একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদারেরা একটা মরণ কামড় বসাতে চেয়েছিল বাঙালিদের বুকে-তারা এই জাতিকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। পাকিস্তানিরা জানত তাদের পরাজয় সময়ের ব্যাপার মাত্র, তবে তা ছিল মাত্র ৪৮ ঘণ্টার দূরত্বে, তারা হয়তো তা কল্পনা করতে পারেনি। তবে তাদের লক্ষ্য থেকে তারা বিচ্যুত হয়নি। পরাজয়ের গ্লানি ও বেদনা তারা ঢেকে দিতে চেয়েছিল এ দেশের সবচেয়ে দীপ্যমান কিছু মনীষীর জীবনের সমাপ্তি ঘোষণা করে। রায়েরবাজারের বধ্যভূমি পাকিস্তানিদের গ্লানি ভুলে যাওয়ার একটা সুযোগ করে দিয়েছিল।
কাপুরুষতারও একটা সীমা থাকে। পাকিস্তানিদের তা-ও ছিল না। তারা নিরস্ত্র, অরক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের বাড়িতে বাড়িতে হানা দিয়ে তাঁদের হাত-পা-চোখ বেঁধে গাড়িতে তুলে রায়েরবাজারে নিয়ে এল এবং নৃশংসভাবে তাঁদের হত্যা করল। পাকিস্তানিরা ধরে নিয়েছিল, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে তারা বাঙালি জাতিকে বুদ্ধিহীন করে যাবে, যাতে এই জাতি কোনো দিন বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে।
তাদের ভাবনায় দুটি মারাত্মক ভুল ছিল। প্রথম ভুলটি ছিল বুদ্ধিজীবীদের সংজ্ঞা নিয়ে, দ্বিতীয়টি বাঙালিদের সক্ষমতা নিয়ে। বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী বলতে অবশ্যই সুশিক্ষিত চিন্তাশীল এবং তত্ত্ব-তথ্যে সুপণ্ডিত একটি শ্রেণি আছে, কিন্তু এ দেশের নিম্নবর্গীয় চিন্তায়ও বুদ্ধিজীবী বলে এমন কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা তাঁদের নিত্যদিনের কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের বুদ্ধির সক্রিয়তাকে জাগিয়ে রাখেন-তাঁদের মধ্যে শিক্ষক বা সাংবাদিক যেমন, তেমনি আছেন কারখানার শ্রমিক অথবা খেতমজুর, যাঁদের বুদ্ধিচর্চা কলকারখানার উৎপাদন বাড়াচ্ছে, রপ্তানি বাণিজ্যের বিকাশ ঘটাচ্ছে এবং সামাজিক সমাবেশের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে। পাকিস্তানে এই নিম্নবর্গীয় বা সাব-অল্টার্ন বুদ্ধিজীবী হয়তো নেই; আমাদের আছে। ফলে একাত্তরে বছরজুড়ে এবং ১৪ ডিসেম্বর বিশেষ পরিকল্পনা নিয়ে পাকিস্তানিরা বুদ্ধিজীবী হত্যা করলেও বাংলাদেশে বুদ্ধিচর্চা অব্যাহত রয়ে গেছে।
ওই দিন পাকিস্তানিরা কিছু অসামান্য প্রতিভাধর বাঙালিকে নিধন করে ভেবেছে, তাদের পথচলা নিষ্কণ্টক হয়েছে। তারা ভাবেনি, বাঙালির সক্ষমতা শুধু সৃজনশীল নয়, মননশীলও বটে। ফলে একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বরের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের পরও বাঙালি আত্মসমর্পণ করেনি, স্তম্ভিত হয়ে যায়নি, ভয় পেয়ে চুপ করে যায়নি। বরং তাদের যুদ্ধটা চালিয়ে গেছে। পাকিস্তানিদের গুঁড়িয়ে দেওয়ার, আমাদের গৌরব পুনরুদ্ধার করার লক্ষ্যে স্থির থেকেছে।
গত ৪৬ বছরে ১৪ ডিসেম্বরকে আমার মনোযোগের কেন্দ্রে রেখে মনে হয়েছে বাঙালিদের কোনো একটি সত্তা অন্য সব প্রকাশকে নিয়ন্ত্রণ করেনি, বরং একটি সমবায়ী সত্তাই সর্বত্র বিরাজমান ছিল। এই সমবায়ী সত্তায় লীন হয়েছিলেন যোদ্ধারা, দেশের ভেতরে আইনে পড়া বাঙালি নাগরিকেরা, স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতারা। আমরা নানা নামে তাঁদের ডেকেছি, কিন্তু একটি নাম ইতিহাসে স্থান পেয়েছে-মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তরজুড়ে মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন অগ্রবর্তী ভূমিকায়। তাঁদের নেতৃত্ব সবাই মেনে নিয়েছিল এবং এক অভিন্ন উদ্দেশ্যে ও লক্ষ্যে ধাবিত হচ্ছিল।
পাকিস্তানিদের হিংস্রতা, বর্বরতা অথবা যুক্তিহীনতাকে আমি বুঝতে পারি, কিন্তু কিছুতেই বুঝতে সক্ষম হই না তাদের সঙ্গে কিছু বাঙালির গাঁটছড়া বাঁধার বিষয়টিকে। যারা গাঁটছড়া বেঁধেছিল, তাদের কয়েকটি উদ্দেশ্য ছিল। প্রথম উদ্দেশ্য ছিল, ক্রমাবনতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নিজেদের সংহত করে ফায়দা আদায় করা। দ্বিতীয় একটি উদ্দেশ্যও ছিল, পাকিস্তানের সঙ্গে স্থায়ী ও সৌভ্রাতৃত্বমূলক একটি সম্পর্ক গড়ে তোলা। স্বাধীনতার প্রাক্কালে তাদের এই প্রত্যাশা যখন সুদূরপরাহত হয়, এসব মানুষ উগ্রবাদী ও পাকিস্তানপন্থী একটি চিন্তার সমর্থক হয়ে দাঁড়াল। স্বাধীনতার পরও এরা থেকে গেল। এখনো তারা আছে এবং মাঝে মাঝেই তাদের বীভৎসতা তারা জানান দেয়।
স্বাধীনতাপ্রাপ্তির ৪৬ বছর পার হলো। প্রশ্ন হলো আমাদের শ্রেষ্ঠ কিছু সন্তান মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে যখন নিহত হলেন, আমরা কি সত্যিই তাঁদের আত্মদানের বিষয়টি মাথায় রেখে অগ্রসর হয়েছি? তাঁদের যথাযথ মূল্যায়ন কি আমরা করেছি? তাঁদের থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে আমরা কি রাষ্ট্র গঠন করেছি?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর এককথায় বলতে গেলে, না। আমরা অন্যের আত্মদান পছন্দ করি, কিন্তু নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করি এবং কোনো বিবাদের মাঝখানে দাঁড়াতে চাই না। কূটনীতির বিচারে হয়তো এটি ঠিক, কিন্তু নৈতিকতার বিচারে অবশ্যই নয়। আমরা যদি বৃহৎ শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে আমাদের পরিচিতি, আমাদের সত্তা এবং আমাদের ইতিহাস, সমাজ ও মানুষ নিয়ে চিন্তার পরম্পরাকে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারি, তাহলে আমরা বিশ্বসভায় সম্মানের আসনে বসতে পারব না।
কাজেই ১৪ ডিসেম্বর শুধু কয়েকজন শহীদকে স্মরণ করলেই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। আমাদের বরং এমন কিছু কাজ করতে হবে, এমন কিছু প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হবে যা আমাদের আত্ম-অনুসন্ধানের পথ উন্মুক্ত করবে। এবং আমাদের জাতিরাষ্ট্রের ভিত্তি সুদৃঢ় করতে সাহায্য করবে। সেই কাজ ও প্রশ্নগুলো এই-
ক. আমাদের প্রশ্ন করতে হবে, ১৪ ডিসেম্বর প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছিল। এদিন তো ভয় দেখিয়ে আমাদের নিষ্ক্রিয় করতে চেয়েছে বর্বর পাকিস্তানিরা। কিন্তু পাকিস্তানি উপনিবেশবাদের সুবর্ণ সময়ে উত্তর ঔপনিবেশিক কিছু বাণী আমরা আমাদের ইতিহাসের দেয়ালে লিখেছি তা দেখা।
খ. স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর আমরা নিশ্চয় এমন একটি অবস্থানে পৌঁছেছি, যাতে একাত্তরের বুদ্ধিজীবীদের হারানোর বেদনা ভুলে আমরা তাঁদের উত্তরসূরিদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু সেই উত্তরসূরিদের কি আমরা প্রস্তুত করতে পেরেছি? তাঁদের সব শূন্যতা কি আমরা মোচন করতে পেরেছি?
গ. একাত্তরের ওই শহীদেরা যে বাংলাদেশের স্বপ্ন চোখে নিয়ে চোখ বুজেছেন, সেই বাংলাদেশ কি আমরা তৈরি করতে পেরেছি?
ঘ. সবচেয়ে বড় কথা, এই ৪৬ বছর পর আমরা কি ১৪ ডিসেম্বরের শহীদদের আদর্শ, বিশ্বাস ও স্বপ্নের ধারক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি?
প্রশ্নগুলোর উত্তর আমার কাছে নেই। আমি জানি না। একাত্তরের ওই শহীদদের আমরা পূর্ণ মর্যাদা দিতে পেরেছি কি না। অথবা তাঁদের রেখে যাওয়া আদর্শকে আমরা প্রকৃতই আমাদের প্রতিদিনের কাজে-কর্মে স্থান দিতে পেরেছি কি না।
২.
কিছুদিন আগে এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে শুনলাম, একজন শ্রদ্ধাভাজন মুক্তিযোদ্ধা, যিনি একটি প্রশ্ন রেখেছেন-শহীদ বুদ্ধিজীবীরা একাত্তরে আদৌ কি কোনো বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন? তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ১৪ ডিসেম্বর আমরা যে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করি, এর পাশাপাশি তাঁর মতো অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান কি আমরা তেমন দৃঢ়তার সঙ্গে স্মরণ করি?
প্রাচীন চীনের এক বিখ্যাত সমরবিদ সুন জু লিখেছিলেন, একটি যুদ্ধ শুধু সৈন্যরা বা সেনাপতিরা করেন না, বরং তাতে দেশের নাগরিক সমাজের চিন্তাবিদ থেকে নিয়ে গৃহস্থরাও জড়িত থাকেন। সুন জু সেনাপতিদের উদ্দেশে বলেছিলেন, চোখ-কান খোলা রেখে একজন পুরোহিত থেকে প্রজ্ঞা ধার নিয়েও যুদ্ধ করো। আমরা জানি বুদ্ধিজীবীরাই প্রযুক্তির কর্ণধার-আধুনিক যুদ্ধের সরঞ্জাম তাঁদের জ্ঞান থেকেই তৈরি হয়। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা বাঙালির আত্মপরিচয় অর্জনে বারবার একটি ভূমিকা রেখেছেন। পাকিস্তানিরা এটি বুঝেছিল। তারা জানত, বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চিহ্ন করতে পারলে বাংলাদেশের মেরুদণ্ড দুর্বল হবে।
৩.
একাত্তরে যাঁরা তাঁদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শী চিন্তার জন্য পাকিস্তানিদের জিঘাংসার বলি হয়েছিলেন, তাঁদের আদর্শের বাংলাদেশ কি আমরা গড়তে পেরেছি?
উত্তরটি হ্যাঁ ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। আমরা অর্থনৈতিক উন্নতি করছি, কিন্তু শিক্ষার মান নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ক্রমাগত পেছনে চলছি।
আমরা সামাজিক বৈষম্য দূর করার পরিবর্তে তো আরও প্রকট করছি। আমরা শিশুদের সুরক্ষা দিতে পারিনি: আমরা সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জনগণকে আমাদের সমান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে পারিনি। আমরা তরুণদের স্বপ্ন দেখাতে ব্যর্থ হয়েছি। আমরা আমাদের রাজনীতিকে হানাহানি, সংঘাত ও কুতর্কের বিবরে ফেলে দিয়েছি।
আমরা বাংলাদেশের পরিবেশ ও নৈসর্গিক ভারসাম্য রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছি। আমরা দরিদ্রকে আরও দরিদ্র এবং ধনীদের আরও ধনী হতে সাহায্য করেছি।
তালিকাটি আরও অনেক দীর্ঘ করা যায়। কিন্তু এর ইতি টানা যায় এই বলে যে আমরা একাত্তরের চেতনাকে শুধু যে অবহেলা করেছি তা নয়, এর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতাও করেছি।
৪.
একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বরের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আজ শুধু এ কথাই বলব, আপনাদের প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া বাংলাদেশে আপনাদের আদর্শ আমরা ধরে রাখতে পারিনি।
তবে যারা তরুণ, একাত্তরে যাদের জন্মই হয়নি, তারা একদিন নিশ্চয় তা করবে। তারুণ্যের ওপর আমার যে বিশ্বাস, তা থেকেই কথাগুলো আমি বলছি।
৫.
একদিন বাংলাদেশ সত্যিকার সোনার বাংলা হবে। ইতিহাস তাই বলে। অহংকারী, আত্মম্ভরী অথবা বিভ্রান্ত কিছু মানুষ যা-ই বলুক।
বাংলাদেশের মাটিতে কান পাতলে সেই সত্য শোনা যায়। একদিন বাংলাদেশ একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রকৃত সম্মান দেখাবে। আজ না হলেও।
আমি এবং আমরা সেদিন না থাকলেও।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন