সিস্টার্স অব দ্য হোলি নেইমস অব জেসাস অ্যান্ড মেরি। আজ শিক্ষাব্যবস্থা ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে লিখতে গিয়ে নামটি মনে পড়ল।
বাংলাদেশের সামনের সারির পত্রপত্রিকায় ক্ষমতাসীন সরকারের শিক্ষানীতি, বিশেষত কওমি মাদ্রাসার ঐতিহাসিক সত্তা ও মৌলিক বৈশিষ্ট্য বিনষ্ট করার আইন ও নীতির বিরুদ্ধে যে লড়াই চলছে তার খবর খুব একটা আসে না। যখন আসে তখন জাতীয় ইস্যু হিসেবে যে পরিমাণ গুরুত্ব পাওয়ার কথা সেটা পায় না। এর পেছনে কিছু অনুমান কাজ করে থাকতে পারে। যেমন, কওমি মাদ্রাসা তাদের প্রাচীন ও বর্তমান সময়ের জন্য অনুপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা রক্ষা করার সংগ্রাম করছে, এদের কথাবার্তা, তৎপরতাকে গুরুত্ব দেয়ার কিছু নাই; মাদ্রাসা জঙ্গি তৈরির কারখানা, এদের খবরাখবরের গুরুত্ব দেয়ার অর্থ জঙ্গিদের সমর্থন দেয়া; এসব পশ্চাদপদ প্রতিষ্ঠান তুলে দিয়ে আমাদের দরকার সবার জন্য একই রকম শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা, এদের কথা তাহলে প্রচার না করাই ঠিক কাজ, ইত্যাদি।
সবচেয়ে প্রবল ও প্রকট অনুমান হচ্ছে, শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিক রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকতে হবে। এর কারিকুলাম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা নীতি, পাঠ্যপুস্তক লেখা, পাঠ্য বিষয় নির্ধারণ, শিক্ষক প্রশিক্ষণসহ সবকিছুই থাকতে হবে রাষ্ট্রের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে। যারা ক্ষমতায় থাকবে তারাই ঠিক করবে আমরা কী শিক্ষা দেব, কী বিষয় পড়াব, কীভাবে মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ ইত্যাদি পরিচালনা করব, ইত্যাদি। রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সরকার যদি ফ্যাসিস্ট হয় তাহলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরও ভূমিকা হবে যতœ করে ফ্যাসিস্ট মনমানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি উৎপাদন। শিক্ষানীতি সংক্রান্ত আমাদের বাগাড়ম্বরের গোড়ার সারকথা এটাই। একটি কেন্দ্রীভূত ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার অধীনে শিক্ষাব্যবস্থাকে মতাদর্শিক হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তোলা। এর বাইরে কেউ থাকতে চাইলে তাদের দমন, উৎখাত ও বিনষ্ট করাই কর্তব্য। এর বিপরীতে সম্প্রতি বেফাক আয়োজিত ওলেমা সম্মেলন থেকে ক্ষমতাসীনদের কাছে পাঠানো প্রস্তাবগুলো পড়ছিলাম। তখনই মনে পড়ল, সিস্টার্স অব দ্য হোলি নেইমস অব জেসাস অ্যান্ড মেরি।
শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষানীতি নিয়ে বস্তা বস্তা লেখা হয়। তাতে কার কতটুকু আমোদ হয় বলা মুশকিল। শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থার তর্ক ব্যবহারিক কী দার্শনিক সব দিক থেকেই বিশাল একটি ক্ষেত্র। এ ক্ষেত্রে যারা ‘বিশেষজ্ঞ’ তারা সময়ে-অসময়ে ভালো কিছু বলেন না তা নয়, তবে সেই ভালোমন্দের তর্ক ফুটা বাটিতে পানি ঢালা আর কী! তাই বলে শিক্ষার প্রশ্নকে আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। দর্শন বা সজীব চিন্তার কাজ হচ্ছে মানুষ সম্পর্কে খুবই গোড়ার কিছু প্রশ্ন তোলা, সেই গোড়ার প্রশ্নের সঙ্গে মানুষের বিকাশ সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কী করে সফলভাবে করা যায়, সেই বাস্তব বা ব্যবহারিক প্রশ্নের সঙ্গেও জড়িত। যেখানে আমরা গোড়ার প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে অভ্যস্ত নই, সেখানে কে কী বলল তা বিনোদন হতে পারে; কিন্তু এসব বলাবলিতে শিক্ষা নিয়ে আমাদের সামাজিক চিন্তার কিংবা চর্চার আদৌ কোনো গৌরব বৃদ্ধি হয়েছে বলে মনে হয় না।
এখন গোড়ার চিন্তা মানে কেমন? গোড়ার চিন্তা সবসময়ই সহজ ও সরল হতে বাধ্য। অর্থাৎ যা নিয়ে যে কোনো মানুষই ভাবতে সক্ষম। ভাবেও, কারণ মানুষমাত্রই ভাবুক। কিন্তু তথাকথিত ‘বিশেষজ্ঞ’ বা যাকে ইংরেজিতে স্টাইলাইজড চিন্তা বলা হয়, বিশেষ কায়দায় রপ্ত করা ভাষায় কথা বলা বা প্রশ্ন করা, সেটা সজীব চিন্তার জন্য বিপদ ডেকে আনে। সাধারণ মানুষকে কায়দাদুরস্ত বিশেষজ্ঞ চিন্তা টেররাইজ করে। আতংকিত করে তোলে। সাধারণ মানুষের মধ্যে এ ধারণা জাগিয়ে তোলা হয় যে, তার স্বাভাবিক চিন্তা কোনো চিন্তাই নয়। ‘শিক্ষিত’ বা বিশেষজ্ঞদের মতো কথা না বললে সেটা চিন্তা নয়। এখন শিক্ষা সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞরা যখন কথা বলে তখন সাধারণ মানুষ মনে করে, শিক্ষা নিয়ে কোনো চিন্তা করার অধিকার বা ক্ষমতা কিছুই তাদের নাই। জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেও এটা সত্য। আলেম-ওলেমারা মনে করেন, ধর্ম নিয়ে তারা ছাড়া আর কেউ কথা বলতে পারবেন না, ধর্ম সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দেয়ার অধিকারী শুধু তারা, তারাই ধর্ম বিষয়ে ‘বিশেষজ্ঞ’। সজীব চিন্তার জন্য মুশকিল পরিবেশ সর্বত্রই বিরাজমান।
তাহলে গোড়ার চিন্তা মানে কোনো স্টাইলাইজড বা বিশেষজ্ঞ চিন্তা নয়। আমরা বলছি, অতি সাধারণ মানুষ শিক্ষা নিয়ে যেসব প্রশ্ন করে সেসব প্রশ্নের কথা। তা ঘিরে তার চিন্তার আবর্তন, যার ওপর সমাজের গতিপ্রকৃতি নির্ভর করে, সেই দিক। সেই সব প্রশ্ন তারা বিশেষজ্ঞদের সামনে করতে সাহস পায় না। কারণ অনেক সময় বেকুবদের সমাজে তাকে বেকুব হয়ে যেতে হয়। স্টাইলাইজড বা বিশেষজ্ঞবাদী চিন্তা, নীতি, পরিকল্পনা ইত্যাদির কারণে পুরো সমাজ বেকুবদের সমাজে পরিণত হতে পারে। কারণ মানুষের চিন্তা বা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবুকতা সেই সমাজ থেকে বিতাড়িত হয়। সেই সমাজে সহজ, সাবলীল স্বতঃস্ফূর্ত চিন্তার আর কোনো ভূমিকা থাকে না। সমাজে বিদ্যমান মতাদর্শ ক্রমে ক্রমে পাথর হয়ে সমাজের চিন্তাশীলতার টুঁটি টিপে ধরে। বিদ্যমান ‘মত’ বা ‘মতাদর্শে’র শৃংখল থেকে আর বেরুতে পারে না। খাবি খেতে থাকে। তখন মানুষের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ গোড়ার প্রশ্নও হয়ে ওঠে বেকুবের মতো প্রশ্ন। অধিকাংশ সময় বেকুবদের জগতে চিন্তাশীল প্রশ্নও বেকুব প্রশ্ন হিসেবেই হাজির হয়। অর্থাৎ যেসব প্রশ্ন বেকুবের মতো শোনাবে বলে আমরা ভয়ে আর করতে চাই না। গোড়ার চিন্তার চরিত্র এমনই। অথচ মানুষের জীবনের জন্য সেই চিন্তাগুলোই সবচেয়ে বেশি জরুরি।
আশা করি বোঝাতে পেরেছি গোড়ার চিন্তা মানে তথাকথিত বিশেষজ্ঞদের চিন্তা নয়। যেমন শিক্ষা সম্পর্কে খুবই সাধারণ অথচ গোড়ার একটি প্রশ্ন হচ্ছে তথাকথিত ‘শিক্ষা’র দরকারটাই বা কী? এটা তো আসলে সহিংস না হলেও এক ধরনের বল প্রয়োগের মতো, যাতে একটি শিশু বা কিশোর-কিশোরীর চিন্তাভাবনা দৃষ্টিভঙ্গিকে বিদ্যমান সমাজের অধিপতি চিন্তার অধীনে নিয়ে আসা হয়। নিয়ে আসা হয় তাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য, তাকে বিদ্যমান মতাদর্শের দাসে পরিণত করাই শিক্ষার কাজ।
এর পরিণতি ভয়ংকর। এখন আমরা যাকে শিক্ষা বলি, তার কাজ হচ্ছে আমাদের শিশুদের ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী মতাদর্শের গোলাম তৈরি করা। ইউরোপের কাছ থেকে আমরা শিখব না তা নয়। কিন্তু তা নির্বিচার হতে পারে না। কিন্তু আমরা অনুকরণ ছাড়া আর কিছুই আজও স্বাধীনভাবে করতে জানি না। পরাধীন মনমানসিকতা দীর্ঘস্থায়ী হওয়া ভয়ংকর ব্যাপার। পরাধীনতার চর্চাকেই আমরা বলি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি। তাহলে এ শিক্ষার কী দরকার যা আমাদের আজও গোলাম করে রাখে? স্বাধীন ও স্বতঃস্ফূর্ত সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে যে শিক্ষার কোনো ভূমিকাই নাই সেই শিক্ষা দিয়ে আমরা কী করব? শিক্ষা নিয়ে যদি আমরা গোড়ার চিন্তা শুরু করি, তাহলে এ দিকগুলো নিয়েই তো ভাবতে হবে। তখন আমাদের প্রথম কাজ হয়ে ওঠে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা উৎখাত, নিদেনপক্ষে তার সংস্কার বা রূপান্তর। কিন্তু ইন্টারেস্টিং দিক হল, আমরা সেটা বলি না। আমরা বলি, কওমি মাদ্রাসাসহ সব ধর্মীয় শিক্ষালয়গুলোকে ‘আধুনিক’ করতে হবে। এর কারণ আমাদের পরাধীন চিন্তায় আমরা যাকে ‘শিক্ষা’ বলি তার সঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষা মেলে না। অতএব মার্কিন যুদ্ধের নীতি প্রয়োগ করে মাদ্রাসাগুলো ভাঙো, তাদের জন্য নতুন শিক্ষা আইন ও শিক্ষানীতি চাপিয়ে দাও, ইত্যাদি।
মাদ্রাসা ধোয়া তুলসিপাতা নয়। তারও পর্যালোচনার দরকার আছে। সাধারণ মানুষ সেটা করেও বটে। মাদ্রাসা শিক্ষারও সংস্কার দরকার আছে। সেটা তর্কের বিষয় নয়। আমি মনে করি, আলেম-ওলামারা সেটা চান এবং কীভাবে সেটা সম্ভব সে ব্যাপারে তারা যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন। কথা হচ্ছে একমুখী শিক্ষা, সবার জন্য একই রকম শিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করা- এ সবকিছুরই উদ্দেশ্য নিজেদের স্বাধীন বিকাশের কথা না ভেবে পরাধীনতা ও অনুকরণের অন্ধকারে খাবি খাওয়া। পরাধীন থাকার প্রক্রিয়া জবরদস্তি চাপিয়ে দেয়া। বলাবাহুল্য, আলেম-ওলামা-মাশায়েখরা এর বিরুদ্ধে লড়ছেন। তারা ‘আধুনিকদের’ মতো পরাধীন মনের অধিকারী নন।
যদি দর্শনের বৃহৎ পরিসর বাদ দিয়ে আমরা রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে শিক্ষা নিয়ে গোড়ার প্রশ্ন তুলি, তাহলে কীভাবে সেটা তুললে ফলপ্রসূ হতে পারে? আরও সহজ জায়গায় আসি। আমরা দাবি করি যে আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। আমরা গণতন্ত্র চর্চা করতে চাই। সবাই গণতন্ত্র চায়! হা হা হা। সেটা না হয় মেনে নিলাম। তাহলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক বিচার খুবই গুরুতর একটি বিষয়। কীভাবে সেই সম্পর্ক আমরা বিচার করব? সেক্ষেত্রে অর্থাৎ গণতন্ত্রের দিক থেকে শিক্ষাব্যবস্থা সংক্রান্ত গোড়ার চিন্তা কী হতে পারে? সেটা এব্স্ট্রাক্ট বা বিমূর্ত চিন্তা হলে হবে না। খুব কংক্রিট ও ঐতিহাসিক হতে হবে। এ পরিপ্রেক্ষিতেই মনে পড়ল সিস্টার্স অব দ্য হোলি নেইমস অফ জেসাস অ্যান্ড মেরি। এখন সে বিষয়ে কিছু কথা বলে শেষ করব।
দুই
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন দেশে বিস্তর অভিবাসীর আগমন ঘটেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রটেস্টান্টদের প্রাধান্য। অভিবাসীদের ধর্মীয় বিশ্বাস যেন সমাজকে ‘কলুষিত’ না করে তা ঠেকানোর জন্য তারা পাবলিক বা সরকারি স্কুলগুলোকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার কথা ভাবল। যাদের প্রটেস্টান্টরা বিশেষভাবে ভয় পাচ্ছিল তারা হল ক্যাথলিক। যদি সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে বেসরকারি প্রাইভেট শিক্ষাব্যবস্থা চালু থাকে, তাহলে সমাজে ক্যাথলিক চিন্তার শক্তি বৃদ্ধি হয়। তো এর সমাধান হিসেবে ৭ নভেম্বর ১৯২২ সালে অরেগন রাজ্য তাদের ‘বাধ্যতামূলক শিক্ষা আইন’ (Compulsory Education Act) সংশোধন করল। আইন সংশোধনের উদ্দেশ্য ছিল যেসব ধর্মীয় স্কুল সরকার বা রাষ্ট্রের কোনো সহায়তা বা হস্তক্ষেপ ছাড়া নিজেদের অর্থে ও স্বাধীনভাবে পরিচালিত হচ্ছিল, তাদের নিয়ন্ত্রণ করা। জনগণের চাঁদায় জনগণ নিজেদের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষা চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থা, বিশেষত ধর্ম শিক্ষা- যার মধ্যে ক্যাথলিক স্কুলগুলো বিশেষভাবে অন্তর্ভুক্ত- সেই শিক্ষা বেসরকারি পর্যায়ে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেন চালু থাকতে না পারে, তা নিশ্চিত করাই ছিল বাধ্যতামূলক শিক্ষা আইন সংশোধনের উদ্দেশ্য। অরেগন রাজ্য ক্যাথলিক কিংবা অন্য বিশ্বাসে দীক্ষিত বা শিক্ষিত হয়ে যাওয়ার ভয় থেকে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়।
বাধ্যতামূলক শিক্ষা আইনে ৮ থেকে ১৬ বছর বয়সীদের অবশ্যই সরকারি বিদ্যালয়ে আসতে হতো। কিন্তু সেখানে ব্যতিক্রম ছিল। যারা ঘরে বসে পড়ছে, বা অন্যত্র বেসরকারি উদ্যোগে পড়ছে, তারা তাদের মতো করে পড়ত। তাছাড়া প্রাইভেট বা বেসরকারি স্কুল তো ছিলই, রাজ্য সরকার যাদের নিজেদের মতো করে পাঠদান ও শিক্ষার স্বীকৃতি দিত। নতুন সংশোধনী এই সুযোগ বা ব্যতিক্রমগুলোকে নাকচ করে দিল। পাবলিক স্কুলের বাইরে আর কোনো পড়াশোনা হবে না। সবাইকেই রাজ্য বা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন শিক্ষাব্যবস্থার অধীন হতে হবে।
নতুন সংশোধন কার্যকর হল ১ সেপ্টেম্বর ১৯২৬। কিন্তু বেসরকারি স্কুলগুলো এ আইন মেনে নিল না। এই সংশোধনীর বিরুদ্ধে দুই ধরনের বিরোধিতা দেখা গেল। এক ধরনের বিরোধিতা ছিল বেসরকারি হিলার মিলিটারি একাডেমির পক্ষ থেকে। তারা আদালতে নালিশ জানাল। তাদের কথা হল, প্রাইভেট স্কুল হিসেবে তাদের বেসরকারি ব্যবসার অধিকার ক্ষুণœ করা হয়েছে। শিক্ষা বেচাকেনারও বিষয়। অতএব নাগরিক হিসেবে সেক্যুলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমি কাকে কী শিক্ষা দেব সেটা আমার এবং আমার দেয়া শিক্ষা যারা তাদের সন্তানদের জন্য চাইছে তাদের বিষয়। রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী আমার ব্যবসায়িক অধিকার ক্ষুন্ন করার সংশোধনী আনতে পারে না। দ্বিতীয় প্রকার নালিশ নিয়ে আদালতে গেল সোসাইটি অব দ্য সিস্টার্স অব দ্য হোলি নেইমস অব জেসাস অ্যান্ড মেরি। এটি একটি ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
সিস্টার্স ব্যবসার কথা তুলেছিল, কিন্তু সেটা ছিল গৌণ। কোথায় নিজেদের বাচ্চাদের পড়াবে কী পড়াবে না, মা-বাবার সেটা পছন্দ করার অধিকারের কথা তারা তুলেছিল। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ধর্ম চর্চার অধিকার। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ধর্ম চর্চার অধিকারে হস্তক্ষেপ বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এটা প্রাইভেট ব্যাপার। সরকারি স্কুলে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে ধর্ম শিক্ষা বাদ দেয়ার পক্ষে যুক্তি আছে, কারণ সরকারি স্কুলের পয়সা রাষ্ট্র জোগায়। কিন্তু বেসরকারি বা প্রাইভেট স্কুলে মা-বাবারা কোথায় তাদের সন্তানদের পড়াবে সেটা রাষ্ট্র বা সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এটা তাদের প্রাইভেট ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নীতির পরিপন্থী।
এ নালিশের ভিত্তিতে আদালতের যে সওয়াল জবাব ও রায়, তা সেক্যুলার গণতান্ত্রিক দেশে রাষ্ট্রের সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থার সম্পর্ক বিচারসংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ রায়। ১৯২৫ সালে সওয়াল-জবাব হয়। রায় দেয়া হয় ১ জুন ১৯২৫ সালে। এই বিচার ‘পিয়ার্স বনাম সোসাইটি অব সিস্টার্স অব দ্য হোলি নেইমস অব জেসাস অ্যান্ড মেরি’ নামে পরিচিত।
সিস্টার্সের নালিশ ছিল এই যে,the enactment conflicts with the right of parents to choose schools where their children will receive appropriate mental and religious training, the right of the child to influence the parents' choice of a school, the right of schools and teachers therein to engage in a useful business or profession. (268 U.S. 510, 532).
অর্থাৎ শিক্ষা আইনের সংশোধনী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের চতুর্থ অ্যামেন্ডমেন্টের বিরোধী। যেমন, স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চা করার অধিকার। দ্বিতীয়ত, সম্পত্তি রক্ষা। স্কুলের সঙ্গে বাচ্চাদের বাবা-মায়ের ব্যবসায়িক চুক্তি রয়েছে, যা স্কুলের আর্থিক আয়ের উৎস। তাহলে সম্পত্তি রক্ষা করার রাষ্ট্রীয় দায়ও শিক্ষা আইন সংশোধনীর ফলে লংঘিত হয়েছে।
এই বিচার গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, রায় বেসরকারি স্কুলের পক্ষে গিয়েছে। অর্থাৎ বিচারকরা সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, নতুন সংশোধনী মার্কিন সংবিধানের বিরোধী। নাগরিকদের গণতান্ত্রিক বা নাগরিক অধিকার এই সংশোধনী ক্ষুন্ন করে। অতএব তা বাতিল। গণতন্ত্রের অর্থ হচ্ছে, স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চার অধিকার। ধর্ম শিক্ষা দেয়া ও পাওয়া সেই অধিকারের অংশ। রাষ্ট্র তা কেড়ে নিতে পারে না।
সওয়াল-জবাব ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বিস্তারিত আলোচনা এখানে সম্ভব নয়। রাষ্ট্র পক্ষ থেকে এ রকম দাবিও করা হয়েছিল- শিশুরা হচ্ছে ‘রাষ্ট্রের শিশু’, অতএব রাষ্ট্রের এখতিয়ার রয়েছে আগামী দিনের নাগরিক ও ভোটার কী ধরনের শিক্ষা পাচ্ছে তা নিয়ন্ত্রণ করার। সরকার পক্ষ দাবি করল, রাষ্ট্রের এই এখতিয়ার আছে। এ এখতিয়ার অভিভাবকরা কোথায় বাচ্চা পড়াবে এবং শিক্ষার্থী কী ধরনের শিক্ষা চায় সে বিষয়ে তার মা-বাবাকে প্রভাবিত করার অধিকারকে অতিক্রম করে যায়। অতএব শিক্ষা আইন সংশোধনী বৈধ।
স্কুলের পক্ষে বলা হল, শিশুদের কীভাবে স্কুল শিক্ষা দিচ্ছে রাষ্ট্র তা মনিটর বা তদারক করবে, তারা সেটার বিরোধিতা করছেন না। এতে কোনো অসুবিধা নাই। কিন্তু রাষ্ট্র চাইছে পুরো শিক্ষাব্যবস্থার ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এ ধরনের ক্ষমতা রাষ্ট্রের নাই, থাকতে পারে না। বাচ্চারা কোথায় যাবে, কী শিক্ষা নেবে তা নিয়ন্ত্রণের কোনো এখতিয়ার রাষ্ট্রের থাকতে পারে না।
দশ সপ্তাহ ধরে সওয়াল জবাব চলে। বিচারকদের একজন বললেন, বাচ্চারা ‘রাষ্ট্রের জীবজন্তু নয়’ (not the mere creature[s] of the state)। মার্কিন সংবিধান অনুযায়ী লিবার্টি বা স্বাধীনতা কথাটার প্রকৃতি এমন যে, শিক্ষার্থীরা কোথায় কীভাবে শিক্ষা নেবে তার সিদ্ধান্ত নেয়া রাষ্ট্রের কাজ নয়। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে নিরস্ত করা হয়েছে। শুধু সরকারি বিদ্যালয় থেকে সরকারি শিক্ষাই ছাত্রদের নিতে হবে এমন জবরদস্তি রাষ্ট্র করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে দায়িত্ব বাচ্চাদের বাবা-মা বা অভিভাবকদের। মার্কিন সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী এই এখতিয়ার বাবা-মা ও অভিভাবকদের দিয়েছে। রাষ্ট্রের আইনের দ্বারা কর্পোরেশনের ক্ষতি হলে কোনো চুক্তিকে ‘সম্পত্তি’ বিবেচনা করে রক্ষা করতে হবে, আদালত তা মেনে নেয়নি। তবে অন্যায় বা অবৈধভাবে চাপিয়ে দেয়া আইনে ক্ষতি করার অধিকার রাষ্ট্রের নাই।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্কের চরিত্র বিচার নিয়ে এই রায় একটি যুগান্তকারী রায় বলে গণ্য করা হয়। এ রায়ে শিক্ষার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের এখতিয়ারের সীমা যেমন নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে, একইভাবে বাবা-মা বা অভিভাবকরা কোথায় তাদের সন্তানদের পড়াবেন তার অধিকারকেও গণতান্ত্রিক নাগরিক অধিকার হিসেবে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। সেক্যুলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ধর্মকে ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে গণ্য করে বটে; কিন্তু একই সঙ্গে ধর্ম চর্চার পূর্ণ অধিকার, যার মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া ও নেয়ার অধিকার অন্তর্ভুক্ত, সেই অধিকারও মান্য করে।
গণতন্ত্রে রাষ্ট্র ও শিক্ষাব্যবস্থার সম্পর্ক কী? এটাও তাহলে একালে খুবই গোড়ার একটি প্রশ্ন। যদি এই প্রশ্ন সহজ ও সরলভাবে আমরা তুলতে শিখতাম, তাহলে ব্যবহারিক বা আইনি দিক থেকে এর মীমাংসা কী হতে পারে সেটা মার্কিন আদালতে শিক্ষাব্যবস্থা বিষয়ে অরেগন রাজ্যের সংশোধনীর বিরুদ্ধে সিস্টার্স অব দ্য হোলি নেইমস অব জেসাস অ্যান্ড মেরির নালিশ ও তার রায় সম্পর্কে আমরা খোঁজ রাখতাম।
কিন্তু গণতন্ত্রে আমাদের আগ্রহ নাই। আমাদের উৎসাহ ফ্যাসিবাদে। আমরা ইসলাম নির্মূল করতে চাই। মাদ্রাসা তুলে দিতে চাই। সেটা চাই একমুখী শিক্ষা, যুগোপযুগী শিক্ষা ইত্যাদি নানান কিসিমের বেয়াড়া চিন্তার মাধ্যমে। শিক্ষাব্যবস্থাকে কেন্দ্রীভূত ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের অধীনস্থ করার প্রতি আমাদের উৎসাহ প্রবল।
এতটুকু যদি বুঝি তাহলে ১৭ অক্টোবর আলেম-ওলামারা মাদ্রাসা শিক্ষা সম্পর্কে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার সঙ্গে মাদ্রাসা বা ধর্মীয় শিক্ষার সম্পর্ক একান্তই বাহ্যিক। আলেম-ওলামাদের দাবি বলে এটা ইসলামী দাবি নয়। বরং তাদের দাবি-দাওয়া একান্তই গণতান্ত্রিক। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাষ্ট্রের সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থার সম্পর্ক বিচারের প্রশ্ন। এখানে ইসলামী কিছু নাই। অথচ গণতন্ত্রের সারকথা আছে। মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে আলেম-ওলামারা যে আন্দোলন করছেন, তা চরিত্রের দিক থেকে গণতান্ত্রিক আন্দোলন।
তারা বলছেন,
১. প্রস্তাবিত কওমি মাদ্রাসা শিক্ষানীতি ২০১২ এবং এর আলোকে তৈরি কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ আইন ২০১৩-এর খসড়া বাতিল করতে হবে।
২. ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে গঠিত ৯ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির সব কার্যক্রম বাতিল করতে হবে। যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার নামে কওমি মাদ্রাসার স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য বিলুপ্ত হয় এমন যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে সরকারকে বিরত থাকতে হবে।
৩. দেশের ৯২ ভাগ মুসলমানের সন্তানদের ইসলামের বুনিয়াদি শিক্ষা দেয়া ফরজে আইন। আবহমান কাল থেকে এ ফরজে আইনের কাজটিই আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে। এই অধিকার নিশ্চিত করা ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করার রাষ্ট্রীয় দায়ের সঙ্গে যুক্ত। রাষ্ট্র ধর্মের শিক্ষায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না। বিদ্যমান সব নূরানি মক্তব, হাফেজিয়া ও কওমি মাদ্রাসা, পুরনো ও নতুন মক্তব, হাফেজিয়া ও কওমি মাদ্রাসা স্থাপন ও পরিচালনাকে সরকারি নিবন্ধনের আওয়াতামুক্ত রাখতে হবে।
৪. জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এবং এর আলোকে প্রণীত শিক্ষা আইন ২০১৬-এর খসড়া অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। কারণ এগুলো গণতান্ত্রিক রীতিনীতির বিরোধী।
তাদের এ দাবিগুলো আমি সমর্থন করি। উপরের প্রতিটি দাবি গণতান্ত্রিক অধিকারের সঙ্গে পুরাপুরি সঙ্গতিপূর্ণ। সমাজে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের ক্ষেত্রে তাদের এই আন্দোলন ও সংগ্রামের তাৎপর্য আশা করি আমরা উপলব্ধি করতে সক্ষম হব। গোড়ার চিন্তা করার ক্ষমতা আমাদের বাড়ুক, এই কামনা করি।
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন