সমাজ এখন তিন ভাগে বিভক্ত বলা যায়। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র। এটা নানাভাবে বোঝা যায়, টের পাওয়া যায় শিক্ষার দিকে তাকালেও। শিক্ষা এখন সমাজের মতোই খাড়াখাড়ি তিন ভাগ হয়ে গেছে- ইংরেজি মাধ্যম, বাংলা মাধম ও মাদ্রাসা। ইংরেজি মাধ্যম বিত্তবানদের জন্য, মধ্যবিত্তদের জন্য রয়েছে বাংলা মাধ্যম আর গরিব মানুষের ভরসা হচ্ছে মাদ্রাসা। শিক্ষার সঙ্গে সমাজে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক তো থাকবেই। শিক্ষা সমাজের ওপর ভর করেই দাঁড়িয়ে থাকে এবং সমাজের যে বাস্তবতা, তাকেই প্রতিফলিত করে। কিন্তু সত্য তো এটাই যে, শিক্ষা সমাজকে বদলে দেবে- এটাই আমরা আশা করি। নইলে ‘শিক্ষা শিক্ষা’ বলে অত করে আওয়াজ তোলা কেন? আমাদের প্রত্যাশা থাকে, শিক্ষা জাতি গঠনে সাহায্য করবে। তার অর্থ তো শিক্ষা সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করবে। কিন্তু বাস্তবে যা করছে সেটা তো দেখা যাচ্ছে সম্পূর্ণ উল্কল্টা ব্যাপার। ভিম্ন নয়, একেবারে উল্কল্টা। সমাজের ভেতর যে শ্রেণিবিভাজন শিক্ষা তাকে বাড়িয়ে তুলছে। শিক্ষার ৩ ধারা সমাজের ৩ ভাগকে পরস্পর থেকে আলাদা করে দিচ্ছে। শিক্ষা যত বাড়ছে, বিভাজন তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা একাধারে করুণ ও হাস্যকর।
উচ্চবিত্তদের ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা আর মাদ্রাসা শিক্ষার মধ্যে মিল থাকার কোনো ব্যাপারই আশা করা যায় না। দুটি দুই ধরনের। ইংরেজি মাধ্যমে সবকিছুই চলে ইংরেজি ভাষায় আর মাদ্রাসায় ইংরেজি যা পড়ানো হয় তা খুবই সামান্য। কওমি মাদ্রাসায় পঞ্চম শ্রেণি থেকে ওপরের দিকে শিক্ষার মাধ্যম হচ্ছে আরবি, ফার্সি ও উর্দু। কিন্তু ওই যে মাতৃভাষার জন্য উপযুক্ত স্থান নেই, এ ব্যাপারে বড়লোকের ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা ও গরিবের মাদ্রাসা শিক্ষা চমৎকারভাবে কাছাকাছি চলে আসে। এর ফল যা দাঁড়াচ্ছে তা হলো- উভয় ধারার শিক্ষার্থীই উৎপাটিত হচ্ছে মাতৃভূমির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির জ্ঞান থেকে। তাদের কৃত্রিম মানুষ হওয়ার শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। মাতৃভাষাই হচ্ছে শিক্ষার সহজ, স্বাভাবিক ও কার্যকর মাধ্যম। অন্য ভাষায় যে শিক্ষা তা সব সময়ই কঠিন, কৃত্রিম ও অফলপ্রসূ হচ্ছে। মাতৃভাষার মাধ্যমে উচ্চপর্যায়ের শিক্ষাদান ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। আর বড়লোক ও গরিবদের স্কুলে মাতৃভাষার স্থান তো খুবই সংকুচিত, অথচ কথা ছিল দেশ স্বাধীন হলে সর্বস্তরের শিক্ষাই হবে মাতৃভাষায়। তিন ধরনের শিক্ষা তো থাকবেই না, তিনে মিলে এক ও অভিম্ন হয়ে যাবে এবং মাতৃভাষাই হবে তার মাধ্যম। ঠিক এর উল্কল্টাটাই ঘটেছে। মাতৃভাষাই পারত তিন ধারাকে এক করতে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আগে ইংরেজি মাধ্যমে স্কুল ছিল একেবারেই নগণ্য সংখ্যক। কিন্তু তার পরও হৈচৈ করে একেবারে চক্রবৃদ্ধি হারে ইংরেজি স্কুলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন রাজধানী বা প্রধান শহরগুলোতেই শুধু নয়, মফস্বলেও তারা ছড়িয়ে গেছে। তাদের চাহিদা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে মাদ্রাসা শিক্ষার চলও আগের সব রেকর্ড ইতিমধ্যে ভেঙে ফেলেছে। রাষ্ট্র ছিল ধর্মনিরপেক্ষ। সেখানে রাষ্ট্র পরিচালিত ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকার কোনো কথাই ছিল না। কিন্তু সংবিধান থেকে যে দ্রুততায় ধর্মনিরপেক্ষতাকে মুছে ফেলা হয়েছে, ততোধিক ত্বরিতগতিতে মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসার ঘটেছে। কাজটা সরকার করেছে, কাজটা বেসরকারিভাবেও করা হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি মাদ্রাসার মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে। আমাদের এই ‘সোনার বাংলা’য় এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে বৈষম্যের কোনো প্রকার অভাব দেখা যাবে। মাদ্রাসা শিক্ষার বেলায়ও তাই।
মাদ্রাসা শিক্ষা, বিশেষ করে কওমি মাদ্রাসার ব্যাপারে বদান্যতার কোনো অভাব দেখা যায় না, অথচ প্রাথমিক বা মাধ্যমিক স্কুল খোলার জন্য টাকা চাইলে পাওয়া যায় না। কারণ এই যে, মাদ্রাসা শিক্ষাকে উৎসাহিত করলে একদিকে যেমন পুণ্য সঞ্চয় হবে ও সামগ্রিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে, অন্যদিকে তেমনি গরিব মানুষের শান্ত, সন্তুষ্ট এবং প্রতিযোগিতার বলয়ে প্রবেশ থেকে বিরত রাখা সম্ভব হবে। তাছাড়া মাদ্রাসা শিক্ষার ভেতরে বাণিজ্যিক সুবিধাও রয়েছে। বই ও গাইড বই থেকে শুরু করে চাঁদা সংগ্রহ, সরকারি অনুদানের অপব্যবহার সবকিছুই চলে। শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্যের আরেকটি ক্ষেত্র রয়েছে প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ই যে আসল বিশ্ববিদ্যালয় তা নিয়ে কোনো তর্কই নেই। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় চলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কারণেই। প্রথম কথা, প্রয়োজনের তুলনায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অল্প। এর সংখ্যা বৃদ্ধি করা অত্যাবশ্যক। সেখানে ভর্তি হতে ব্যর্থ হয়েই ছেলেমেয়েরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ছোটে। দ্বিতীয় সত্য এই যে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আগমন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই, তা তারা খন্ডকালীন, পূর্ণকালীন, ছুটি নিয়ে আসা যে ধরনের নিয়োগই পান না কেন।
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিকই বটে। হাতেগোনা কয়েকটি বাদ দিলে অধিকাংশ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাদান, পাঠ্যসূচি ও পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে অভিযোগ রয়েছে। সর্বোপরি বিশ্ববিদ্যালয় বলতে যে ধরনের পরিপূর্ণ ব্যবস্থা থাকা চাই, সে ধরনের গ্রন্থাগার, ল্যাবরেটরি, যাতায়াত সুবিধা, স্থানের প্রশস্ততা কোনো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষেই তার আয়োজন করা সম্ভব নয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় মানেই খারাপ, আর প্রাইভেট মানেই ভালো- এ ধারণা এ ক্ষেত্রে চলে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক শিক্ষার্থীদের তুলনায় অনাবাসিক শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করছে- এটাও কিন্তু বৈষম্যেরই ফল। ঢাকায় যাদের থাকার মতো বাসা আছে, অর্থনৈতিকভাবে তারা আবাসিক ছাত্রদের তুলনায় সচ্ছল। আবাসিক ছাত্ররা নানা রকম অসুবিধায় থাকে। খাদ্যের মান নিল্ফম্ন, বসবাসের জায়গায় ঠাসাঠাসি, নিরূপদ্রবে পড়াশোনার সুযোগ অপেক্ষাকৃত সীমিত- এসব তো আছেই, খরচ চালানোর জন্য কাউকে কাউকে গৃহশিক্ষকতাও করতে হয়। আবার টাকাও খরচ করতে হয় হিসাব করে। এসব অসুবিধা থেকে অনাবাসিকরা তুলনামূলকভাবে মুক্ত।
শিক্ষার ক্ষেত্রে যে অনগ্রসরতা, এর কারণ সমাজের ভেতরেই রয়েছে। সেখানে যে বৈষম্য ও বিভাজন বিদ্যমান, শিক্ষার ব্যাপারেও তারই প্রতিফলন ও প্রতিক্রিয়া দেখতে পাই। আরও আছে রাজনীতি। কোনো কিছুই রাজনীতির বাইরে নয়। আমরা তুমুল রাজনৈতিক আন্দোলন করেছি, দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু সমাজ বদলায়নি এবং সমাজের পাহারাদার যে রাষ্ট্র সেও আগের মতোই মানুষের পশ্চাৎপদতাকে উৎসাহিত করে এবং চায় সমাজের শ্রেণিবিভাজন আরও গভীর হোক, যাতে শাসকশ্রেণির পক্ষে রাষ্ট্রক্ষমতাকে নিজেদের পক্ষে রাখা সহজ হয়। শিক্ষা ব্যবস্থায় সংস্কার চাই, কিন্তু তার জন্য জরুরি হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রে মৌলিক পরিবর্তন আনা, যাতে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়। যে গণতন্ত্রের ভিত্তিই হচ্ছে মানুষে মানুষে অধিকার ও সুযোগের সাম্য গড়ে তোলা।
শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্নেষক ।
উৎসঃ সমকাল
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন