ব্যবসা এবং বাণিজ্যের ভেতর অবশ্য পার্থক্য আছে। বাংলাদেশের লোক ব্যবসাই করে, বাণিজ্য করে খুবই অল্প। আমদানির তুলনায় রফতানি কম। রফতানির ক্ষেত্রে অবশ্য তারা বাছবিচার করে না। খনিজ সম্পদ, প্রত্ন সম্পদ যা কিছু আছে পাচার করে দিতে তাদের উৎসাহের কোনো ঘাটতি নেই। নিকট অতীতে আমাদের এক মাননীয় স্পিকার বলেছিলেন যে, সংসদে যত ব্যবসায়ী দেখা যাচ্ছে, তত আইনজীবী দেখা যাচ্ছে না, অথচ সংসদ হচ্ছে আইন প্রণয়নেরই সংস্থা। কিন্তু আইনজীবীদেরকে যে ব্যবসার বাইরে রাখবেন তাও তো সম্ভব হচ্ছে না। কেননা আইনও তো এখন ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চিকিৎসক, শিক্ষক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, শিল্পী সকলেরই প্রবণতা ব্যবসামুখী। পারলে আপনি আমিও করতাম, সরাসরি না হোক, সাইড বিজনেসে কিছু এলে মন্দ কী?
তবে হ্যাঁ, ব্যবসা জিনিসটা ভালো নয়, মন্দই বটে। বাণিজ্য আরো খারাপ। যাকে উপনিবেশবাদ বলি সে তো নৌবাণিজ্যেরই আরেক রূপ। তথাকথিত বণিকেরা জাহাজে করে নতুন নতুন দেশে গেছে, সেখানে গিয়ে রঙিন কাচের বিনিময়ে হীরা সংগ্রহ করেছে, চালান দিয়েছে মানুষ। দস্যুতাই আসলে। ব্যবসাতেও ভালো কিছু নেই, মুনাফা করা ছাড়া। ঠকবে অথবা ঠকাবে। ক্রেতাই ঠকে সাধারণত, যে জন্য ব্যবসা চলে, নইলে উঠে যেত। আর ওই যে পুঁজিহীন ব্যবসার কথা বলেছিলাম সেটা বীমার ক্ষেত্রে ঠিকই প্রযোজ্য, এ ব্যবসাতে আমাদের আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু পুঁজির প্রয়োজনবিহীন আরেকটি ব্যবসা আছে যেটা ভয়ঙ্কর। এটি হলো ধর্মব্যবসা। এই ব্যবসা নানা রকমের হয়। ভণ্ড পীরেরা করে থাকেন, তাদের কায়দাকানুন নানা প্রকারের; কিন্তু সেটা সামান্য ব্যাপার, রাজনীতির ব্যবসায়ীরা যখন ধর্মকে ব্যবহার করেন তার তুলনায়। রাজনীতিকদের ধর্মব্যবসাতেও পুঁজি লাগে না, উল্টো তারা সাধারণ মানুষের ধর্ম বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসা করেন। মূল পুঁজিটা অন্যের ধর্মানুভূতি, কিন্তু মুনাফার সবটাই রাজনীতিকদের। কোনো প্রকার ঝুঁকি নেই। ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করার কাজটা ইংরেজ আমলেই শুরু হয়ে এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই ধর্মের এই রাজনৈতিক ব্যবহার রূপ নেয় সাম্প্র্রদায়িকতার, যার দুর্ধর্ষ তৎপরতার জন্য ভাগ হয়ে যায় ভারতবর্ষ।
পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নিজে ধর্মকর্মের ধার ধারতেন না। কিন্তু তিনিও শেষ পর্যন্ত রাজনীতির প্রয়োজনে ধর্মকে ব্যবহার করা সুবিধাজনক দেখে ওই ব্যবসাতে লিপ্ত হয়েছিলেন। সাম্প্রদায়িকভাবে দেশ ভাগ করার ব্যাপারে তার দায়িত্বটা কম নয়। নতুন রাষ্ট্রের জন্ম মুহূর্তেই অবশ্য তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, পাকিস্তান ধর্মীয় রাষ্ট্র হবে না, হবে ধর্মনিরপেক্ষ। কিন্তু ধর্মব্যবসায়ীরা তার কথা শুনবে কেন? তাদের সামনে তখন মুনাফা লাভের বিশাল ক্ষেত্র উন্মুক্ত হয়েছে, তারা সেটির সদ্ব্যবহার করবে না এমন তো হতে পারে না। পাকিস্তানের সামরিক ও অসামরিক আমলাতন্ত্রের সদস্যরা মানুষ হিসেবে ধার্মিক ছিল এমন কথা তাদের মিত্রদের পক্ষেও বলা সম্ভব নয়, কিন্তু রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগানোর লক্ষ্যে তারা ধর্মকে ব্যবহার করার ব্যাপারে কোনো প্রকার কার্পণ্য করেনি। পশ্চিম পাকিস্তানকে তারা প্রথম সুযোগেই বিধর্মীশূন্য করেছে এবং তারপরে একাত্তরে বিধর্মীদের খোঁজে পূর্ববঙ্গে এসে হানা দিয়েছে। যাদেরকে হাতের কাছে পেয়েছে হত্যা করেছে, অন্যদেরকে তাড়িয়ে সীমান্তের অপর পারে পাঠিয়ে দিয়েছে, কিংবা বাধ্য করেছে লুকিয়ে প্রাণ বাঁচাতে। পরে যখন দেখল যে বিধর্মীরা নয়, স্বধর্মীরাই তাদের বিরুদ্ধে লড়ছে, তখন ক্রমেই বুঝতে পারল যে পারবে না, পালাতে হবে এবং শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করে পালালও।
পাকিস্তানি (মূলত পাঞ্জাবি) সেনাবাহিনী দেখল যে, পূর্ববঙ্গ তাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে; কিন্তু তাতে কী? পশ্চিম পাকিস্তান তো রয়েছে, সেখানে তারা নিজেদের রাজনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখল এবং রাষ্ট্রক্ষমতা কব্জা করে নিল। ওই সময়ে তাদের জন্য চমৎকার এক সুযোগ এসে হাজির। আফগানিস্তানে তখন রাশিয়ার আধিপত্য চলছে, আমেরিকানরা চাইছিল সেখান থেকে রাশিয়ানদের সরিয়ে নিজেদের কর্তৃত্ব কায়েম করবে। এর জন্য কমিউনিস্টবিরোধী একটি বাহিনী দরকার। আর ওই রকমের বাহিনী তৈরিতে নাস্তিক কমিউনিস্টদেরকে ঘৃণ্যতম শত্রু বলে বিবেচনা করবে এমন লোক চাই। আমেরিকার অর্থে তেমন লোক তৈরির কারখানা খোলার ধুম পড়ে গেল। একেবারে রমরমা ব্যবসা। এইসব মাদরাসায় আফগানিস্তান তো বটেই পাকিস্তানের নিজের এলাকারও হাজার হাজার তরুণকে ভর্তি করা হলো, যাদের জীবনের ব্রত দাঁড়াল আফগানিস্তান থেকে রুশদেরকে হটানো। রুশরা চলে গেল। চলে যাবার পর ওই যে শিক্ষিত জেহাদি, নাম যাদের তালেবান, তারা আফগানিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিল। আমেরিকা তো আফগানিস্তানে তালেবান শাসন চায়নি, তারা চেয়েছে আমেরিকার আধিপত্য। তাই তালেবান-আমেরিকান যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। সম্মুখযুদ্ধে তালেবানরা পরাজিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ইতিমধ্যে ধর্মকে তো তারা অস্ত্র করে তুলেছে এবং সেই অস্ত্রের যে ক্ষমতা তার স্বাদও পেয়ে গেছে; তাই তাদের তৎপরতা থেমে নেই। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরেক ব্যবসা মাদকের। ধর্মের অস্ত্র এবং মাদকের ব্যবসা দুয়ের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে তালেবানরা ক্রমাগত দুর্ধর্ষ হয়ে উঠে। আল কায়েদা যা তালেবানও তাই, কেবল যে আত্মীয় ও বন্ধু তা নয়, আসলে একই জিনিস, দুই নামে।
একাত্তরে বিশেষভাবে মুশকিলে পড়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। পূর্ববঙ্গে তারা এসেছিল ধর্মযুদ্ধ করবে বলে; এখন নিজের দেশেই তাদের নিজেদের চেয়েও অধিক মাত্রায় ‘ধর্মপ্রাণ’ ধর্মযোদ্ধাদের অস্ত্রাঘাতে জর্জরিত হচ্ছে। রাস্তাঘাটে তো অবশ্যই, এমনকি নিজেদের সন্তানদের স্কুলে-সদর দফতরেও তারা আক্রান্ত হচ্ছে। ধর্ম নিয়ে যে ব্যবসা শুরু করেছিল তার ফল এখন পাকিস্তানি শাসকরা হাতেনাতে পেতে শুরু করেছে। পূর্ববঙ্গে তাদের যে শিক্ষালাভ ঘটেছিল তারপরেও কিছু প্রাপ্য ছিল বৈকি। সেই শিক্ষাটা এখন লাভ করছে। কিন্তু যতই শিক্ষা পাক তাদের পক্ষে ধর্মব্যবসা পরিত্যাগ করা কিছুতেই সম্ভব নয়। পাকিস্তান একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হবে এমন কথা তারা কিছুতেই বলতে পারবে না। কারণ সেটা বলতে গেলে তাদের রাষ্ট্রের ভেতরটাই ভেঙে পড়বে। তখন সিন্ধি, বেলুচ, পাঠান ও মোহাজেরদের ওপর যে কর্তৃত্ব তারা করেছে সেটা করার মূল যুক্তিটাই আর অবশিষ্ট থাকবে না। কিন্তু বাংলাদেশে তো ঘটনা ভিন্ন হওয়ার কথা ছিল। ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে তো বাঙালিরা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই ত্যাগ করেছে। এক্ষেত্রে জিন্নাহর কাজের সঙ্গে বাঙালিদের কাজের একটা মিল দেখা যাচ্ছে। জিন্নাহও ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ পরিত্যাগের কথা বলেছিলেন। কিন্তু ওই একবারই। তারপরে তিনি ইসলাম ও মুসলমানদের ঐক্য বিষয়ে বলার কোনো ঘাটতি ঘটাননি। তার চেয়ে বড় ব্যাপার এই যে, পূর্ববঙ্গের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের স্থায়ী আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিলেন। যুক্তি ছিল উর্দু মুসলমানদের ভাষা। বাঙালিদেরকে পদানত করার উদ্দেশ্যে ধর্মের জায়গায় নতুন একটি অস্ত্র ব্যবহারে উদ্যত হয়েছিলেন তিনি, সেটি ভাষার।
বাংলাদেশ যে স্বাধীন হয়েছে তা ধর্মকে অস্ত্র ও পুঁজি হিসেবে ব্যবহারকারীদের তৎপরতাকে নস্যাৎ করে দিয়ে তবেই। খুবই স্বাভাবিক ছিল যে বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হবে। আমরা সে পথেই এগুচ্ছিলাম। সংবিধানে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছিল। কিন্তু পরে দেখা গেল ধর্মব্যবসায়ীদের তৎপরতার ফলে ধর্মনিরপেক্ষতাকে মূলনীতির সংক্ষিপ্ত তালিকাটি থেকে বিদায় করে দেয়া এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি পাকিস্তানি জমানার চাইতেও জোরেশোরে শুরু হয়ে যায়। এসব ঘটা শুরু হলো পঁচাত্তরের মধ্য-আগস্টের রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ডের পর থেকে। জবরদখল করা ক্ষমতায় টিকে থাকাকে বৈধতাদান এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ থেকে অব্যাহতি লাভের উদ্দেশ্যেই ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করার পুরনো কাজ আবার শুরু করে। ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাদ দেয়া হয়েছে এবং সেইসঙ্গে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো কাজ করার অনুমতিও পেয়ে গেছে। এই যে কবরের ভেতর থেকে প্রেতাত্মার বেরিয়া আসা এই অবিশ্বাস্য ঘটনার পেছনে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারী তো আছেই, রয়েছে আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের সক্রিয় সমর্থন। এরা ভয় পাচ্ছিল বাংলাদেশ সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়বে। তাই ক্ষমতা দখলকারীদেরকে পৃষ্ঠপোষকতাই কেবল দেয়নি, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে অর্থসাহায্যও করেছে এবং মাদ্রাসা শিক্ষার
পেছনে অকাতরে টাকা ঢেলেছে। ব্যবসাটা তাই খুবই জমে উঠেছে।
একাত্তরে জামায়াতের যে ভূমিকা ছিল তাতে বাংলাদেশ থেকে তাদের পক্ষে চিরকালের জন্য নির্মূল হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু হয়নি। দেশি-বিদেশি তহবিল ও রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে তারা লকলকিয়ে বেড়ে উঠে। তাদের পথটা বড়ই সোজা। তারা পুরোপুরি সমাজতন্ত্রবিরোধী এবং সম্পূর্ণরূপে ধর্মব্যবসায়ী। এতে কোনো প্রকার ভেজাল নেই। ব্যাপারটা কিন্তু ব্যবসাই, অন্যকিছু নয়। ইহকালে মুনাফা পাওয়া যাচ্ছে পরকালেও পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়। এর সঙ্গে ধর্মকর্মের যেটুকু সম্পর্ক তা প্রদর্শনের বটে, আদর্শের নয়। কিন্তু প্রতিকার কী? সেটাও আমাদের জানা। প্রথম কথা, সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ফিরিয়ে আনা এবং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করা। এ ব্যাপারে গোঁজামিলের কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয়। আরো বেশি করে যা প্রয়োজন তা হলো গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, যে আন্দোলনের লক্ষ্য হবে সমাজে মানুষের সঙ্গে মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা করা এবং দারিদ্র্য দূর করা।
দারিদ্র্য হচ্ছে ধর্মব্যবসায়ীদের ব্যবসার জন্য সবচেয়ে প্রশস্ত ক্ষেত্র। দারিদ্র্য ও বৈষম্য বিক্ষোভের জন্ম দেয়, সেই বিক্ষোভকে গণতান্ত্রিক আন্দোলন যদি ধারণ করতে না পারে তবে ধর্মব্যবসায়ীদের সুবিধা না হয়ে যায় না। ধর্মবিশ্বাসকে তো বটেই, ইহজাগতিক বিক্ষোভকেও কাজে লাগিয়ে তারা মহানন্দে ব্যবসা করতে থাকবে এবং আমাদের ভবিষ্যৎ আরো বেশি বেশি করে বিপন্ন হবে। রাজনীতির স্বচ্ছতা আরো জরুরি বিষয়। দায়বদ্ধতা-জবাবদিহীতার মতো জরুরি বিষয়গুলো রাজনীতিতে নিশ্চিত না থাকলে এমন রাজনীতি জনকল্যাণকর হতে পারে না।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক
মানবকণ্ঠ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন