সব ধরনের বাধা ডিঙিয়ে খুলনায় বিএনপির গণসমাবেশ হয়েছে। চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহের পর খুলনার সমাবেশেও ছিল লোকে লোকারণ্য। সরকার ও সরকারি দলীয় বাধা যতই বাড়ছে, সমাবেশগুলোতে মানুষের সমাগমও ততই উপচে পড়ছে। রাজধানীর ঢাকার ১৬টি জোনে সভা-সমাবেশের পর গত ১২ অক্টোবর থেকে বিএনপির চলমান আন্দোলনের দ্বিতীয় ধাপের কর্মসূচি হিসেবে চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ড মাঠে শুরু হয় বিভাগীয় গণসমাবেশ। গত ২৭ সেপ্টেম্বর বিএনপি ৯টি বিভাগে গণসমাবেশের এ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। গণসমাবেশগুলোর মধ্যে ১৫ অক্টোবর ময়মনসিংহ এবং ২২ অক্টোবর খুলনা নিয়ে তিনটি গণসমাবেশ হয়েছে। এরপর ২৯ অক্টোবর রংপুর, ৫ নভেম্বর বরিশাল, ১২ নভেম্বর ফরিদপুর, ১৯ নভেম্বর সিলেট, ২৬ নভেম্বর কুমিল্লা, ৩ ডিসেম্বর রাজশাহী এবং ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় হবে মহাসমাবেশ। এর আগে প্রথম ধাপে ঢাকার জোনে জোনে সভা-সমাবেশ ছাড়াও বিএনপি দেশব্যাপী জেলা, উপজেলা, থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে। এসব কর্মসূচিতে ব্যাপক লোক সমাগমে দলটির নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হয়। বিভাগীয় গণসমাবেশে নেতাকর্মীদের উৎসাহ-উদ্দীপনা আরো বেড়ে গেছে। এসব গণসমাবেশে শুধু বিএনপি এবং সমমনা দলগুলোর নেতাকর্মী সমর্থকরাই অংশ নিচ্ছে না, সাধারণ মানুষও এসে সংহতি জানাচ্ছে। ইতোমধ্যে আন্দোলনের এসব কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে ভোলায় নুরে আলম ও আব্দুর রহিম, নারায়ণগঞ্জে শাওন, মুন্সীগঞ্জে শহিদুল ইসলাম শাওন এবং যশোরে আব্দুল আলিম নামে বিএনপির পাঁচজন কর্মী হত্যার শিকার হয়েছেন। বিএনপি কেন এসব কর্মসূচি পালন করছে? এ সম্পর্কে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ইতোমধ্যে বলেছেন, নিত্যপণ্যসহ সব ধরনের জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, দলের পাঁচ নেতাকর্মীকে হত্যার প্রতিবাদ এবং দলের চেয়ারপারসন দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনতে নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তারা আন্দোলনে রয়েছেন। আন্দোলনের অংশ হিসেবে এ গণসমাবেশ।
চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ডে বিএনপির গণসমাবেশ বানচাল করতে সরকার ও সরকারি দলের ক্যাডাররা ছিল মরিয়া। কিন্তু তাদের বাধা অতিক্রম করে পলোগ্রাউন্ডে যে সমাবেশ হয়েছে তা ছিল নজিরবিহীন। এরপর ময়মনসিংহের গণসমাবেশ পণ্ড করতেও সরকার উঠেপড়ে লেগেছিল। কিন্তু সমাবেশ রুখে দেয়া সম্ভব হয়নি। তেমনি ২২ অক্টোবরের খুলনার গণসমাবেশ রুখে দিতে হেন কাজ হয়নি, যা সরকার ও সরকারি দলের ক্যাডাররা করেনি। কিন্তু সেই সমাবেশও আলোড়ন তুলেছে। খুলনার গণসমাবেশ নিয়ে কয়েক দিন ধরে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে উত্তেজনা চলছিল। নানামুখী বাধাবিপত্তির মধ্যে সোনালী ব্যাংক চত্বরে এ সমাবেশে দলটির নেতাকর্মী-সমর্থক এবং সাধারণ মানুষ অংশ নিয়েছেন। গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, এ সমাবেশে অংশ নিতে খুলনা বিভাগের অধীন ১০ জেলার অনেক নেতাকর্মী দু’দিন আগে শহরে ঢুকে পড়েন। পিকআপ, অটোরিকশা, নছিমন ও ভটভটি, ট্রলারসহ নানা যানবাহনে এমনকি অনেকে হেঁটেও পৌঁছান খুলনায়। হোটেলে, আত্মীয়স্বজনের বাসাবাড়িতে এবং সমাবেশ চত্বর ও ফুটপাথেও অনেকে বিছানা বিছিয়ে রাত কাটিয়েছেন। সমাবেশের আগের রাতে দেখা যায় হাজার হাজার নেতাকর্মী ও সমর্থক পাটি, ত্রিপল, পলিথিন ও বিছানা পেতে সমাবেশ চত্বরে অবস্থান নেন। মধ্যরাত থেকে মঞ্চে বক্তৃতা শুরু হয়ে যায়। দুপুরের আগে সমাবেশস্থল কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। একপর্যায়ে গণজমায়েত সোনালী ব্যাংক চত্বর থেকে যশোর বোর্ডের পাওয়ার হাউজ ছাড়িয়ে সংগীতা সিনেমা হল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় খানজাহান আলী সড়ক, শেরেবাংলা সড়কসহ আশপাশেও লোকজন অবস্থান নেন।
অথচ এ গণসমাবেশ বন্ধ করতে সরকারের পুলিশ দু’তিন দিন বিএনপির পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীকে আটক করেছে। অনেককে মারধর করেছে। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন প্রায় ৫০ জন। ট্রলারে আসা নেতাকর্মীদের মেরে আহত করে ট্রলার পানিতে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে। খুলনা রেলওয়ে স্টেশনে বিএনপি নেতাকর্মীকে মারধর-হামলা করা হয়েছে। খুলনা শহরজুড়ে আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গ দলের ক্যাডাররা হকিস্টিক উঁচিয়ে মোটরসাইকেল মহড়া দিয়েছেন, মিছিল করেছেন। নেতাকর্মীদের বাড়িঘরে হামলা চালিয়েছেন। পরিকল্পিতভাবে বাস-মিনিবাস ধর্মঘট করা হয়েছে। যশোরে সব বাস আটকে দেয়া হয়েছে। নৌপথে লঞ্চ-ট্রলার আটকে দেয়া হয়েছে। স্টেশনে স্টেশনে ট্রেন আটকে দেয়া হয়েছে। মিডিয়ায় ট্রেনের ছবি প্রকাশিত হয়েছে। ঈদের সময় পুরো ট্রেন ভরে বাড়িতে মানুষ যাওয়ার যে দৃশ্য দেখা যায়, খুলনার সমাবেশেও একইভাবে ট্রেনভরে মানুষ এসেছে। অর্থাৎ কোনো বাধা মানুষকে খুলনার সমাবেশে যোগ দেয়া থেকে আটকাতে পারেনি।
সরকার ও সরকারি দলকে উদ্দেশ করে গণসমাবেশে প্রধান অতিথি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আপনারা স্থলপথ ও জলপথ বন্ধ করেছেন। পথে পথে হামলা, বাধা, হুমকি দিয়েছেন। পুলিশ দিয়ে হয়রানি করেছেন। কিন্তু দেখুন আপনাদের সীমাহীন বাধা ডিঙিয়ে মানুষ কিভাবে গণসমাবেশে সফল করেছেন। এ সমাবেশের জন্য আমাদের প্রচার চালাতে হয়নি। আপনারাই এ জন্যে যথেষ্ট ছিলেন। তিনি গণসমাবেশ সফল করার জন্য নেতাকর্মীদের অভিবাদন জানিয়ে বলেন, আপনারা অসাধ্য সাধন করেছেন। তিন দিন ধরে জলেস্থলে সব পরিবহন বন্ধ করে দেয়া সত্তে¡ও আপনারা হাজির হয়েছেন। গণতন্ত্রের জন্য, ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আপনাদের যে আকাক্সক্ষা, যে লড়াই তাকে বাধা দিয়ে সরকার রুখতে পারেনি। ইতিহাস বলে শুধু বল প্রয়োগ করে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে মানুষকে দমিয়ে রাখা যায় না।
খাদ্যাভাবের আশঙ্কা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সা¤প্রতিক বক্তব্যের কথা উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, আপনি কয়েক দিন ধরে দুর্ভিক্ষ হওয়ার কথা বলছেন। কেন আপনি দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন। এর আগে তো বলেছেন, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে গেছে। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, ওই দুর্ভিক্ষের ওপর অমর্ত্য সেন তার বইয়ে লিখেছেন, আওয়ামী লীগের ব্যর্থতার জন্য সেই দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। সেই ব্যর্থতা ছিল তাদের দুঃশাসন, তাদের লুটপাট। এবারো তো লুটপাট কম করেননি। সারা দেশকেই তো লুট করে নিয়েছেন। এখন বুঝতে পারছেন দেশ চলছে না। মানুষ জেগে উঠছে। তাই দুর্ভিক্ষের কথা বলছেন। আপনাদের দুঃশাসনে দেশ নরকে পরিণত হয়েছে। অর্থনীতি এবং দেশের সব অর্জন ধ্বংস হয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। ২০১৪ সালে এবং ২০১৮ সালে মানুষকে ভোট দিতে দেননি। আবার একই কায়দায় ভোট ডাকাতি করে ক্ষমতায় থাকতে চাচ্ছেন। আমরা পরিষ্কার করে বলছি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। সুতরাং আর কোনো কথা নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার না দিলে কোনো নির্বাচন হবে না। আপনারা পদত্যাগ করুন, দেশের মানুষ সেটাই চায়। গণসমাবেশে তিনি জানান যে, বিএনপি ক্ষমতায় এলে তরুণ-যুবকদের জন্য চাকরি ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে, দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে এবং মেগা প্রজেক্ট করে শেখ হাসিনার সরকার যে মেগা দুর্নীতি করেছেন, কমিশন করে দুর্নীতিবাজদের বিচার করবে। বিএনপি বিভাগীয় গণসমাবেশগুলোতে মঞ্চে একটি চেয়ার খালি রাখা হয়। খুলনার সমাবেশে মঞ্চেও ছিল। এ প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার জন্য এই চেয়ার। তাকে অন্যায়ভাবে সাজা দেয়া হয়েছে। তার প্রতি অবিচার করা হয়েছে। তিনি এখন গুরুতর অসুস্থ। আমাদের বলেছেন, তোমরা সঠিক পথে আছ। এভাবে দেশ এবং মানুষকে বাঁচানোর জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যাও। জনগণের অধিকারকে আদায় করে নিয়ে আসো। আমরা সে জন্যই তাকে প্রতিটি সমাবেশে স্মরণ করে এ চেয়ার খালি রাখছি। তিনি আন্দোলন-সংগ্রামে আমাদের প্রেরণা। তিনি দেশ ও মানুষের প্রেরণা। আশা-ভরসার স্থল।
ঢাকার মহাসমাবেশ
আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় যে মহাসমাবেশ হবে সেটাই সরকারের মাথাব্যথার কারণ। সেই মহাসমাবেশকে জনসমুদ্রে পরিণত করতে এখন থেকে প্রস্তুতি চলছে। সেই মহাসমাবেশে সারা দেশ থেকে আসবেন মানুষ। ‘চলো চলো ঢাকায় চলো’- স্লোগান দিয়ে মানুষ যোগ দেবেন ঢাকার মহাসমাবেশে। বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয় অর্জন করেছি। এ দিনটি আমাদের বিজয় দিবস। তাই বিজয়ের এ মাসে আরেক বিজয় অর্জন করবেন মানুষ। সেটা হচ্ছে গণতন্ত্রের বিজয়। ভোটের অধিকার পুনরুদ্ধারের বিজয়। এ জন্য মহাসমাবেশ থেকে সরকারকে বার্তা দেয়া হবে। সেই বার্তা হচ্ছে মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, মানুষের মৌলিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য, আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। সরকারের পদত্যাগের পর দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনবে।
সরকার কী বার্তা পাচ্ছে
এক এগারো জরুরি সরকারের সাথে আঁতাত করে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে শেখ হাসিনার কর্তৃত্বপরায়ণ সরকার গত ১৪ বছর ধরে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছে। দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। ধ্বংস হয়ে গেছে নির্বাচনব্যবস্থা, হারিয়ে গেছে গণতন্ত্র। আইনের শাসন বলে দেশে কিছু নেই। নেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। নেই মিডিয়ার স্বাধীনতা। এর মধ্যে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ দিশেহারা। শুধু খাদ্যপণ্যই নয়, যাতায়াত, পরিবহন, শিক্ষা, চিকিৎসা সব ধরনের ব্যয় বেড়ে গেছে। মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। সংসার চালাতে পারছে না মানুষ। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত এবং গরিব মানুষ সবচেয়ে কষ্টে জীবন যাপন করছে। আর পারছে না মানুষ। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। তাই জেগে উঠেছে মানুষ। গত দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপিকে শেষ করে দেয়ার সব ধরনের অপচেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে একজন নেতাকর্মীও বিএনপি ছেড়ে যাননি। বরং দিন দিন বিএনপির প্রতিই মানুষ আকৃষ্ট হচ্ছে। সাম্প্রতিক গণসমাবেশগুলোতে এ যে এত বিপুল লোক সমাগম এটা তারই অংশ। মানুষ সরকারকে এ বার্তাই দিচ্ছে যে, তাদের দিন শেষ। অন্যায় অপশাসন আর দেশে চলবে না। মানুষকে আর কষ্ট দেয়া চলবে না। গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিতে হবে। ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। বিনা ভোটে, রাতের ভোটে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখা যাবে না। কথায় কথায় সিন্ডিকেট করে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে, বিদ্যুতের লোডশেডিং করে মানুষকে কষ্ট দেয়া যাবে না। মানুষের কষ্টার্জিত টাকা পাচার করে বিদেশে নেয়া যাবে না।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন