কেমন হবে ঢাকার দুই সিটির নির্বাচন
09 January 2020, Thursday
নতুন বছরের ৩০ জানুয়ারি ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ—দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হওয়ার কথা। তবে ওই তারিখে ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া কতটা যৌক্তিক হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, কারণ ওই দিন হিন্দুধর্মাবলম্বীদের গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব সরস্বতীপূজা। এটি মাথায় রেখে ভোটের দিন পরিবর্তন হতেও পারে।
বিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচন ২০১৫ সালের এপ্রিলে এর আগের নির্বাচন কমিশনের মেয়াদকালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ওই নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে—কোনো মানদণ্ডেই তা বলা যায় না—যদিও নির্বাচিত দুই মেয়র যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছিলেন।
ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুর কয়েক মাস পর উপনির্বাচনে নির্বাচিত হন আতিকুল ইসলাম। ওই উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি দেখে মনে হয়েছে ভোটাররা বিগত প্রায় ১০ বছর ধরে হওয়া বিভিন্ন ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের কারণে ভোট দেওয়ায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সামনে এই সিটি নির্বাচন নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আসন্ন নির্বাচনে তিনটি বড় দলই প্রার্থী দিয়েছে। বিএনপির যোগদান এই নির্বাচনকে শুধু প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করবে তা-ই নয়, সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সামনে এটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
ইতিমধ্যেই নির্বাচনে ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) ব্যবহার হবে বলে নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এ নিয়ে বিএনপি পুনরায় বিতর্ক জুড়েছে। তা ছাড়া, জনমনেও নানা সন্দেহ দানা বাঁধছে। বিশেষ করে ইভিএমের কার্যকারিতা কতটুকু, ভোটার এটি ঠিকঠাক ব্যবহার করতে পারবেন কি না এবং ভোটে নিরাপত্তা দেওয়া হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। অবশ্য নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যে মক ভোটের মাধ্যমে ভোটারদের এর কার্যকারিতা ও ব্যবহারপদ্ধতি দেখাতে কিছু কিছু জায়গায় ইভিএম রেখেছে। তবে এর মাধ্যমে ৫০ লাখ ভোটারকে সম্যক ধারণা দেওয়া সম্ভব নয়।
ইভিএম যদিও নিখুঁত পদ্ধতি, তবে জনগণের মনের শঙ্কা দূর করতে ব্যাপক প্রচারের প্রয়োজন রয়েছে। টেলিভিশনে ইভিএম সম্বন্ধে ভিডিও চিত্রের মাধ্যমে ধারণা দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। অপরদিকে নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন দলের কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে তাঁদের সংশয় দূর করতে পারে। এটা করা না হলে গোটা রাজধানীতে ব্যবহার না করে কিছু নির্বাচিত ওয়ার্ডে তা ব্যবহার করার চিন্তা করা যেতে পারে।
ইভিএম একটি যুগান্তকারী ও নিরঙ্কুশ ব্যবস্থাপনার হাতিয়ার হলেও বিগত ও বর্তমান নির্বাচন কমিশন জনগণকে এর সঙ্গে পরিচিত করানোর যথেষ্ট পদক্ষেপ নিয়েছে বলে মনে হয় না। যেহেতু ভবিষ্যতের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার উন্নতির জন্য ইভিএমের মতো উন্নত ব্যবস্থা সংযোজন করা হতে যাচ্ছে, সেহেতু শুধু নির্বাচনের আগে নয়, অন্য সময়েও এসব উন্নত ব্যবস্থাপনার উপাদানের সঙ্গে সাধারণ ভোটারদের পরিচিত করার প্রক্রিয়া জারি রাখতে হবে।
বিগত লোকসভা নির্বাচনের আগে ইভিএম নিয়ে ভারতেও বিতর্ক উঠেছিল, কিন্তু নির্বাচনে পরাজয় ইভিএমের কারণে হয়েছে, এমন দাবি কেউই করেনি। ভারতের ইভিএমে ‘পেপার ট্রেইল’ (ভিভিপিএটি) ব্যবহার করা হয়, যা নির্ধারিত সংখ্যার ইভিএমের ফলাফলের বা গণনার সঙ্গে মেলানো হয়। কাজেই সন্দেহের অবকাশ খুব কম থাকে। তবে বুথ দখল হয়ে গেলে ইভিএম কারসাজি ঠেকানো কঠিন। অতীতের নির্বাচনগুলোতে এমনই দেখা গেছে, যা বর্তমান নির্বাচন কমিশন স্বীকারও করেছে।
সিটি করপোরেশন তফসিল ঘোষণাকালে এই নির্বাচনকে সুষ্ঠু করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। মনে করা হয়েছিল, অতীতের ভুলভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে হয়তো তারা এমন প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, শুরুতেই তারা হোঁচট খেয়েছে। নির্বাচন কেমন হবে বা হতে যাচ্ছে, তা নির্ণয়ে বিশ্বস্বীকৃত কতগুলো নিয়ামক রয়েছে। ওই সব নিয়ামকের মানদণ্ডেই নির্ণয় করা যায় ভোটসহ নির্বাচনপ্রক্রিয়া কেমন হবে বা হতে যাচ্ছে। নির্বাচন প্রক্রিয়া বলতে শুধু ভোটের দিনকেই বোঝায় না বরং তফসিল ঘোষণার পর থেকে গেজেট প্রকাশ পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াকে বোঝায়। আর নির্বাচন ব্যবস্থাপনার (ইলেকটোরাল গভর্ন্যান্স) বিষয়টি একটি নির্বাচন থেকে আরেকটি নির্বাচন পর্যন্ত সামগ্রিক কার্যক্রমকে বোঝায়। এ সময়ে নির্বাচনের প্রক্রিয়া, আইন ও বিধি ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনার কর্মসম্পাদন করা হয়।
যাই হোক, প্রশ্ন ছিল আগামী এই নির্বাচন কেমন হবে? এর যথার্থ উত্তর এখনই দেওয়া কঠিন। তবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান প্রয়োগে নির্বাচন কমিশন যে হোঁচট খেয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। আচরণ বিধিমালার ধারা ১১-তে উল্লিখিত মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় আচরণ ভঙ্গের ঘটনা ঘটেছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি হতাশ যে, নির্বাচন কমিশনের নিয়োজিত দুজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা, যাঁরা রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োজিত হয়েছেন, তাঁরা এ ব্যত্যয়কে বিবেচনায় নেননি।
এই ধারাটি বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, বহু বয়োজ্যেষ্ঠ নেতার মতামত নিয়ে এবং সব দলের সম্মতি নিয়ে আচরণবিধি তৈরি করা হয়েছিল, যার একটি হলো মনোনয়ন দাখিলের প্রক্রিয়া। শোডাউন বন্ধ করা হয়েছিল, কারণ, মনোনয়ন দাখিলের সময়েই একজন প্রার্থীকে এই শোডাউন করতে প্রচুর অর্থ খরচ করতে হয়। এ ধরনের শোডাউনে জনদুর্ভোগ বাড়ে এবং সর্বোপরি নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় অরাজকতার সূত্রপাত হয়।
২০০৮-১২ পর্যন্ত এ ধারা শক্তভাবে প্রয়োগ করা গেলেও এর পরে এই শিথিলতা কেন হয়েছে, তার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। একজন রিটার্নিং কর্মকর্তা এ ব্যত্যয়কে ধর্তব্যের মধ্যে না নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন বলে পত্রিকায় এসেছে, তা বেশ দুঃখজনক। সামনে আরও আইনের কঠোর প্রয়োগের পরিস্থিতির উদ্ভব হবে। এখনই যদি শিথিলতা দেখানো হয়, তাহলে সামনের দিনগুলোতে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির প্রতিটি নিয়ামকে ব্যত্যয় ঘটবে।
বিশ্বে যেসব দেশে সংবিধান দ্বারা সৃষ্ট স্বাধীন নির্বাচন কমিশন কার্যকর রয়েছে, সেগুলোর আদলে আমাদের দেশের নির্বাচন কমিশন আধা বিচারিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গঠিত হয়েছে। প্রচুর ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সংবিধান, আইনবিধি ও পরিপত্রের মাধ্যমে। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের বিধি প্রণয়নের ও প্রয়োগের ক্ষমতা রয়েছে, যা আইন দ্বারা সমর্থিত। আচরণবিধিও তেমনি। আইন ও বিধি প্রয়োগের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন নিয়োজিত নির্বাচনী কর্মকর্তা, বিশেষ করে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নির্বাচন কমিশনের পক্ষে বিচারক বা হাকিমের ভূমিকা পালন করেন। রিটার্নিং কর্মকর্তাকে মনোনয়নপত্র গ্রহণ এবং আইন ও বিধিমতো না হলে তা প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
আলোচিত ধারাতেও ধারার ব্যত্যয় ঘটলে জেল, জরিমানা ছাড়াও মনোনয়নপত্র গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার নির্বাচন কর্মকর্তার রয়েছে। কাজেই রিটার্নিং কর্মকর্তাদের অসহায়ত্বের কোনো অবকাশ নেই।
ভারতের নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা আমাদের মতোই, ক্ষেত্রবিশেষে অনেকাংশে আমাদের কমিশন থেকেও আইনের দিক থেকে সমান নয়। ভারতের ‘মডেল কোড অব কনডাক্ট’ বা আচরণবিধি আইন দ্বারা সিদ্ধ নয়। এটি সর্বদলের সম্মতিক্রমে প্রস্তুত করা, তথাপি নির্বাচন কমিশন যেমন প্রয়োগ করে, তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোও মানতে বাধ্য থাকে। অন্যথায় আদালতের হস্তক্ষেপ হয়ে থাকে।
ভারতের তুলনায় আমাদের আইন ও বিধি শক্তিশালী হলেও প্রয়োগের বেলায় আমাদের নির্বাচন কমিশনকে হতবিহ্বল হতে দেখি, যা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য মোটেও সহায়ক নয়। শুরু থেকেই আইন ও বিধির ব্যত্যয় ঘটলে পরবর্তী সময়ে সামাল দেওয়া কঠিন হবে।
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, বর্তমানে অনারারি ফেলো
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন