বাংলাদেশের ক্রিকেট টিমকে ‘টাইগার’ বা ‘টাইগার্স’ নামে অভিহিত করা হয়। এই সর্বনামের উৎপত্তি সুন্দরবনের বাঘ থেকে। ব্রিটিশ আমলেই সুন্দরবনের বাঘগুলোর নাম হয়েছিল রয়েল বেঙ্গল টাইগার। অতীতে বাংলাদেশে ক্রিকেট জনপ্রিয় ছিল না; তবে বিশ-পঁচিশ বছর ধরেই ক্রমান্বয়ে জনপ্রিয়তা বাড়ছে। ফলে ‘টাইগার’ শব্দটির জনপ্রিয়তাও বাড়ছে। বাস্তবতা হলো, ক্রিকেট-উন্মাদনার আগে শব্দটি সেনাবাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জন্যই ব্যবহার করা হতো এবং এখনো হচ্ছে। সম্মানিত পাঠকের জন্য ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এই আদরণীয় নাম, এর প্রেক্ষাপট বর্ণনা করা এবং দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে শ্রদ্ধা জানানোর নিমিত্তে দু’টি কথা এখানে লিখছি।
ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী
সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন প্রকার বাহিনী থাকে। তাদের পরিচয়গুলো ‘ফাংশনাল’ পরিচয় বা যুদ্ধ ক্ষেত্রে তাদের কর্ম সম্পাদনের বৈশিষ্ট্যের পরিচয় বহন করে। নামগুলো ইংরেজি পরিভাষায়। বাহিনীগুলোর নাম যথা : আর্মি ডেন্টাল কোর, আর্মি মেডিক্যাল কোর, কোর অব মিলিটারি পুলিশ, আর্মি ক্লারিকাল কোর, আর্মি সার্ভিস কোর (এএসসি), অর্ডন্যান্স কোর, কোর অব ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার্স (ইএমই), আর্মার্ড কোর বা সাঁজোয়া বাহিনী, আর্টিলারি কোর বা গোলন্দাজ বাহিনী, কোর অব ইঞ্জিনিয়ার্স বা প্রকৌশল বাহিনী, কোর অব সিগন্যালস বা বার্তা-যোগাযোগ বাহিনী, ইনফ্যানট্রি বা পদাতিক বাহিনী প্রভৃতি। ১৯৪৭-এর পূর্ববর্তী ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে পদাতিক বাহিনীর অনেক রেজিমেন্ট ছিল; যেমন : পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, মাদ্রাজ রেজিমেন্ট, গুর্খা রেজিমেন্ট, শিখ রেজিমেন্ট, ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট, আসাম রেজিমেন্ট, কুমাউন রেজিমেন্ট, জাঠ রেজিমেন্ট, বালুচ রেজিমেন্ট ইত্যাদি। ১৯৪৭ সালে যখন ভারত ও পাকিস্তান নামক দু’টি রাষ্ট্র যাত্রা শুরু করে, তখন ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীও বিভক্ত হয়। ফলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পাঞ্জাব রেজিমেন্টের কিছু অংশ, ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের কিছু অংশ এবং বালুচ রেজিমেন্টের কিছু অংশ পায়। এসব রেজিমেন্টের শতকরা এক শ ভাগ সৈনিক (অফিসার নয়, শুধু সৈনিক) এলাকাভিত্তিক হতেন। যেমন আসাম রেজিমেন্টের জন্য শুধু আসামের তরুণ, শিখ রেজিমেন্টের জন্য শুধু শিখ ধর্মাবলম্বী তরুণ, মারাঠা রেজিমেন্টের জন্য মারাঠি তরুণ, পাঞ্জাব রেজিমেন্টের জন্য পাঞ্জাবের তরুণ, ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের জন্য উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত এলাকার তরুণ এবং বালুচ রেজিমেন্টের জন্য বালুচিস্তানের তরুণরাই নিয়োগ পেতেন। সম্মানিত পাঠক খেয়াল করুন, ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর পদাতিক বাহিনীতে অথবা ১৯৪৭ সালের আগস্টের পরপর উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ভারতীয় সেনাবাহিনী ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পদাতিক বাহিনীতে, বাংলা/বঙ্গ/বেঙ্গল নামক প্রদেশ থেকে সংগৃহীত তরুণদের কিংবা বাংলায় কথা বলে এমন তরুণদেরকে নিয়ে কোনো রেজিমেন্ট ছিল না। আজ (২০২০) পর্যন্ত ভারতীয় সেনাবাহিনীর পদাতিক বাহিনীতে ‘বেঙ্গল রেজিমেন্ট’ বলে কোনো রেজিমেন্ট নেই।
Ad by Valueimpression
বেঙ্গল রেজিমেন্টের জন্ম ও ‘টাইগার’ নামকরণ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-৪৫ খ্রিষ্টাব্দ) চলাকালে বিভিন্ন রেজিমেন্টের অংশীদার হয়ে, বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে বিপুলসংখ্যক বাঙালি তরুণ যুদ্ধ করেছিলেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন কুমিল্লার সন্তান মো: আবদুল গনি (যিনি পরে মেজর গনি নামে পরিচিত হয়েছেন এবং এ দেশের ইতিহাসে বিখ্যাত)। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর প্রকৌশলী বা কোর অব ইঞ্জিনিয়ার্স এবং পদাতিকের মাঝামাঝি একটি বাহিনী, যার নাম ছিল পাইওনিয়ার কোর, এর একজন অফিসার ছিলেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন শেষ হয় তখন তিনি ছিলেন ক্যাপ্টেন। তিনি ধর্মপরায়ণ, সাংগঠনিকভাবে দক্ষ, যুদ্ধক্ষেত্রে সাহসী, নৈতিক বলে বলীয়ান, অত্যন্ত দেশপ্রেমিক, বাঙালি জাতিপ্রেমিক অফিসার ছিলেন। গনি সাহেবের উদ্যোগ ও তৎপরতার কারণে এবং আরো কিছু বাঙালি শুভাকাক্সক্ষীর তৎপরতায়, ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইনফ্যান্ট্রি বা পদাতিক বাহিনীতে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নামে একটি বাহিনীর গোড়াপত্তন হয় এবং সে দিন থেকেই প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নামক ব্যাটালিয়নের যাত্রা শুরু। সেই সময় এই ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মটো বা নীতিবাক্য স্থির হয়েছিল তিনটি বাংলা শব্দ, যথা : সৌম্য, শক্তি ও ক্ষিপ্রতা। এই তিনটি বিশেষণই সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের জন্য প্রযোজ্য এবং সেখান থেকেই ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জন্য এই মটো স্থির করা হয়েছিল। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়নের আদরণীয় নাম বা নিক-নেইম স্থির হয়েছিল ‘সিনিয়র টাইগার্স’। এক বছর পর ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৯ সালে বেঙ্গল রেজিমেন্টের দ্বিতীয় ব্যাটালিয়নের জন্ম হয়, যার আদরণীয় নাম দেয়া হয় জুনিয়র টাইগার্স। অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আদরণীয় নাম বা নিক-নেইম হচ্ছে দি পাইওনিয়ার্স। ইংরেজি পাইওনিয়ার্স শব্দটির বাংলা অর্থ হচ্ছে পথ প্রদর্শনকারী বা অগ্রদূত বা সূচনাকারী।
আমার প্যারেন্ট ব্যাটালিয়ন : জুনিয়র টাইগার্স
আমরা ১৯৭০-এ ফেরত যাই। ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭০ এর কিছু দিন আগে আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আমি কোথায় চাকরি করতে চাই? তখন আমি উত্তর দিয়েছিলাম, প্রথমত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে চাকরি করতে চাই এবং দ্বিতীয়ত ওই রেজিমেন্টেরই দ্বিতীয় ব্যাটালিয়নে চাকরি করতে চাই। ওই সময় দ্বিতীয় ব্যাটালিয়নের অবস্থান ছিল ঢাকা শহর থেকে কিছু উত্তরে, তৎকালীন জয়দেবপুর থানার সদরে ইতিহাস খ্যাত ভাওয়াল রাজবাড়ীতে; বর্তমানে যা গাজীপুর জেলা সদর। দ্বিতীয় ব্যাটালিয়নকে সাধারণভাবে সেকেন্ড বেঙ্গল বা সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল বলা হয় বা জুনিয়র টাইগার্সও বলা হয়। কমিশন-পরবর্তী ২০ দিন ছুটি কাটানোর পর আমি দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে (জয়দেবপুরে) রিপোর্ট করি ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭০ তারিখে। সেই থেকে নিয়ে ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত তিন বছরের কয়েক দিন বেশি সময় ওই ব্যাটালিয়নে চাকরি করেছি। সেনাবাহিনীর পদাতিকের রেওয়াজ অনুযায়ী, যে ব্যাটালিয়নে বা ইউনিটে চাকরি শুরু হয় সেটাকে বলা হয় প্যারেন্ট ব্যাটালিয়ন। প্যারেন্ট শব্দের বাংলা অর্থ মাতা-পিতা; অতএব প্যারেন্ট ব্যাটালিয়ন মানে একজন অফিসারের জন্মের ব্যাটালিয়ন। আমার প্যারেন্ট ব্যাটালিয়ন হচ্ছে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তথা সেকেন্ড বেঙ্গল। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আরো দু’টি ব্যাটালিয়নে চাকরি করেছি এবং অধিনায়কত্বও করেছি। রাঙ্গামাটিতে ও খাগড়াছড়িতে ব্রিগেড কমান্ডার ছিলাম, বিএমএ ভাটিয়ারিতে কমান্ড্যান্ট ছিলাম, যশোরে ছিলাম জিওসি; প্রতিটি দায়িত্ব বা অ্যাপয়েন্টমেন্ট বা নিযুক্তিতে আলাদা আলাদা গৌরব, মর্যাদা ও আনন্দ আছে; কিন্তু বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্যারেন্ট ব্যাটালিয়নের সাথে চাকরির স্বাদ, মজা, আনন্দ, উৎফুল্লতা, গৌরব, সুনাম, গর্বের মনোভাব ইত্যাদি অন্য কোনো কিছুর সাথে মিলে না বা তুলনা হয় না। এটা শুধু আমার ক্ষেত্রে নয়, এটা সব পদাতিক বাহিনীর অফিসারের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
জুনিয়ার টাইগারকে অভিনন্দন
পাঠক এই কলামটি পড়ছেন আজ বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০। আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি গৌরবদীপ্ত ও শ্রদ্ধাভাজন ব্যাটালিয়নের ৭০ বছর বয়স পূর্তি ও প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। সেই গৌরবদীপ্ত শ্রদ্ধাভাজন ব্যাটালিয়ন তথা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দ্বিতীয় ব্যাটালিয়নকে তাদের জন্মদিনে অভিনন্দন জানাই। অতএব, বেঙ্গল রেজিমেন্ট সম্বন্ধে এবং দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সম্পর্কে কিছু কথা বলব। আমার জন্ম যেহেতু ১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসের ৪ তারিখ, অতএব আজ ৫ ফেব্রুয়ারি আমার বয়স ৭১ বছর ৩ মাস ৫ দিন। গত ২৩ বছরের বেশি কাল আমি একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি; গত ১২ বছর ধরে একজন রাজনৈতিক কর্মী। কিন্তু আমি শহরে বন্দরে, বিভিন্ন জনপদে কিংবা সেনানিবাসের হাসপাতালে যত জায়গাতেই যাই, সাবেক সৈনিকদের সাথে এবং আমি না চাইলেও চাকরিরত কিছু সৈনিকের সাথে দেখা হতেই থাকে। বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে কমান্ড্যান্ট থাকার সুবাদে অন্তত ছয় শত অফিসারের পিতৃতুল্য ভূমিকায় ছিলাম। তা ছাড়া ২৭টি বছর সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন পদে চাকরি করেছি। গত আঠারো বছর যাবৎ টেলিভিশনে যাই, গত ২৩ বছর ধরে পত্রিকায় লিখি। তাই চাকরিরত বা অবসরপ্রাপ্ত অফিসার ও সৈনিকদের কাছে আমার চেহারাটি এবং নামটি পরিচিত হওয়াই স্বাভাবিক। সামনে পড়ে গেলে বেশির ভাগ অফিসার সালাম বিনিময় করেন; নবীন সৈনিকরা চিনে ওঠে না। চাকরিরত সৈনিকদের বা চাকরিরত অফিসারদের সাথে পারতপক্ষে দীর্ঘ আলাপে লিপ্ত হই না, যেন তারা চাকরিতে কোনো অসুবিধায় না পড়েন। অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকরা আমার রাজনৈতিক কর্মীর পরিচয়টাকে গৌণ হিসেবেই দেখেন। অবসরপ্রাপ্তদের দৃষ্টিতে আমি, টেলিভিশনে স্পষ্টবাদী যুক্তিবাদী সৌজন্যশীল বক্তা, তাদের দৃষ্টিতে আমি সেনাবাহিনীর শুভাকাক্সক্ষী একজন টিভি আলোচক এবং কলাম লেখক; তাদের দৃষ্টিতে আমি একজন ব্যতিক্রমধর্মী জেনারেল, যিনি অত্যন্ত জনবান্ধব ও সৈনিকবান্ধব। অতএব, সরকারি বা সামরিক দাওয়াত না পেলেও, যথাযথ জায়গা থেকে যে মায়া মমতা ও শ্রদ্ধা পাই, সে ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে আজকের এই দিনে তথা তাদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনে অভিনন্দন জানানো আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে এবং এটা আমার অধিকারও বটে। প্রতি বছর এভাবে কলাম লিখি না, কিন্তু এ বছর ৭০ বা ৭১ শব্দটি গুরুত্বপূর্ণ, তাই লিখছি।
জুনিয়র টাইগারের অফিসার ও খেতাব
১৯৫৬ সালের জুন মাসে, সেকেন্ড বেঙ্গলের অনারারি লেফটেন্যান্ট আহমেদ দীন সিতারা-ই-বাসালাত এবং হাবিলদার চাঁদ মিয়া তমঘা-ই-বাসালাত খেতাব পেয়েছিলেন। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বৃহত্তর যশোর-কুষ্টিয়া সীমান্তে প্রতিরক্ষা অবস্থানে ছিল; এখানে কোনো সশস্ত্র সংঘর্ষ হয়নি। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে উল্লেখযোগ্য সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য চারজন বীর উত্তম খেতাব পেয়েছেন, দশজন বীর বিক্রম খেতাব পেয়েছেন এবং ২৩ জন বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছেন (যাদের মধ্যে এই কলামের লেখক একজন)। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৯ তারিখে ঢাকা সেনানিবাসের একদম উত্তরে অবস্থিত, কুর্মিটোলা অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেছিল। ওই কুর্মিটোলা এখন বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর এখতিয়ারভুক্ত একটি ঘাঁটি। ১৯৫২ সালের মে মাসে এই ব্যাটালিয়ন কুমিল্লা সেনানিবাসে যায়। পাকিস্তানের ২৩ বছরে, প্রথমবার ১৯৫৮-১৯৬০ সোয়া দুই বছর পেশাওয়ারে এবং দ্বিতীয়বার ১৯৬৬-১৯৬৮ সোয়া দুই বছর লাহোর সেনানিবাসে অবস্থান করে ছিল ও দায়িত্ব পালন করেছিল। ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২৬ তারিখ আমি যখন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে তথা জুনিয়র টাইগার্সে যোগদান করেছিলাম, তখন উপ-অধিনায়ক ছিলেন তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান। আট-দশ দিন পরই মেজর জিয়া জয়দেবপুর ত্যাগ করে চট্টগ্রামের ষোলশহরে নবগঠিত অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম উপ-অধিনায়ক হিসেবে যোগদান করতে চলে যান। অতঃপর দ্বিতীয় বেঙ্গলের উপ-অধিনায়ক হয়েছিলেন মেজর কাজী মোহাম্মদ সফিউল্লাহ। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালে ৩ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন, ‘এস ফোর্স’ এর কমান্ডার ছিলেন, পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান হয়েছেন, মেজর জেনারেল হয়েছেন, অবসর জীবনে রাষ্ট্রদূত ছিলেন ষোলো বছর এবং এখনো জীবিত আছেন। জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথমে নিজের নামে ও পরে বঙ্গবন্ধুর নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন; মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে অষ্টম বেঙ্গলের ও ১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়কত্ব করেছেন, ‘জেড ফোর্স’ এর কমান্ডার ছিলেন, পরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপপ্রধান হয়েছেন, ২৪ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখে সেনাবাহিনী প্রধান নিযুক্ত হন, ১৯৭৮ সালে হন বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এবং ১৯৮১ সালের ৩০ মে তারিখে বিদ্রোহী সৈন্যদের হাতে শাহাদত বরণ করেন। জুনিয়র টাইগারের বাঙালি অফিসার যারা মুক্তিযুদ্ধে ছিলেন বা যুদ্ধকালে জুনিয়র টাইগারে যোগদান করেছিলেন, তাদের মধ্যে বেশির ভাগই মেজর জেনারেল র্যাংকে উন্নীত হয়েছিলেন যথাযথ সময়ে। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন- মেজর জেনারেল নুরুল ইসলাম (ডাক নাম শিশু এবং প্রেসিডেন্ট জিয়ার ক্যাবিনেটে মন্ত্রী ছিলেন), মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী বীর বিক্রম (২০০১ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা), লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম বীর বিক্রম, যিনি সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায় ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রপতির সাথে দ্বন্দ্বে জড়িত হওয়ার প্রেক্ষাপটে অপসারিত হয়েছিলেন সেনা প্রধানের পদ থেকে, মেজর জেনারেল আজিজুর রহমান বীর উত্তম, মেজর জেনারেল এজাজ আহমেদ চৌধুরী, মেজর জেনারেল গোলাম হেলাল মোর্শেদ খান বীর বিক্রম (১৯৯৬ সালের মে মাসে চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন এবং যাকে অজুহাত করে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল নাসিম ব্যতিক্রমী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন), মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক, মেজর জেনারেল সাইদ আহমেদ বীর প্রতীক প্রমুখ।
স্বাধীনতার জন্য প্রথম বিদ্রোহ : ১৯ মার্চ ১৯৭১
আনুষ্ঠানিক রণাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধের মেয়াদ হলো ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, অর্থাৎ ৯ মাস তথা ২৬৬ দিন। রাজনৈতিক মুক্তিযুদ্ধের মেয়াদ আরো পাঁচ বা সাত বা দশ বা পনেরো বছর বেশি। আনুষ্ঠানিক মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সাত দিন আগে, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ১৯ তারিখ, এই দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, জয়দেবপুরের রাজবাড়ীর মাঠে ও রেল ক্রসিংয়ে, তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের গণবিরোধী হুকুম অমান্য এবং বিদ্রোহ করেছিল। বস্তুত দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জন্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তথা দেশকে স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল ১৯ মার্চ ১৯৭১ তারিখেই। সেই দিনটিতে জয়দেবপুরের হাজার হাজার মানুষ যেমন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছিলেন, তেমনই দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি অফিসার ও সৈনিকরা জনগণের স্বাধীনতামুখী চেতনার সাথে প্রকাশ করেছিলেন একাত্মতা। ওই ১৯ মার্চ তারিখের ওই জনবিদ্রোহ ও সেনাবিদ্রোহের সময়, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের জননেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন নজরুল ইসলাম খান (বর্তমানে বিএনপি নেতা), আ ক ম মোজাম্মেল হক (বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতা ও মন্ত্রী), এম এ মোত্তালিব চৌধুরী (হবিগঞ্জ বাড়ি, বর্তমানে মরহুম), কাজী আজিমুদ্দিন (শিক্ষানুরাগী ও স্থানীয়, বর্তমানে মরহুম) প্রমুখ। সেকেন্ড বেঙ্গলের বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী এবং তাকে পরোক্ষভাবে সমর্থন দিয়েছেন তৎকালীন (বাঙালি) অধিনায়ক বা সিও লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাসুদুল হোসেন খান এবং তৎকালীন উপ-অধিনায়ক বা টুআইসি মেজর কাজী মোহাম্মদ সফিউল্লাহ। অন্য সব বাঙালি অফিসার যথা ক্যাপ্টেন নাসিম, ক্যাপ্টেন আজিজ, ক্যাপ্টেন এজাজ, কনিষ্ঠতম অফিসার সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ইবরাহিম, ডাক্তার লেফটেন্যান্ট মোক্তার কামাল চৌধুরী, উপস্থিত ভারপ্রাপ্ত বাঙালি সুবেদার মেজর নুরুল হক, অন্যান্য বাঙালি জুনিয়র কমিশনড অফিসার এবং বাঙালি জ্যেষ্ঠ সৈনিকরা সেই বিদ্রোহে শামিল ও একাত্ম ছিলেন। অতি গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য নিম্নরূপ। যদি ২৬ মার্চ ১৯৭১-এ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু না হতো, অর্থাৎ পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বা পাকিস্তানে শান্তিপূর্ণ অবস্থা বহাল থাকত, তাহলে নিশ্চিতভাবে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আটজন বাঙালি অফিসার ও অন্তত ১০ জন জুনিয়র কমিশনড অফিসার ও ১০০ জন সৈনিক সামরিক পদ্ধতিতে বিচারের সম্মুখীন হতেন। সামরিক বাহিনীতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিদ্রোহের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড অথবা দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে বা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই ১৯ মার্চ তারিখটি যথাযোগ্য মর্যাদায় স্থান পায়নি এবং বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সরকারের আমলে এই দিবসটি পালন করা একান্তভাবেই আওয়ামী লীগ ঘরানার বিষয়বস্তু হয়ে গিয়েছে, সেকেন্ড বেঙ্গলের স্মৃতিচারণ ও গৌরবের স্মৃতি রোমন্থন করার বিষয়, প্রান্তিকরণ বা মার্জিনালাইজড হয়ে গিয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায় : মিরপুর, জানুয়ারি ১৯৭২
১৯ মার্চ যেমন আনুষ্ঠানিক মুক্তিযুদ্ধের আগে দ্বিতীয় বেঙ্গলের জন্য একটি যুদ্ধ, তেমনই আনুষ্ঠানিক মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার প্রায় দেড় মাস পর ৩০-৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে, দ্বিতীয় বেঙ্গলই মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের শেষ যুদ্ধটি করে ছিল। সেই যুদ্ধক্ষেত্র ছিল ঢাকা শহরের মিরপুর। তখনো ভারতীয় বাহিনী ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যে দায়িত্ব ও সেনানিবাস এলাকার হস্তান্তর শুরু হয়নি। হঠাৎ ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতি অনুরোধ এসেছিল মিরপুর অভিযান পরিচালনার জন্য। সেই সময় পরিকল্পনা এবং রেকোনাইসেন্সের জন্য যথেষ্ট সময় না পাওয়া সত্ত্বেও, শুধু হেডকোয়ার্টারের অপরিণামদর্শী আদেশ পালনের জন্য মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার নোটিশে দ্বিতীয় বেঙ্গলের একটি কোম্পানি মিরপুর অপারেশনে নিয়োজিত হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে আমার লেখা প্রথম বই (মাওলা ব্রাদার্স কর্তৃক ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত) : ‘সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে আটাশ বছর’-এ আলাদাভাবে নাতিদীর্ঘ বক্তব্য রেখেছি। অস্ত্রধারী বিহারি ও পলাতক পাকিস্তানি মিলিশিয়া বাহিনীর সাথে ওই দিনের যুদ্ধে, দ্বিতীয় বেঙ্গলের একজন অফিসার, একজন জেসিও এবং ঊনচল্লিশ জন সৈনিক শাহাদত বরণ করেছিলেন। বর্তমান (১৯৭২-২০২০) ঢাকা সেনানিবাসের উত্তর অংশে, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের বিপরীতে, প্রধান সড়কের পূর্ব পাশে, একটি পদাতিক ব্যাটালিয়নের জন্য উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধাসংবলিত সেনা-আবাসস্থল আছে, যেটার নাম শহীদ মান্নান লাইনস। এই আবাসস্থলে সর্বদাই একটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন থাকে এবং এখনো আছে। এর পশ্চিম প্রান্তে একটি স্মৃতিস্তম্ভ আছে, যেখানে কালো মার্বেল পাথরের ওপর অঙ্কিত বাংলাদেশের মানচিত্রের মাঝখানে লেখা আছে দ্বিতীয় বেঙ্গলের সব শহীদের নাম। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে শাহাদত বরণকারী নায়েক আবদুল মান্নানের নামে এই আবাসস্থলের নাম শহীদ আবদুল মান্নান লাইনস। আমি আহ্বান জানাই, এই স্মৃতিস্তম্ভের উপযুক্ত যত্ন করার জন্য।
দ্বিতীয় বেঙ্গলের যুদ্ধগুলো
মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে বহু যুদ্ধ দ্বিতীয় বেঙ্গলের নেতৃত্বে বা দ্বিতীয় বেঙ্গলের সৈনিকদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে; সেগুলোর উপযুক্ত বর্ণনা এই সংক্ষিপ্ত কলামে দেয়া অসম্ভব; তাই মাত্র কয়েকটি উল্লেখ করছি। নরসিংদী ও তার দক্ষিণ এলাকায় একটি কোম্পানি মোতায়েন করা হয় এবং তারা যুদ্ধ করেছে। ব্যাটালিয়ন মেঘনা নদী পার হয়ে পূর্ব তীরে আসার পর আশুগঞ্জ ভৈরবের যুদ্ধ সংঘটিত হয়; এটা এপ্রিল মাসের প্রথম দুই সপ্তাহের কথা। ১৯৭১ সালের এপ্রিল-মে মাসব্যাপী তেলিয়াপাড়ার যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যখন আশুগঞ্জ, ভৈরব বা তেলিয়াপাড়া অঞ্চলে যুদ্ধ হচ্ছিল তখন বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বে সিলেট মহানগর রক্ষা করার জন্য প্রতিরোধ যুদ্ধে দ্বিতীয় বেঙ্গল অংশ নেয়। বর্তমানের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উত্তর অংশে এবং বর্তমান হবিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন অংশে অনেক খণ্ড যুদ্ধে বা অভিযানে তারা ব্যস্ত ছিল যথা : মনতলার খণ্ডযুদ্ধ, হরষপুরের খণ্ডযুদ্ধ, ধর্মঘর অভিযান, মাধবপুরের প্রতিরোধ যুদ্ধ, নলুয়া চাবাগান অপারেশন, আসামপাড়া আক্রমণ, রেমা চাবাগানের খণ্ডযুদ্ধ, কালেঙ্গা জঙ্গলের খণ্ডযুদ্ধ ইত্যাদি। দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের চূড়ান্ত যুদ্ধ ছিল ৩০ নভেম্বর ১৯৭১ থেকে শুরু করে ৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ এর ভোর পর্যন্ত আখাউড়া দখলের যুদ্ধ। এক সময়ে এই দ্বিতীয় বেঙ্গল ৩ সেক্টরে রূপান্তরিত হয়েছিল এবং ব্যাপক গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল।
শান্তিকালীন গৌরব
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অংশ হিসেবে দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট পার্বত্য চট্টগ্রামে একাধিক দুরূহ অঞ্চলে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেছে। আমি নিজে যখন খাগড়াছড়িতে ব্রিগেড কমান্ডার ছিলাম, তখন এই ব্যাটালিয়ন মং সার্কেলের সদর মানিকছড়ি উপজেলায় নিয়োজিত ছিল। গত ৪৮ বছরে বিভিন্ন সেনানিবাসে অবস্থানকালে খেলাধুলায়, লেখাপড়ায়, প্রশিক্ষণ প্রতিযোগিতায় এই ব্যাটালিয়ন প্রশংসনীয় ও দর্শনীয় সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। আমার ব্যক্তিগত মতে, দ্বিতীয় বেঙ্গলকে নিয়ে পৃথিবীর যেকোনো সেনাবাহিনী গর্ব করতে পারে। আবারো অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা : জুনিয়র টাইগারের প্রতি, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতি ও সমগ্র বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতি।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব:); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন