আওয়ামী লীগের রাজরাঙা সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মাঝে মধ্যে এমন সব সত্য কথা বলেন যে, আমরা সাধারণ মানুষরা একেবারে চমকে উঠি। গত মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, বিএনপি এমন একটি দল যাদের নেতাদের মুখে মধু অন্তরে বিষ। তাদের মুখে গণতন্ত্রের বুলি কিন্তু চর্চায় লুটপাট আর সুবিধাবাদ। তিনি বলেন, বিএনপি স্বাধীনতার কথা বলে কিন্তু লালন ও পোষণ করে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি ও পৃষ্ঠপোষকতা করে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে। তিনি বলেন, বিএনপি ভোটাধিকারের কথা বলে; অথচ ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটারবিহীন প্রহসনের নির্বাচন আর সোয়া এক কোটি ভুয়া ভোটার সৃষ্টি করেছিল। তাই তাদের মুখে কথা মালার মধু ছড়ালেও অন্তরে বিধ্বংসী বিষবাষ্প।
আলোচনাটা এখান থেকে শুরু করা যাক। সত্য কথা এই যে, বিএনপি নেতাদের মুখে মধু এটা না হয় তাদের কথায় বুঝা যায়; কিন্তু বিএনপি নেতাদের অন্তরে যে বিষবাষ্প আছে সেকথা কিভাবে বুঝা যায়? ধারণা করি, ওবায়দুল কাদের ইসলাম ধর্মের অনুসারী। মহান আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেছেন, তিনিই শুধু মানুষের অন্তরের কথা জানেন। ওবায়দুল কাদেরের কাছে নিশ্চয় কোনো ওহি নাজিল হয়নি। তাই বিএনপির অন্তরে যে বিষবাষ্প আছে সেটা তার দেখার কথা নয়।
তিনি বলেছেন, বিএনপির মুখে গণতন্ত্রের বুলি, চর্চায় লুটপাট ও সুবিধাবাদী। এ কথাও প্রমাণ করা বেশ কঠিন কাজ। আমরা তো সবাই দেখতে পারছি যে, বিএনপি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছে। আর লুটপাট করার সুবিধা তো তাদের নেই। কারণ গত ১৫ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের তৃতীয় চতুর্থ সারির নেতাকর্মীরা হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে বুক ফুলিয়ে চলাচল করে। বিদেশে পাচার করে। কাদের সাহেব সত্যবাদী হলে এখানে বলতেন তাদের কোন কোন নেতার বেগমপল্লীতে বাড়ি আছে। তারা সেখানে কিভাবে চলে, কী করে, কী খায়। সে কথা তিনি বলেনি। আওয়ামী লীগের এই শাসন-সময়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়েছে। পাঁচ টাকার সিরিঞ্জ ৫০০ টাকায় কেনা হয়েছে। নিচতলা থেকে তিনতলায় একটা বালিশ তোলার খরচ দেখানো হয়েছে ৬০০ টাকা। বালিশগুলোর দাম দেখানো হয়েছে প্রতি পিস ছয় হাজার থেকে আট হাজার টাকা। যে বিদ্যুৎ সাত টাকায় উৎপাদন করতে পারে; রেন্টাল-কুইকরেন্টালের কাছ থেকে তা কেনা হয়েছে ১৭ টাকা প্রতি ইউনিট। আর তামাশাটা হলো এই যে, এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র যদি বিদ্যুৎ নাও দেয় তাহলেও তাদের জন্য গুনতে হয় হাজার হাজার কোটি টাকা। এখানেই শেষ নয়। এ ক্ষেত্রে যে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে তা যেন কোনো দিন ধরা না পড়ে ওবায়দুল কাদের গং এমন একটি আইন পাস করেছেন যে, বিদ্যুৎ খাতে কিভাবে খরচপাতি হয় বা হয়েছে তা নিয়ে দেশের কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। তাহলে তো লুটপাট ফাঁস হয়ে যাবে।
শুধু এটাই নয়, আমরা এমন অনেক সেতু দেখি যার দু’পাশে ধানক্ষেত। কোনো অ্যাপ্রোচ সড়ক নেই। এখানে ওই সেতুটি নির্মাণের প্রস্তাব কে দিলো, কে অনুমোদন দিলো, কে টেন্ডার পেল, কে টাকা তুলে নিয়ে হাওয়া হয়ে গেল। তার কোনো হদিস নেই। ওবায়দুল কাদের সাহেব, এটা কি লুটপাট নয়? এমন কোনো সেক্টর নেই এই সরকারের আমলে দুর্নীতি হচ্ছে না। সরকার কিছুতেই উৎপাদনে যেতে চায় না। তারা কেবলই কেনাকাটা করতে চায়। কেনাকাটায় আছে কমিশন আর লুটপাট। টেন্ডার বাণিজ্যে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। আওয়ামী লীগের বাইরে কেউ কোনো দরপত্র জমাই দিতে পারে না। ফলে লাখ টাকার কাজে কোটি টাকা ব্যয় হয়। কোনো প্রকল্প তারা সময় মতো শেষ করতে পারে না। সময় বাড়ায়, বাজেট বাড়ায়। লুটপাটের মহোৎসব চলে। তার পক্ষেও যুক্তি আছে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী যুক্তি হলো, কাজ যদি শেষ না হয় সময় তো বাড়াতেই হবে। ততদিনে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়, ফলে খরচও বাড়ে। আমরা বলি, লুটপাটও বাড়ে। এই লুটপাটে অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারের ঘটনাও নিয়মিত ঘটে। অন্য ব্যবসায়ীদের প্রাণ যায়, তার বিচারে কথা খুব একটা শোনা যায় না। সরকার শাসনের নামে লুটপাটতন্ত্র কায়েম করেছে। তারা বলছে, বিএনপি নাকি লুটপাট করে। তো, ওবায়দুল কাদের সাহেব আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, তাদের আমলে ওমুক প্রকল্পের কাজ বিএনপি পেয়েছিল এবং সেখান থেকে অত কোটি টাকা লুটপাট করে নিয়ে গেছে। ব্যাপারটা এ রকম, প্রমাণের দরকার নেই ‘লিখে দিলাম কলার পাতে, ঘোরো গিয়ে পথে পথে’।
আর সুবিধাবাদ, ১৯৯১ সালে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, স্বৈরশাসক এরশাদকে কেউ কোনো দলে নেবে না। কিন্তু আওয়ামী লীগ একেবারে দেরি না করে এরশাদকে কোলে তুলে নিলো। তারও পরে ২০০৬ সালে কোনো এক মামলায় এরশাদের শাস্তি হওয়ায় আওয়ামী লীগ নির্বাচনই বর্জন করে বসে। একে কি নীতি আদর্শবাদ বলে? নাকি সুবিধাবাদ? আওয়ামী লীগ খেলাফত মজলিসের সঙ্গে লিখিত চুক্তি করে যে, বাংলাদেশে ইসলামবিরোধী কোনো তৎপরতা চালানো হবে না। তত্ত্বাধায়ক সরকারের দাবিতে তারা জামায়াতে ইসলামীর সাথে জোট বাঁধে। জামায়াত নেতা মওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে পাশে বসিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে। সোরওয়ার্দী উদ্যানে কওমি হুজুরদের মহাসম্মেলন ডেকে বৈঠক করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। পেয়েছিলেন ‘কওমি জননী’ উপাধি। এগুলোকে কি সুবিধাবাদ বলে না?
হঠাৎ করে আপনিইবা কোন মুখে বিএনপিকে লুটপাটকারী ও সুবিধাবাদী বলে বসলেন? কাদের সাহেব বলেছেন, বিএনপি স্বাধীনতার কথা বলে কিন্তু লালন ও পোষণ করে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি আর পৃষ্ঠপোষকতা করে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে। হ্যাঁ, বিএনপি স্বাধীনতার কথা বলে। স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের কথা বলে, এমনও বলে আওয়ামী লীগ ফের ক্ষমতায় এলে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে। আপনারা কি দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেননি? ভারতকে বাংলাদেশের বুকচিরে সড়ক নৌপথ রেলপথ দেননি? দিয়েছেন এবং দিয়েই যাচ্ছেন। শত শত কিলোমিটার সড়ক ব্যবহার করছে ভারত।
নৌবন্দরগুলো ব্যবহার করছে ভারত। নৌপথ ব্যবহার করছে ভারত। তার বিনিময়ে আপনারা কি মাত্র ১২ কিলোমিটার সড়কে যাতায়াতের ব্যবস্থা করতে পেরেছেন, যাতে বাংলাদেশ সরাসরি নেপাল ও ভুটানে পণ্য রফতানি করতে পারে? পারেননি। ভারত বহুবার কথা দিয়েছে, ওই সড়ক দিয়ে দেবে। আমরা ঢাকা থেকে গাড়িতে চড়ে নেপাল বা ভুটানে যেতে পারব, আমাদের পণ্য সরাসরি রফতানি করতে পারব, কিন্তু হয়নি।
তিস্তার একফোঁটা পানিও আনতে পারেননি। ভারতের মনমোহন সিং সরকার থেকে শুরু করে মোদি সরকার পর্যন্ত সবাই বলেছে, একটা ব্যবস্থা হবে; কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জি রাজি নন বলে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি করা যাচ্ছে না। চুক্তি হবে সার্বভৌম বাংলাদেশ ও সার্বভৌম ভারতের মধ্যে। সেখানে ভারতের কোনো প্রদেশের গররাজিতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু ভারত আমাদের শুধু হাইকোর্ট দেখিয়ে যাচ্ছে উপরন্তু ফেনী নদী সম্পূর্ণ আমাদের নদী। এই নদী থেকে ভারতকে পানি তোলার অধিকার দিয়ে এসেছেন। এটাকে কি সুবিধাবাদ বলে না? তাহলে আপনাদের লজ্জা শরম কোথায় গেল? পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন ভারতে গিয়ে আবেদন জানিয়ে এসেছেন যে, আগামী টার্মেও যেন ভারত সরকার আপনাদের ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করে। আপনি অবশ্য বলেছেন, কাউকে ভারতের সহযোগিতা চাওয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়নি। কিন্তু ড. মোমেন তার বক্তব্যে অনেক দিন পর্যন্ত অবিচল ছিলেন। এটাও সুবিধাবাদ।
বিএনপি নাকি সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পৃষ্ঠপোষকতা করে। এ দেশে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টানদের পৃষ্ঠপোষকতা করলে তা সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পৃষ্ঠপোষকতা বলে না। কিন্তু কেউ যদি ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে মুসলমানের স্বার্থের কথা বলে তবে তাকে ‘সাম্প্রদায়িক শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা’ বলে অভিহিত করা হয়।
ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি ভোটাধিকারের কথা বলে অথচ ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটারবিহীন প্রহসনের নির্বাচন ও সোয়া কোটি ভুয়া ভোটার সৃষ্টি করেছিল। এ কথা সত্য যে, আওয়ামী লীগ জামায়াতের সাথে মিলিত আন্দোলনের ফলে সংবিধান সংশোধন করে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল। আর এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তনের জন্যই ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন হয়েছিল। সেই নির্বাচনে সবাইকে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। এক দিকে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাইছিল; অন্য দিকে নির্বাচন বর্জন করেছিল। বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের বিধান পাস করার প্রয়োজনে মাত্র তিন মাসের জন্য সরকার হবে। পার্লামেন্ট হবে। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রবর্তন করবেন। আর পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে।’ হয়েছিলও তাই। তাহলে এত দিনে ‘ভোটারবিহীন’ নির্বাচন বলছেন কেন তাকে? ২০১৪, ২০১৮ নির্বাচনেই কি কোনো মানুষ ভোট দিতে পেরেছে? এগুলো কি ভোটারবিহীন নির্বাচন নয়? তাহলে আপনি কোন মুখে বলছেন, বিএনপি ভোটারবিহীন নির্বাচন করেছিল?
সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে আরো একটি কথা বলতে চাই, এ দেশের মানুষ যদি গরিষ্ঠ সংখ্যায় মুসলমান না হতো তাহলে পূর্ব পাকিস্তানও হতো না, বাংলাদেশও হতো না। বাংলাদেশ হিন্দু প্রধান হিসেবে স্বাভাবিকভাবে ভারতের অংশ হয়ে যেত। ১৯৪৭ সালে ভোটের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছিল যে, পূর্ব বাংলার লোকেরা কার সাথে যোগ দিতে চায়। ভারত নাকি পাকিস্তান? সেখানে অধিকাংশ মানুষ পাকিস্তানের সাথে যোগ দিতে চেয়েছিল। ফলে এটা পূর্ব পাকিস্তান হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান হয়েছিল বলে যুদ্ধের মাধ্যমে এ দেশের মানুষ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। যুদ্ধ করে ভারতে যোগ দিতে চায়নি। এখন তো ওয়াজ নসিহতও বাংলাদেশে প্রায় নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। এটা আদর্শ নয়, বিকার মাত্র। সুতরাং বিএনপি সম্পর্কে কটু মন্তব্য করার আগে আওয়ামী লীগের আয়নায় একবার মুখ দেখে নেয়া উচিত।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন