কোনো কোনো শিক্ষাবিদ একুশের চেতনার স্বরূপ নির্ধারণ করতে গিয়ে বলেছেন, বাঙালিত্ব ও মুসলমানিত্বের মধ্যে রয়েছে সহাবস্থানগত দ্বন্দ্ব। কেউ বলেছেন, মুসলমানিত্বের সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে বাঙালিত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে একুশের ভাষা আন্দোলন। কারও মতে, মুসলমানিত্বের মধ্যে রয়েছে সাম্প্রদায়িকতা, একুশের চেতনা অসাম্প্রদায়িক। তাদের বক্তব্য শোনার সুযোগ হয়নি। পত্রপত্রিকায় যেটুকু প্রকাশিত হয়েছে তারই ভিত্তিতে এ সম্পর্কে কটি কথা বলতে চাই। বাঙালিত্ব ও মুসলমানিত্বের মধ্যে সহাবস্থানগত দ্বন্দ্বের কথা এসব প-িত বলছেন এখন। অনেক আগে এ কথা বলেছেন খ্যাতনামা ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র। তার বহু পঠিত শ্রীকান্তের প্রথম পর্বে আবার চোখ বুলান, দেখবেন, লেখা রয়েছেÑ ‘স্কুলের মাঠে বাঙালি ও মুসলমান ছাত্রদের ফুটবল ম্যাচ।’ শরৎচন্দ্র তার উত্তরপুরুষ আজকের প-িতদের মতো কোনো ঘোরপ্যাঁচ না রেখেই বলেছেন, মুসলমান এবং বাঙালিরা স্বতন্ত্র। দু-এর সহাবস্থানের কোনো সুযোগও তিনি রাখেননি। বাঙালি এবং মুসলমানরা পরস্পরের প্রতিপক্ষ যেন। প্রতিযোগীও বটে। খেলার পরের অবস্থা চিত্রণে তা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শুধু শ্রীকান্ত কেন, তার লিখিত ‘তরুণের বিদ্রোহ’ প্রবন্ধে তিনি আরও খোলাসা করে বলেছেন, ‘জয়চাঁদ, পৃথ¦ীরাজ থেকে শুরু করে সিরাজউদ্দৌলা ও মীরজাফরেও এই মজ্জাগত অভিশাপ আর ঘুচল না। বাংলাদেশ মুসলমানরা জয় করতে এলো। এ দেশে ব্রাত্য-বৌদ্ধরা খুশি হয়ে তাদের ধর্ম দেবতার যশোগান করে ‘ধর্ম্ম মঙ্গলে’ লিখলেনÑ
‘ধর্ম হইল যবনরূপী
মাথায় ছিল কালো টুপি
ধর্ম্মর শত্রু করিতে বিনাশ’
অর্থাৎ বিদেশি মুসলমানরা যে হিন্দু ধর্মাবলম্বী প্রতিবেশী বাঙালি ভায়াদের দুঃখ দিতে লাগল, এতেই তারা পরমানন্দে পরিপূর্ণ হয়ে উঠলেন। শরৎচন্দ্রকে আমি সাম্প্রদায়িক বলি না।
বঙ্কিম চন্দ্রের আনন্দ মঠের তৃতীয় খ-ের দশম পরিচ্ছেদের দিকে দৃষ্টি দিন। ভবানন্দ বলিলেন, ‘কাপ্তেন সাহেব, তোমায় মারিব না, ইংরেজ আমাদের শত্রু নহে। কেন তুমি মুসলমানের সহায় হইয়া আসিয়াছ? আইস তোমার প্রাণদান দিলাম, আপাতত তুমি বন্দি। ইংরেজের জয় হউক, আমরা তোমাদের সুহৃদ।’
চতুর্থ খ-ের সপ্তম পরিচ্ছেদে তিনি লিখেছেন, ‘বাঙালি, হিন্দুস্তানি, ইংরেজ, মুসলমান এখন জড়াজড়ি; জীবন্তে, মৃতে, মনুষ্যে, অশ্বে, মিশামিশি ঠেসাঠেসি হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে।’ বঙ্কিম চন্দ্রকেও আমি সাম্প্রদায়িক বলছি না। বুদ্ধিজীবী ও প-িতরা কী বলবেন? শরৎচন্দ্র ও বঙ্কিম চন্দ্রের যুগে মুসলমানরা বাঙালি ছিলেন না। বাঙালি ছিলেন না সমাজের খেটে খাওয়া মানুষরা, কৃষক ও শ্রমিকরা। কলকাতাকেন্দ্রিক পেশাজীবী ‘ভদ্রলোকরাই’ ছিলেন শুধু বাঙালি, হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশমাত্র। সংখ্যায় বঙ্গদেশের মোট জনসমষ্টির শতকরা পাঁচ ভাগ মাত্র। পূর্ববাংলার জনসমষ্টি, তা হিন্দুই হোক আর মুসলমান হোক, তখন বাঙালের বেশি কিছু ছিল না। ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের পরই শুধু নতুন অভিধা লাভ করে এই জনপদÑ এপার বাংলা এবং ওপার বাংলার পরিচয়ে। ভারত বিভাগ তথা বাংলা বিভাগের পরই পূর্ববাংলার জনগণকে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা বাঙাল থেকে বাঙালিতে প্রমোশন দেয়। পূর্ববাংলা এখন থেকে হয় ‘এপার বাংলা’। তার আগে বঙ্গদেশের পূর্বাঞ্চলের জনসমষ্টি তো বাঙালি ছিল না। ছিল বাঙাল। কারও মতে, শুধু ‘মোচলমান’।
কিন্তু ভারত বিভাগ তথা বাংলা বিভাগের মূলে ছিল পূর্ববাংলার জনগণের মুসলমানিত্ব। তারা মুসলমান বলেই পূর্ববাংলা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি লর্ড এটলি ১৯৪৮ সালের জুনের মধ্যে ভারতীয়দের হাতে ভারতবর্ষের ক্ষমতা হস্তান্তরের যে ঐতিহাসিক ঘোষণা দিয়েছিলেন, তখনই অখ- ভারতের প্রবক্তাদের অন্যতম হিন্দু মহাসভার বাঙালি নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বঙ্গদেশে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শুরু করেন এক প্রচ- আন্দোলন। হিন্দু মহাসভার বাংলা বিভাগের দাবি সম্পর্কে বঙ্গদেশের গভর্নর বারোজ (ঝরৎ ঋ. ইঁৎৎড়ংি) গভর্নর জেনারেল ওয়াভেলের কাছে রিপোর্ট প্রদানকালে লিখেছিলেন, এই দাবির কথা শুনে ‘কার্জন নিশ্চয়ই তার কবরে হেসে উঠেছেন’ (ঈঁৎুড়হ সঁংঃ নব পযঁপশষরহম রহ যরং মৎধাব), কেননা ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনে বঙ্গ দেশের বাঙালি নেতৃবৃন্দই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, বিপিন চন্দ্র পাল, অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখ বাঙালি নেতা বঙ্গভঙ্গকে ‘অযৌক্তিক’, ‘অন্যায়’ এবং ‘অপমানজনক’ বলে শতসহস্র মঞ্চ থেকে বঙ্গভঙ্গ রদের পক্ষে বক্তব্য রাখেন। ভারত মাতাকে কালীরূপে চিত্রিত করা হয়। ‘রক্ত পিপাসায় কাতর কালীমাতা, কাপালি, এলোকেশী, নগ্নদেহি, ভয়ঙ্কর কৃষ্ণমূর্তি, গলায় তার সদ্য ছিন্ন নরমু-ের মালা, যা থেকে এখনো রক্ত ঝরছে।’ বিভক্ত বাংলাদেশ, বিদেশি পদানত এই বঙ্গদেশ। ১৯০৮ সালের ৩০ মে কলকাতার যুগান্তর পত্রিকায় এরূপ চিত্র অঙ্কিত হয়েছিল। একটি স্বতন্ত্র আইন পরিষদ গঠনের সুপারিশ, বঙ্গদেশের দুই অংশের জন্য স্বতন্ত্র দুটি মন্ত্রিসভা এবং লক্ষ্য অর্জনের জন্য এক লাখের একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের প্রস্তাব করে হিন্দু মহাসভা। হিন্দু মহাসভার আন্দোলনে সাহস জোগাল কংগ্রেস এবং শক্তি জোগালেন পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি নেতারা। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুও ছিলেন সেই আন্দোলনের একজন একনিষ্ঠ কর্মী।
বঙ্গদেশ বিভক্ত হয় ১৯৪৭ সালে এবং পূর্ববাংলার জনগণের মুসলমানিত্বই ছিল এর মূলে। তখন বাঙালি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম প্রমুখ মুসলিম লীগ নেতা এবং শরৎবসু, কিরণ শংকর রায় প্রমুখ কংগ্রেস নেতার অবিভক্ত বঙ্গদেশের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমে হুগলি জেলার তারকেশ্বরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে (১৯৪৭ সালের ৪-৬ এপ্রিল) যে কর্মসূচি গ্রহণ করেন তার অন্যতম প্রস্তাবনা ছিল পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ গঠনের লক্ষ্যে একটি বাউন্ডারি কমিশনের জন্য গণপরিষদের কাছে প্রস্তাব পেশ, শুধু হিন্দু সদস্য সমন্বয়ে। পূর্ববাংলাকে অর্থনৈতিক দিক থেকে পঙ্গু করার জন্য শুরু হয় শিল্প-বাণিজ্য ক্ষেত্রে যারা এতদিন কর্তৃত্ব করেছেন তাদের পূর্ববাংলা ত্যাগ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে অভিজ্ঞ শিক্ষকরা গেলেন ভারতে। গেলেন জমিদার-ভূমি মালিকরা। গেলেন ব্যবহারজীবী, এমনকি সংস্কৃতিসেবীরাও, বাঙালি সংস্কৃতি সংরক্ষণের অজুহাতে। মুসলমানদের স্পর্শ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে। ১৯৪৭-৫২ সময়কালে পূর্ববাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আইন-আদালত, এমনকি সাংস্কৃতিক অঙ্গন পূর্ববাংলার জনগণের নিয়ন্ত্রণে আসে। পূর্ববাংলায় গড়ে ওঠে এক স্থিতিশীল মধ্যবিত্ত শ্রেণি। এই শ্রেণির নেতৃত্ব দিয়েছেন সচেতন দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী, উদারচেতা মুসলমান নেতারা। আজকে যেমন পশ্চিমবঙ্গের শিল্পী সুমন চট্টোপাধ্যায়ের মতো হিন্দু বাঙালি হিন্দি আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন এবং বাংলাদেশে এসে নিজেদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেছেন, পূর্ববাংলার মুসলমান বাঙালিরা উর্দু সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই। সর্বপ্রথম এই সংকটের আঁচ করেছেন মুসলমান বুদ্ধিজীবীরাই। তারা তাদের মুসলমানিত্বকে বাঙালিত্বের জন্য কোথাও কারো কাছে বন্ধক দেননি। মুসলমানিত্বের ভিত্তিতে যে ভূখ- লাভ করেন এবং পূর্ববাংলায় যেভাবে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা প্রতিষ্ঠিত হলেন তা সংরক্ষণ করার জন্যই বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম এবং অফিস-আদালতসহ সমাজজীবনের সর্বত্র বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরপরই।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার এক মাসের মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছুসংখ্যক ছাত্র এবং শিক্ষকের নেতৃত্বে গঠিত তমদ্দুন মজলিস ১৯৪৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম এবং আইন-আদালতের ভাষা করার পক্ষে আন্দোলন শুরু করেন। তার কদিন পর ১৫ সেপ্টেম্বর ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু?’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে তমদ্দুন মজলিস। ওই পুস্তিকায় বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন, আদালতের ভাষা, অফিসের ভাষা ও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ভাষা হিসেবে দাবি করা হয়। ওই প্রস্তাবটি রচনা করেন তমদ্দুন মজলিসের প্রধান অধ্যাপক আবুল কাসেম। তা ছাড়া ওই পুস্তিকায় ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন এবং কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদের ভাষা সম্পর্কিত প্রবন্ধ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানে উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদান করলে পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে বিরূপ প্রভাব পড়বে সে সম্পর্কেও কয়েকজন প-িত ব্যক্তি সবাইকে সচকিত করেন। এ প্রসঙ্গে ড. মুহাম্মদ এনামুল হক, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নাম উল্লেখযোগ্য। ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার পরিপ্রেক্ষিতে ‘উর্দু ও বাংলা’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে ড. এনামুল হক লিখেন : ‘উর্দু বহিয়া আনিবে পূর্ব পাকিস্তানিদের মরণ-রাজনৈতিক, রাষ্ট্রিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মৃত্যু। এই রাষ্ট্র ভাষার সূত্র ধরিয়া শাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি সর্ববিষয়ে পূর্ব পাকিস্তান হইবে উত্তর ভারতীয়, পশ্চিম পাকিস্তানি উর্দুওয়ালাদের শাসন ও শোষণের ক্ষেত্র।’
যেসব লেখক ও চিন্তাবিদের কথা বলা হলোÑ তারা সবাই ছিলেন মনেপ্রাণে বাঙালি। তারা ছিলেন খাঁটি মুসলমানও। মুসলমানিত্ব তাদের বাঙালিত্বের পথে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি। বাঙালি হতে হলে কিছুটা কম মুসলমান হতে হবে অথবা খাঁটি মুসলমান হলে পুরোপুরি বাঙালি হওয়া যাবে নাÑ এ ভাবনা তাদের কোনো সময়ে পীড়িত করেছে বলেও জানা যায়নি। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গকে কলকাতাকেন্দ্রিক যেসব বাঙালি নেতা তখন ‘জাতীয় অপমান’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন, ৬০ বছর পর তাদেরই উত্তরসূরিদের হাতে বঙ্গদেশ বিভক্ত হয় ১৯৪৭ সালে। ১৯৪৭ সালের বাংলা বিভাগের ছয় দশক পর বাংলাদেশের কিছু চেনা মুখ মুসলমানিত্ব ও বাঙালিত্বের মধ্যে আবিষ্কার করছেন সহাবস্থানগত দ্বন্দ্ব। কোন উদ্দেশ্যে তারা এসব বলছেন? তাদের লক্ষ্য কী? এসব বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা হওয়া দরকার।
এমাজউদ্দীন আহমদ, সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন