শিকড়ের সন্ধান
10 July 2017, Monday
একটি জাতির শক্তিমত্তা কত প্রচ-, তার ধারণক্ষমতা কত গভীর, তার বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ কত উন্নতÑ তা জানতে হলে প্রথমে জানতে হবে ওই জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। জানতে হবে তার সাংস্কৃতিক অর্জন ও সাংস্কৃতিক অর্জনের প্রয়াসকে। সংস্কৃতি জীবন নয়, জীবনের সৌষ্ঠব। সংস্কৃতি সমাজ নয়, সমাজজীবনের সৌন্দর্য ও শৃঙ্খলা। সংস্কৃতি যতটুকু ব্যক্তিগত, এর চেয়ে বেশি সামাজিক। সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করার সহজাত প্রবণতা থেকেই সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে। তাই এর শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে সমাজে। সমাজজীবনেই সংস্কৃতি ফুলে-ফলে সুশোভিত হয়ে বেড়ে উঠেছে এবং তার চারপাশ ঘিরে রেখেছে স্নিগ্ধ শ্যামলিমা ও সুষমাভরা নিশ্চয়তায়। জাতীয় সংস্কৃতি মস্ত বড় জাতীয় সম্পদ। এ সম্পদ ধারণ করেই জাতি তার মেরুদ- ঋজু রাখতে সক্ষম হয়। এই সম্পদের মধ্যেই জাতি তার অতীতকে খুঁজে পায়। এর মাধ্যমেই ভবিষ্যতের গন্তব্য সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করে। বলে রাখা ভালো, সংস্কৃতি অচল বা অনড় কোনো ধারণা নয়। সময়ের দাবির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সংস্কৃতিও নিজেকে খাপ খাইয়ে চলতে সক্ষম। তাই পরিবর্তন এ ক্ষেত্রে অবশ্যম্ভাবী। তবে মূল কাঠামো অক্ষত রেখে। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পরিবর্তন যেমন সত্য, তেমনি সত্য এর স্থায়িত্ব। বর্তমানে, বিশেষ করে তথ্য বিপ্লবের এই যুগে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক নতুন সংকট দেখা দিয়েছে।
আমরা বাংলাদেশ নামে এ ভূখ-ের অধিবাসীরা বর্তমানে এক চরম সংকটকাল অতিক্রম করছি। এ সংকট নিরসনের জন্য আমাদের ইতিহাসের আলোকে শিকড় সন্ধান এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পাঠ নেওয়া প্রয়োজন। স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বয়স মাত্র চার দশকের বেশি।
ঐক্যবদ্ধ জনসমাজ হিসেবে বাংলাদেশের বয়স চার হাজার বছরেরও বেশি। সমুদ্রসৈকতে বালুকারাজির মধ্যে তিল তিল করে যেমন সঞ্চিত হয় মহামূল্যবান রতœভা-ারÑ সমুদ্রের বেলাভূমিতে, সমুদ্রের আকর্ষণে, অসংখ্য স্রোতস্বিনীবাহিত পলি হাজার হাজার বছর সঞ্চিত হয়ে তেমনি সৃষ্টি করে উন্নত জীবনের উপযোগী স্বর্ণদ্বীপ। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি, স্বর্ণালি দ্বীপ বাংলাদেশের জন্ম এভাবেই হয়েছে। সৃষ্টির এ প্রক্রিয়া কখন যে শুরু হয়, তা কেউ জানি না।
ইতিহাস সাক্ষীÑ দক্ষিণ এশিয়ার প্রান্তসীমায় অবস্থিত এ জনপদের রাজনৈতিক ভাগ্য প্রায় সব সময় জড়িত ছিল উত্তর-পশ্চিম ভারতে প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যগুলোর সঙ্গে। কিন্তু এ জনপদ দীর্ঘদিন কোনো সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে থাকেনি। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের শেষ দিকে কিংবদন্তির ওই গঙ্গারিডাই (এধহমধৎরফধর) সাম্রাজ্যের আমল থেকে শুরু করে মৌর্য রাজাদের রাজত্ব পার হয়ে দিল্লির সালতানাত ও মোগল সাম্রাজ্যের অবসানের পর ব্রিটিশ-ভারত পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজার বছরের ইতিবৃত্ত একইরকম, অনেকটা সরলরৈখিক। শুধু তা-ই নয়, বঙ্গ (ঠধহমধয), রাঢ় (জধফযধয), গৌড় (এধঁফধয), পু-্র্র (চঁহফৎধয) ইত্যাদি গোত্র-গোষ্ঠীর আবাসভূমিরূপে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনপদের এই খ--ছিন্ন রাজনৈতিক একক হিসেবে সর্বপ্রথম ইতিহাসের আলোকে এলেও সব সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে পর্যায়ক্রমে তা বঙ্গ, বাঙ্গালা (ইধহমধষধ) ও বাংলাদেশরূপে (ইধহমষধফবংয) আবির্ভূত হয়েছে সগৌরবে। ছোট ছোট লোকালয় সর্বপ্রথম পরিচিত হয় সদাসিক্ত বৃষ্টিবিধৌত বন্স অথবা বংরূপে (ইধহং ড়ৎ ইধহম)। সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ (১৩৪২-১৩৫৭) এসব জনপদ ঐক্যবদ্ধ করে সর্বপ্রথম বাঙ্গালারূপে অভিহিত করেন। তিনিও শাহ-ই-বাঙ্গালা (ঝযধয-ঊ-ইধহমধষধ) উপাধি ধারণ করেন। পরবর্তী সময়ে বাঙ্গালা হয়ে ওঠে বাংলা। ব্রিটিশ ভারতে বাংলা ও বঙ্গ রূপান্তরিত হয় বেঙ্গলে (ইবহমধষ)। স্বাধীনতাযুদ্ধের কালে তা হয় বাংলাদেশ।
বঙ্গোপসাগরের উপকণ্ঠেÑ একদিকে দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য, অন্যদিকে দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব-এশিয়ার প্রান্তসীমায় অবস্থিত বাংলাদেশে বসবাস করেছে কয়েক হাজার বছর ধরে বহু নৃতাত্ত্বিকগোষ্ঠীর জনসমষ্টি। সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, অন্তত ৫৭টি নৃতাত্ত্বিকগোষ্ঠীর মানুষ এ দেশে এখন বসবাস করছে। তাদের মধ্যে রয়েছে কয়েক আদিবাসী। অন্যরা এই উর্বর জনপদে এসেছেন বিভিন্ন কারণে। কেউ এসেছেন নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য, কেউ বা সেখানকার শাসকদের অত্যাচার ও নিপীড়ন থেকে আত্মরক্ষার তাগিদে। বিজয়ীর বেশে এসেও কেউ কেউ স্থায়ীভাবে বসবাস করে হয়ে গেছেন স্থানীয়। এসেছেন উত্তর, উত্তর-পশ্চিম ও পশ্চিম দিক থেকে। আবার কেউ কেউ এসেছেন দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্বদিক থেকে। হাজার হাজার বছরের ব্যাপনকালে আদিবাসী ও বাইরে থেকে আসা জনসমষ্টি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভাষা, প্রথা, জীবনাচারের হাজারো প্রক্রিয়া, পদ্ধতি ও উপাদানের মিথস্ক্রিয়ায় এ অঞ্চলে জন্মলাভ করে এক নতুন সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতি ছিল বৈরী প্রকৃতির দাপট সহ্য করে সবাই মিলে টিকে থাকার, ঝড়-ঝঞ্ঝা-বন্যা-জলোচ্ছ্বাসের উদ্যত ফণা জাপটে ধরে আত্মরক্ষা এবং পূর্ব, পশ্চিম ও উত্তর থেকে আসা দখলদারদের প্রতিহত করে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণ করার। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, যে অঞ্চল আজ স্বাধীন বাংলাদেশরূপে চিহ্নিত, এর অবয়ব খ্রিস্টের জন্মের পরবর্তী শতাব্দীতেও সম্পূর্ণ হয়নি। প্রথম শতাব্দীতে খুলনার বিস্তীর্ণ অঞ্চল এবং ফরিদপুরের কোটালীপাড়া ও তৎসংলগ্ন এলাকা সমুদ্রস্নাত হয়ে সবে মাথা উঁচু করে জনবসতির উপযোগী হয়েছে। এর পরের ২০০ বছর পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরের জোয়ারের পানি যশোর-কুষ্টিয়ার বৃহৎ এলাকা তো বটেই, এমনকি রাজধানী ঢাকার আশপাশ পর্যন্ত বিধৌত করেছে। উর্বর ও শ্যামল এই নতুন মাটি অনায়াসে যেমন কৃষকদের গোলা ভরিয়েছে সোনালি ফসলে, তেমনি রোগব্যাধি ও মহামারী কেড়ে নিয়েছে হাজারো প্রাণ অকস্মাৎ, অনেকটা বিনা নোটিশে। তাই এই ভূখ-ে বসবাসকারীদের মন যেমন কোমল, উদার, সবাইকে আপন করার মতো আবেগঘনÑ তেমনি বৈরী প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকার জন্য দুর্জয় সাহসে ভরা।
একদিকে প্রকৃতির দুর্দমনীয় তা-বলীলা মানুষকে করেছে ভাববাদী, অন্যদিকে নৈসর্গিক এবং চারপাশে সবুজের ঘন আস্তরণে ঢাকা দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ সবাইকে করে তোলে স্বভাবকবি। তাই এ জনপদের জনগণের কাছে প্রবাদ-প্রবচন যে প্রাত্যহিক চলন-বলনের মতোই, এতে সন্দেহ নেই। প্রাণপণ করে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণে দৃঢ়সংকল্প এ দেশের জনগণকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়েছে বলে একদিকে যেমন তারা নির্ভীক, অন্যদিকে তেমনি ছলে-বলে ও কৌশলে লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রেও ভীষণ দক্ষ। দক্ষ তারা কথার পাশে কথা সাজিয়ে গান রচনায়। দক্ষ গ্রামীণ জীবনের অনেক সত্য কণ্ঠে মন মাতানো ঢঙে উপস্থাপনে। ফলে প্রবাদ-প্রবচনে প্রতিফলিত হয়েছে জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা এবং এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের কাছে হস্তান্তরযোগ্য মূল্যবান অভিজ্ঞান।
অনেক সময় বলেছি, বাংলাদেশকে ভালোভাবে জানতে হলে গ্রামে যেতে হবে। কেননা গ্রামেই বাংলাদেশের হৃদয় স্পন্দিত। এখন বলতে চাই, গ্রামীণ জীবনের ঋদ্ধি ও সৌকর্য সম্পর্কে জানতে হলে দৃষ্টি ফেরাতে হবে আমাদের সনাতন প্রবাদ-প্রবচনের দিকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের অবয়বে কারুকার্য নেই বটে কিন্তু সমাজজীবনের বৈচিত্র্যভরা দিকনির্দেশনা ও নিখাদ অভিজ্ঞতার পসরায় আমাদের প্রবাদ-প্রবচন ভীষণভাবে সমৃদ্ধ। এসবের মধ্যেই মিলবে সমাজ হিসেবে বাংলাদেশের এবং জাতি হিসেবে বাংলাদেশের শিকড়ের সন্ধান।
এমাজউদ্দীন আহমদ : সাবেক উপাচার্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন