয়ে ছিল। তাতে একজন বা একাধিক ‘জঙ্গি’ নিহত হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সাধারণ যুক্তি ছিল এই যে, তারা প্রথমে জঙ্গিকে গ্রেফতার করে তার পর তার বর্ণনা অনুযায়ী ‘অস্ত্র উদ্ধারের জন্য’ নিরিবিলি কোনো স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নাকি ওঁৎ পেতে থাকে ওই জঙ্গির সশস্ত্র সহকারীরা। তারা অতর্কিতে পুলিশের ওপর গুলি চালায়। সেই গুলিতে আটক কথিত জঙ্গি নিহত হয়।
আশ্চর্যের বিষয় এই যে, কথিত জঙ্গি ছাড়া সেই ঘটনায় আর কেউ হতাহত হয় না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। যদিও মাঝে মধ্যে তাদের তরফ থেকে বলা হয় যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অত জন সদস্য আহত হয়েছে। কিন্তু সেই আহতদের বিস্তারিত বিবরণ কখনো পাওয়া যায় না। কিন্তু এটা কি করে সম্ভব যে, এত গোলাগুলি হলো শুধু আটক ব্যক্তি কেন নিহত হলো। সরকারি ভাষ্য এই যে, পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি চালিয়েছিল। দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী এমন কথা পর্যন্ত বলেছেন যে, আক্রান্ত হলে পুলিশ গুলি করবে না তো কি বসে বসে আঙুল চুষবে? এই হলো সরকারের মনোভঙ্গি অথচ পুলিশ যে কাউকে অনুমানের ভিত্তিতে গুলি করে হত্যা করতে পারে না, সেটা পুলিশ কোডেও লেখা আছে। পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে রাখার জন্য পুলিশ নানা ধরনের গল্প ফাঁদে।
এর আগেও আমরা দেখেছি, বিএনপি নাকি দেশব্যাপী শ’ শ’ ককটেল ফুটিয়েছে। সেই অভিযোগে বিএনপির বহু নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদেরকে যাতে পাইকারিভাবে গ্রেফতার করা যায় সে জন্য অভিযুক্তদের নামের সাথে আরো দুই শ’ থেকে তিন শ’ লোকের কথা উল্লেখ করা হয়। যাতে ওই মামলায় সংশ্লিষ্টতা দেখিয়ে যে কাউকে পুলিশ যখন তখন গ্রেফতার করতে পারে।
এর আগে আমরা এ ধরনের অনেক বিবরণ ছেপেছি। তবুও এরকম ঘটনা ঘটেই চলেছে। এরকম একটি ঘটনা কালিয়াকৈরের আলী আজমের গ্রেফতার। গত ২ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে ককটেল হামলার অভিযোগে বিএনপি নেতা আলী আজমকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এই মামলায় ১১ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয় আরো দেড় শ’ জনকে। অথচ সরেজমিন তদন্তে দেখা যায়, যে এলাকায় ককটেল বিস্ফোরণের কথা বলা হয়েছে, সেখানে এমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি। কেউ বিস্ফোরণের শব্দও শোনেনি। পুলিশ মামলায় বাদি করে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের অফিস সহকারী আবদুল মান্নান শেখকে। তিনি ওই সময় একটি পত্রিকাকে বলেন, ঘটনা ও মামলার বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। তিনি বলেছিলেন, ‘কসম আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম না। ওখানে আলাউদ্দিন এসআই ছিল। ওই স্যার আমারে বারবার ফোন দিয়া অস্থির কইরা ফেলছে। আমি বলছি, স্যার আমি দাওয়াতে আছি, আমি দাওয়াতে থাইকা মামলা করলাম কিভাবে। আমি ছিলামও না, দেখিও নাই। স্যারেগো আমি কইছিলাম, স্যার আমারে আপনারা ঝামেলায় ফালাইয়েন না।’
এই আলী আজম সরকারের গায়েবি মামলার আসামি ছিলেন। তার মা বার্ধক্যজনিত কারণে গত ১৮ ডিসেম্বর ইন্তেকাল করেন। তার মায়ের লাশ শেষবারের মতো দেখতে এবং জানাজায় অংশ নিতে তিনি আইনজীবীর মাধ্যমে গত ১৯ তারিখ প্যারোলে মুক্তির আবেদন করেন। সে আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ২০ ডিসেম্বর তাকে তিন ঘণ্টার জন্য প্যারেলে মুক্তি দেয়া হয়। কিন্তু আলী আজমকে পুলিশ তার বাড়িতে নিয়ে আসে হাতকড়া ও ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে। তার ভাই নামাজে জানাজা পড়ানোর সময় আলী আজমের হাতকড়া ও ডাণ্ডাবেড়ি খুলে দিতে পুলিশকে অনুরোধ করেন। কিন্তু পুলিশ খুলে দেয়নি। সে অবস্থায়ই তিনি জানাজা স্থলে আসেন এবং হাতকড়া ও ডাণ্ডাবেড়ি পরেই জানাজায় নামাজ পড়ান। এ ঘটনায় সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হলেও সরকারের তরফে কোনো দুঃখ প্রকাশ করা হয়নি।
ডাণ্ডাবেড়ি সাধারণত পরানো হয় দুর্ধর্ষ বা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের। কিন্তু আলী আজমের মামলাটি ছিল নিছক গায়েবি মামলা। তাকে প্যারোলে আনতে কেন হাতকড়া ও ডাণ্ডাবেড়ি পরানো হলো। সে সম্পর্কে পুলিশের ভাষ্য হলো এর আগে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই দুর্ধর্ষ আসামিকে ছিনিয়ে নেয়া হয়। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে মোটরসাইকেলে চড়ে এলাকা থেকে পালিয়ে যান। সেই কারণে আলী আজমকে হাত কড়া ও ডাণ্ডাবেড়ি পরানো হয়েছিল। আলী আজম কোনো দুর্ধর্ষ বা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছিলেন না। তার পরও কেন এই ডাণ্ডাবেড়ি?
এর আগে গত ২০ নভেম্বর আদালতে আনা হয়েছিল দু’জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে। সেখানে তারা ডাণ্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় ছিল না। ওই দুই আসামির সহযোগীরা পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে আসামিদের ছিনিয়ে নেয় এবং তারা মোটরসাইকেলে চড়ে এলাকা ত্যাগ করে। আজ পর্যন্ত তাদের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। তাদের কেন ডাণ্ডাবেড়ি না পরিয়ে আদালতে হাজির করা হলো। এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। কেউ কেউ বলছেন, ঘটনাটি সাজানো ছিল কি না? সেটিও এক প্রশ্ন। নিয়ম অনুযায়ী একজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে আদালতে হাজির করতে কমপক্ষে চারজন কনস্টেবল মোতায়েন করার কথা । কিন্তু তা কেন করা হয়নি সেটি এখনো অস্পষ্ট।
কেউ কেউ মনে করেন, দেশব্যাপী আবার তথাকথিত ‘জঙ্গিবিরোধী’ অভিযান পরিচালনার জন্যই এ ধরনের শিথিল ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল, যাতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা নির্বিঘ্নে পালিয়ে যেতে পারে। তার পর জঙ্গি উদ্ধার অভিযানের নামে সরকার বিরোধীদের ওপর হামলে পড়তে পারে। আলী আজমের ঘটনা থেকে সেটিই প্রমাণিত হলো।
এর মধ্যে আরো ঘটনা ঘটেছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস গত ১৪ ডিসেম্বর নিখোঁজ বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলামের বাসভবনে তার পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। সাজেদুল ইসলামের বোন গুম হওয়া পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গঠিত ‘মায়ের ডাক’ নামে একটি সংগঠনের সমন্বয়কারী। কিন্তু পিটার হাস ওই বাড়িতে গিয়ে যখন কথাবার্তা বলছিলেন তখন আওয়ামী লীগের লোকেরা ‘মায়ের কান্না’ নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে সেখানে সমবেত হন। সে সময় পিটার হাসের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তার স্বার্থে তাকে সেখান থেকে চলে যেতে বলেন। পিটার হাস দ্রুতই ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। তার গাড়িতে আঁচড়ও লাগে।
সাজেদুল হকের বাড়ি থেকে পিটার হাস সরাসরি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের সঙ্গে দেখা করেন এবং তার নিরাপত্তার বিষয়ে আলোচনা করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিষয়টাকে হেসেই উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন, পিটার হাস তাকে না জানিয়ে সাজেদুল হকের বাসায় গিয়েছিলেন। তাহলে তিনি যে সেখানে যাবেন সে ঘটনা ফাঁস হলো কিভাবে? সাজেদুল হকের পরিবার জানিয়েছে, দুই দিন আগে থেকেই পুলিশ তাদের বাসা ও গোটা এলাকা রেকি করে। তাহলে তার এ সফরের খবর ফাঁস হওয়া সম্পর্কে দূতাবাসকে দোষারোপ করার মনোবৃত্তি কেন? দুই দিন ধরে পুলিশ এলাকা রেকি করলে এটা কি আর জানাজানি হওয়ার বাকি থাকে। এ ঘটনায় মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু ওয়াশিংটনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো: ইমরানকে ডেকে ঢাকায় অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের বিষয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়েন্ডি শেরম্যান কথা বলেন। তিনি বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন দূতাবাসের কর্মীদের নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করেন। একই সাথে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার তাগিদ দেন। এই তাগিদ পশ্চিমা সব দেশেরই। এর আগেও মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের ওপর হামলা চালিয়েছিল আওয়ামী লীগ। তিনি ইকবাল রোডের একটি বাড়িতে নৈশ্যভোজে অংশ নিতে গিয়েছিলেন। সে মামলা এখনো চলছে।
যদিও ব্যর্থ তবু সরকার নতুন করে পশ্চিমাদের সহানুভূতি আদায়ের জন্য জঙ্গি খেলা শুরু করেছে। কাউকে কাউকে এমন সব ‘জঙ্গি’ সংগঠনে সংশ্লিষ্ট বলা হচ্ছে, সে রকম সংগঠনের নামও কেউ কখনো শোনেনি। এরই ধারাবাহিকতায় গ্রেফতার করা হয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা: শফিকুর রহমানকে। অশীতিপর নেতাকে সরকার একাধিকবার রিমান্ডেও নিয়েছে। তার ছেলে ডা: রাফাত সাদিক সাইফুল্লাহকে জঙ্গি আখ্যা দিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছে। শফিকুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি তার ছেলের কর্মকাণ্ডে ইন্ধনদাতা। ধারণাকারী এসব ‘মিথ্যা’ অভিযোগে গ্রেফতার চলবে। তবে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে এক ঘাটে দু’বার স্নান হবে না। সরকারের অর্থনীতির অবস্থা যে মাত্রায় কাহিল বিশ্বসমাজ যেভাবে সচেতন তাতে এবারের জঙ্গি নাটক হালে খুব একটা পানি পাবে বলে মনে হয় না।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন