ব্যক্তিগতভাবে আমি সংবাদপত্রের লোক নই, এই অর্থে যে সংবাদপত্রে নিয়মিত লেখালেখি করলেও পেশাগতভাবে আমি সংবাদপত্রে কখনো কাজ করিনি; ইচ্ছে ছিল সাংবাদিক হওয়ার, হওয়াটা হয়ে ওঠেনি; কিন্তু আমি সংবাদপত্রের জগতের লোক বৈকি। পাঠক হিসেবে এবং লেখক হিসেবে। লেখক হিসেবে যুক্ত থাকাটা একটি অতিরিক্ত পাওনা, কিন্তু শুধু যদি পাঠকই হতাম ও থাকতাম, তা হলেও নিজেকে সংবাদপত্রের জগতের লোক মনে করতাম। আমি একা নই, ব্যতিক্রম নই, সংবাদপত্রের অগুনতি পাঠকও নিজেদের সেভাবেই দেখেন। ছেলেবেলায় আমরা থাকতাম এক মফস্বল শহরে, দিনের খবরের কাগজ সেখানে সন্ধ্যার আগে পৌঁছাত না, কিন্তু বিকাল হলেই প্রতীক্ষা শুরু হতো তার আগমনের জন্য। আমার স্ত্রীর সঙ্গে তার ছোট ভাইয়ের ‘সারাজীবনে’র আড়ি হয়ে গিয়েছিল খবরের কাগজ এলে কে আগে দখলে নেবে সেটা নিয়ে। এসব ঘটনা প্রায় সব মধ্যবিত্ত পরিবারেই ঘটত কোনো না কোনোভাবে।
এখন শুনি ওসব নেই। সংবাদপত্রের জন্য অপেক্ষা না করলেও চলে, কাড়াকাড়ি করার দরকার পড়ে না, বোতাম টিপলেই খবর পাওয়া যায়। ইন্টারনেট আছে, রয়েছে অনলাইন, খবর আসে মোবাইলেও। কিন্তু এসব তো পড়া নয়, এসব হচ্ছে দেখা। দেখা ও পড়ার ভেতর বিস্তর ফারাক। দেখার জন্য দুচোখই যথেষ্ট, পড়ার জন্য চোখ অবশ্যই দরকার, কিন্তু সঙ্গে প্রয়োজন মনোযোগের, সর্বোপরি চিন্তার। চিন্তা ছাড়া পড়া সম্ভব নয়। সংবাদপত্রের দর্শক খবর চায়, গুজব পেলে খুশি হয়, অতিনাটকীয়তার অপেক্ষায় থাকে; ওদিকে পাঠক পড়তে পড়তে ভাবে, ভাবতে ভাবতে পড়ে, খবরের ভেতরে খবরের খোঁজ করে। বুঝতে চায়। এটা খুবই স্বাভাবিক যে, সব সময়ই দর্শক বেশি পাওয়া যাবে পাঠকের তুলনায়। আগেও তাই ছিল, এখনো তেমনি রয়েছে। তাই সংবাদপত্রের পাঠক অনাপেক্ষিকভাবে কমেছে এমনটা নয়, সংবাদপত্রের দর্শক বেড়েছে এটাই সত্য। জনসংখ্যার অনুপাতে পাঠক সব সময়ই কম ছিল, এমনকি যারা পড়ত বলে মনে হয় তারাও সবাই যে পড়ত তা নয়, কেউ কেউ দর্শক ছিল বৈকি।
আমার বাবা বলতেন একবার লেখা দশবার পড়ার সমান। মিথ্যা বলতেন না। এখন লেখার চলও কমেছে। লোকে চিঠি লিখতে চায় না, এসএমএস করে। কাগজের ব্যবহার কমছে। কেউ কেউ মনে করেন কাগজ উঠেই যাবে, চলে যাবে জাদুঘরে। আমি তা মনে করি না। কাগজ উঠে গেলে সভ্যতাও বদলে যাবে এবং ধারণা করি নতুন সেই সভ্যতা মানবিক থাকবে না, যান্ত্রিক হয়ে পড়বে। মানুষ নেই, যন্ত্রই শুধু আছে, এমন ব্যবস্থায় কাগজ কেন থাকবে? কাগজ থাকবে না; কিন্তু সেদিন তো আমরা, মানুষরাও থাকব না। আমরা মানুষরা নিশ্চয়ই সেটা হতে দেব না, জানপ্রাণ দিয়ে ঠেকাব।
লেখার প্রতি চ্যালেঞ্জটাও নতুন ঘটনা নয়। লিখতে না-জানার ব্যাপারটা তো ছিলই, ছিল টেলিগ্রাম, পরে এসেছে টেলিফোন। এখন এসেছে ইন্টারনেট ও মোবাইল। কিন্তু তবু লেখা রয়ে গেছে, রয়েছে পড়াও। লোকে চিঠিও লেখে। আগামীতেও লিখবে, কেননা চিঠি তো কানে কানে কথা বলা নয়, চোখে ইশারা করাও নয়; চিঠিতে লোকে নিজেকে ব্যক্ত করে, ব্যক্ত করে হাল্কা হয়, লিখতে লিখতে সমৃদ্ধ হয়, নিজেকে পৌঁছে দেয় অন্যের কাছে, অন্যকেও নিয়ে আসতে পারে নিজের কাছে। এই যে সমাজে এখন নানাবিধ মানসিক বৈকল্য দেখা যাচ্ছে; লোকে বিপন্ন থাকছে, আত্মহত্যা করছে, বৃদ্ধি পাচ্ছে হিংস্রতা ও বিচ্ছিন্নতা, বাড়ছে মাদকাসক্তি, প্রবল হয়ে উঠছে রক্তপাত, এসবের বড় কারণ আত্মপ্রকাশের বিঘœ এবং পারস্পরিক সহানুভূতি ও মৈত্রীর অসদ্ভাব।
লেখা তাই থাকবে। পড়াটাও থাকবে। থাকবে সংবাদপত্র। থাকবে সে খবরের কাগজ হিসেবেই। অর্থাৎ মুদ্রিত আকারে খবর থাকবে। হাল্কা খবর নয় শুধু, আঁতের খবরও। ব্যাখ্যা থাকবে, থাকবে মন্তব্য। খবর আর গুজব যে এক জিনিস নয়, বোঝা যাবে সেটা খবরের কাগজ পড়ে। এবং খবরের কাগজ পড়ার বস্তু হবে, দেখার নয়। ইন্টারনেটে, অনলাইনে তো আমরা দেখিই, পড়ি না। পড়া মানে মুদ্রিত অবস্থায় পড়া, হাতে ধরে পড়া। বই পড়ার মতো করে। সংবাদপত্র পড়ার জিনিস হিসেবে আমাদের হাতে থাকবে, থাকবে পাশে, টেবিলে, বিছানায়। পড়া হবে পথে, ট্রেনে-বাসে, অফিসে, চায়ের দোকানে, অবসরের আলোচনার ফাঁকে। প্রয়োজনে একাধিকবার পড়া যাবে। কাচের আড়াল থাকবে না পাঠক ও পঠিতের ভেতর। খবর নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলবে, চলবে মতামতের আদান-প্রদান। বই যেমন বই হয় না যদি না ছাপা ও বাঁধাই হয়ে হাতে আসে, সংবাদপত্রও তেমনি সংবাদপত্র হয় না কাগজে মুদ্রিত না হলে।
সংবাদপত্রে ছবি থাকবে, বিজ্ঞাপনও থাকবে; কিন্তু ছবি কোণঠাসা করবে না সংবাদকে। কিছুতেই নয়। কখনই নয়। সংবাদের সচিত্র হতে বাধা নেই, কিন্তু সংবাদই থাকবে প্রধান। খবরই থাকবে কর্তৃত্বে। মানতেই হবে যে, টেলিভিশনে ছবি পাওয়া যায়, ছবিই সেখানে মুখ্য, সে জন্য সংবাদগুলো সেখানে দ্বিমাত্রিক থাকে। সংবাদপত্রে সংবাদ ত্রিমাত্রিক, কেননা সেখানে সংবাদকে একই সঙ্গে দেখা ও পড়া যায়, পড়াই প্রধান হয়ে ওঠে, দেখাকে হটিয়ে দিয়ে। তা ছাড়া টেলিভিশনের খবর যেমন ছবি, নাটক-চলচ্চিত্রও তেমনি ছবি, কোনটা খাঁটি কোনটা মেকি তফাৎ করাটা সহজ থাকে না। ঝাপসা হয়ে যায়।
খবরের কাগজে খবর গভীরতা পায় সাংবাদিক অনুসন্ধানে এবং সম্পাদকীয় মন্তব্যে। অনুসন্ধান তো অবশ্যই, সম্পাদকীয়ও খুবই জরুরি বিষয়। যথার্থ সম্পাদকীয়ের অভাবে খবরের কাগজ ছাপা কাগজই থাকে শুধু, তার বেশি কিছু হয়ে ওঠে না। পরিষ্কার বক্তব্য ও মন্তব্য না থাকলে কোনো সম্পাদকীয়ই যথার্থ হয় না। ‘ব্যাপারটি প্রণিধানযোগ্য’, ‘ফলাফলের জন্য আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে’, ‘সময়ই বলে দেবে’, এ ধরনের বক্তব্য যদি সম্পাদকীয়র বৈশিষ্ট্য হয় তবে তা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য হবে। চাই উপসম্পাদকীয়ও; সেখানে মতাদর্শিক অবস্থান থাকবে, পাওয়া যাবে দার্শনিক গভীরতা। লেখক এগিয়ে আসবেন পাঠককে সাহায্য করতে; লেখার উদ্দেশ্য বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হবে না, হবে পাঠককে বুঝতে ও ভাবতে উদ্বুদ্ধ করা।
বিজ্ঞাপন ছাড়া খবরের কাগজ চালু রাখা কঠিন, কিন্তু বিজ্ঞাপন আসবে অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবেই, তাকে ছাড়া চলে না তাই। বিজ্ঞাপনকে স্থান দেওয়া হবে ওইভাবেই। সংবাদ কখনই, কোনোভাবেই বিজ্ঞাপন প্রচারের অজুহাত হবে না। সংবাদপত্রকে বিজ্ঞাপনপত্র হলে চলবে না। আর এটাও তো সত্য যে, বিজ্ঞাপনই যদি প্রধান হয় তা হলে পত্রিকাটি গভীরতাহীন দ্বিমাত্রিক বস্তুর রূপ নেয়, পত্রিকার গ্রহণযোগ্যতা যায় কমে, বিক্রয় সঙ্কুচিত হয়ে আসে; এবং তখন বিজ্ঞাপনও দ্বিধায় পড়ে হাজির হওয়ার প্রশ্নে। পত্রিকায় রঙঢঙ যত কম থাকে ততই ভালো, কারণ পত্রিকা তো পড়ার বস্তু, দেখার নয়।
এক কথায় সংবাদপত্র হবে সহযাত্রী বন্ধু। সমসাময়িক জগতে কী ঘটছে তা বুঝতে সাহায্য করবে, বর্তমানকে স্থাপন করবে সে ইতিহাসের ও দার্শনিক মতাদর্শের পটভূমিতে। আশা দেবে, দেবে ভরসাও।
কিন্তু এই জিনিস আমরা পাব কী করে? পত্রিকা তো চলে মালিকের ইচ্ছায় এবং মালিক মুনাফা বোঝেন, অন্যকিছু বোঝার আগে। মালিক চাইবেন তার মুনাফাটা বাড়–ক। রাষ্ট্রের কর্তারা কী চান তা তিনি দেখবেন, সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার খবর রাখবেন এবং তদনুযায়ী পাল খাটাবেন। রঙেঢঙে সাজিয়ে পত্রিকাকে তিনি বিনোদনের সামগ্রী করে তুলতে চাইবেন। চাইবেন অপরাধের খবর হৈচৈ করুক। খেলাধুলাকে প্রধান করে তুলতে চাইবেন, জ্ঞানবুদ্ধির খবরের তুলনায়। পাঠকের চোখ খুলে গেলে মালিকের ভারি অসুবিধা। পাঠক বিদ্যমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মোটেই সন্তুষ্ট নয়, সে চায় পরিবর্তন; অপরদিকে মালিক চান ব্যবস্থার চিরস্থায়িত্ব। দুয়ের অবস্থান একেবারে মুখোমুখি। এই দ্বন্দ্বে মালিক সবচেয়ে যা অপছন্দ করেন, যাকে ভয়ও পান তা হচ্ছে জ্ঞান। সংবাদপত্রের মধ্য দিয়ে পাঠককে তিনি আর যাই করুন প্রকৃত জ্ঞান সরবরাহ করতে চাইবেন না। চাইবেন বিনোদন দিতে, বিভ্রম সৃষ্টি করতে। খবর দেবেন নানারকমের অপরাধের, কিন্তু আড়াল করে রাখবেন মূল অপরাধীকে। অর্থাৎ পুঁজিবাদকে। অথচ দৃষ্টিসম্পন্ন যে কোনো মানুষ এখন বোঝেন যে, পুঁজিবাদ মানুষের মনুষ্যত্বকে, সভ্যতাকে এবং প্রকৃতিকে নির্মম হাতে ধ্বংস না করে ছাড়বে না। পুঁজিবাদকে পরাভূত না করতে পারলে পৃথিবীর এবং সেই সঙ্গে মানুষের বিপদ কাটবে না। সর্বাধিক প্রয়োজনীয় ওই জ্ঞানটি।
সংবাদপত্রের কাছ থেকে আমরা এসব চাইতে পারি, কিন্তু সংবাদপত্র এসব দেবে কেন? দেবে, যদি পুঁজিবাদবিরোধী তেমন একটা আন্দোলন গড়ে তোলা যায়, যাতে মালিক টের পান যে মানুষের পাশে না দাঁড়ালে তার কাগজ চলবে না এবং হয়তো এ-ও বুঝবেন তিনি যে, তার নিজের মানবিক ভবিষ্যৎটাও নিরাপদে নেই পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধির হাতে পড়ে। আসল ভরসা তাই আন্দোলনেই।
ভরসা আরেকটা জায়গাতেও আছে। সেটি হলো সাংবাদিকদের ভূমিকা। সাংবাদিকরা চাপ দিতে পারেন মালিকের ওপর। সংঘবদ্ধ হতে পারেন মুনাফা-লোলুপতার সঙ্গে মনুষ্যত্বের যে দ্বন্দ্ব তাতে মনুষ্যত্বের পক্ষে দাঁড়ানোর ব্যাপারে। প্রত্যেকটি সংবাদপত্রের বেলায় এমনটা ঘটতে পারে, ঘটতে পারে দেশের গোটা সংবাদপত্র জগতের ক্ষেত্রেও। ছোট একটা ভরসা হচ্ছে প্রতিযোগিতা। একটি সংবাদপত্রও যদি যথার্থ জ্ঞানের পক্ষে দাঁড়ায় তবে অন্য সংবাদপত্রও বাধ্য হবে ছাড় দিতে, পাছে পাঠক হারায়।
পুঁজিবাদবিধ্বস্ত আমরা, পাঠকরা বিপদের মধ্যে আছি, সংবাদপত্রও সে বিপদের বাইরে নয়। পাঠক চায় সংবাদপত্র তার বন্ধু হোক। নানা অর্থে। প্রথমত, এই অর্থে যে সংবাদপত্র সংবাদপত্রই থাকবে, দর্শনীয় ছবি না হয়ে। তাকে চায় পাঠযোগ্য হিসেবে, দর্শনযোগ্য হিসেবে নয়। খুব করে চায় এটা যে সে নিরপেক্ষ হবে না, দাঁড়াবে মানুষের পক্ষে। পাঠকের প্রত্যাশা বিবিধ ছলনা নয়, বিভ্রান্তি নয়; পাঠকের প্রত্যাশা সুস্পষ্ট পক্ষপাতিত্ব। পক্ষপাতিত্বটা থাকবে সংবাদে, থাকবে লেখাতেও।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন