কক্সবাজারের উখিয়ার মধুরছড়া আশ্রয়শিবিরে উঁচু পাহাড় কেটে তৈরি ঝুঁকিপূর্ণ রোহিঙ্গা বসতি। গত রোববার বিকেলে তোলা ছবি। প্রথম আলো
বাংলাদেশে এখন যে ১১ লাখের মতো রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে, তাদের ভরণপোষণের ৭৫ শতাংশ এখন বাংলাদেশই বহন করছে বলে সরকারিভাবে বলা হচ্ছে। আজ দুই বছরের মাথায় এসে রোহিঙ্গা সংকটের নানা ধরনের ডালপালা গজাচ্ছে, যার অনুমান দেশের অনেক বিশ্লেষক করেছিলেন বেশ আগেই। মিয়ানমার যে বর্বরোচিত কায়দায় রোহিঙ্গাদের দেশ থেকে উচ্ছেদ করেছিল, তারপর বাংলাদেশে যখন দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে উদ্বাস্তুদের ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেয়, তখনই অনেক বিশ্লেষক এর পরিণতি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। আমার মনে হয়, দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করতে গিয়ে আমরা অনেক সময় নষ্ট করেছি। মিয়ানমার রাষ্ট্রের গঠন এবং চরিত্র সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণেই সম্ভবত এমনটি হয়েছে। সেই অজ্ঞতা দূর হয়েছে—এমনটি বলা যাচ্ছে না। এটা আমাদের মনে রাখা জরুরি যে মিয়ানমার অত্যন্ত কঠিন একটি দেশ এবং মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী হত্যাযজ্ঞ ও নৃশংসতায় সিদ্ধহস্ত। কাচিন, সান এবং মিয়ানমারের অন্যান্য জাতিগত গোষ্ঠীর ওপর অমানবিক অত্যাচার ও নির্যাতনের কারণে দেশটির বর্তমান সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান অং হ্লাইংয়ের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে মানবতাবিরোধী কর্মযজ্ঞের নালিশ রয়েছে। এবং রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞের সঙ্গেও তিনি জড়িত।
রোহিঙ্গা সংকট মিয়ানমারের ভেতরে হঠাৎ শুরু হয়নি। মিয়ানমার (তৎকালীন বার্মা) স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে তৎকালীন আরাকানে (এখনকার রাখাইন) বৌদ্ধ সম্প্রদায় ও রোহিঙ্গাদের সংঘাত ঘটে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে অনেক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী কালাদান নদীর উত্তরে চলে আসে। উত্তরের তিনটি জেলা মংডু, বুচিডং ও রথিডংয়ের বেশির ভাগেই রোহিঙ্গাদের নিবাস ছিল। এই তিন অঞ্চলেই রোহিঙ্গারা প্রায় ৮০ শতাংশ ছিল।
বৌদ্ধ রাখাইনদের আক্রমণ ঠেকাতে এবং উত্তর আরাকানকে আলাদা করার অথবা নিদেনপক্ষে স্বায়ত্তশাসন কায়েম করার উদ্দেশ্যেই ১৯৪৭-৬১ সাল পর্যন্ত রোহিঙ্গা মুজাহিদিনরা অভ্যন্তরীণ যুদ্ধে লিপ্ত ছিল তৎকালীন বার্মার উপজাতীয়দের মতো। ১৯৬১ সালে তৎকালীন উনু সরকারের সঙ্গে রোহিঙ্গা মুজাহিদিনদের শান্তি আলোচনা হয়। আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আত্মসমর্পণ করে রোহিঙ্গা মুজাহিদিনরা। শান্তি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ১৯৬১ সালে উনু সরকার উত্তর আরাকানে (রাখাইন) মংডু, বুচিডং ও রথিডংয়ের পশ্চিমাংশ নিয়ে ‘মাইয়ু ফ্রন্টিয়ার ডিস্ট্রিক্ট’ গঠনের ঘোষণা দেয়। ওই সময় উনু আরাকান স্টেট তৈরির ঘোষণার সঙ্গে অনেকখানি স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থাও করেছিলেন। ১৯৬২ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর মাইয়ু ফ্রন্টিয়ার ডিস্ট্রিক্ট বাতিল হয় এবং রোহিঙ্গাদের উপজাতি গোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া রদ করা হয়।
রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত করার পরিকল্পনা সেই সামরিক সরকার গঠনের পর থেকেই শুরু হয়েছিল। যার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কয়েকবার উচ্ছেদের প্রক্রিয়াও হয়েছিল। ১৯৭৮, ১৯৯২ সালে দুই দফা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে হয়েছিল বাংলাদেশে। সে বিষয় এখন ইতিহাস। ওই সময়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় কিছু সমাধান হলেও ১৯৯২-৯৩ সালে সব রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়া হয়নি।
ওপরের প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গা সংকটে আমাদের জড়িয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা নতুন নয়। তবে নতুন বিষয় যে এবারের সংকট প্রথম থেকেই দ্বিপক্ষীয় থাকেনি। কারণ, এবারের মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এবং তথাকথিত বেসামরিক গণতান্ত্রিক সরকার একযোগে ২০১২ সাল থেকে রোহিঙ্গাদের ভিটেবাড়ি থেকে উৎখাতের পরিকল্পনা নিয়ে নেমেছিল, তা ছিল বিশ্ব মানবাধিকারের লঙ্ঘন। কোনো রাখঢাক নয়, প্রকাশ্যে রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি’ আখ্যা দিয়ে পরিকল্পিত নির্যাতন চলে। নিষিদ্ধ করা হয় চলাফেরা, এমনকি এক পাড়া থেকে অন্য পাড়ায় চলাচল। অবশেষে শেষ অভিযান হয় আরসা নামক কথিত রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর আক্রমণের প্রেক্ষাপটে। যেভাবে রোহিঙ্গাদের উৎখাত করা হয়েছে, তার বিপরীতে একই সামরিক ও বেসামরিক জান্তা সেই মানুষগুলোকে এখন সম্মানের সঙ্গে ফিরিয়ে নেবে—এমন ভাবাটাও একেবারে অযৌক্তিক। এরই প্রতিফলন আমরা দেখছি আগস্ট ২৫, ২০১৯ তারিখে।
মিয়ানমারের অবস্থান এমন শক্ত কিসের জোরে, সে বিষয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে। উল্লেখ্য, চীন, ভারত, রাশিয়া ও জাপান, যাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো, তাদের প্রত্যেকেই মিয়ানমারকে শক্তভাবে সমর্থন করায় পশ্চিমা বিশ্ব তথা জাতিসংঘের তোড়জোড়ে মিয়ানমার মোটেই বিচলিত নয়। আমাদের দুই নিকটতম প্রতিবেশী ভারত এবং চীন কার্যত মিয়ানমারের পক্ষেই রয়েছে। গত ২২ আগস্ট বাংলাদেশ যখন ৩ হাজার ৫৪০ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছিল, তখন সেখানে চীনা দূতাবাসের প্রতিনিধির উপস্থিতি চীনের সহযোগিতার কিছু বার্তা দিলেও মিয়ানমারে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যে তেমন মনে হয়নি। চীনের রাষ্ট্রদূত চেন হাই মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সিনিয়র জেনারেল অং হ্লাইংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, মিয়ানমারের ওপর বিভিন্ন বিষয়ে যতই চাপ আসুক, চীন পাশে থাকবে। এ বক্তব্যই পরিষ্কার করে চীনের অবস্থান।
বাস্তবতা হচ্ছে, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) এশিয়ায় অন্যতম খুঁটি মিয়ানমার। চীনের কথিত সামুদ্রিক সিল্ক রুটের গন্তব্য শেষ হয় দক্ষিণ রাখাইনের বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগরের মিলনস্থলে। এখান থেকে চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডরের শুরু। ওই অঞ্চলে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ শেষের পথে এবং তেল-গ্যাস পাইপলাইন কার্যকর করা হয়েছে। রেললাইন প্রকল্পের প্রাথমিক কাজ শুরু হওয়ার পথে রয়েছে।
মিয়ানমারে চীনের অর্থনৈতিক উদ্যোগের মধ্যে অন্যতম আরেকটি উদ্যোগ মাইটসন হাইড্রো-ইলেকট্রিক বাঁধ। এই বাঁধ তৈরি হওয়ার কথা ইরাবতী নদীর পানির উৎস মালি এবং ন’মাই নদীর সংযোগস্থলে। প্রকল্পটির আনুমানিক খরচ ২০১৭ সালে ধরা হয়েছিল ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার, কিন্তু ওই সময়ে স্থানীয় মানুষের চাপে বাতিল করা হয়েছিল। এখন (২০১৯) চীন মিয়ানমারকে নতুন করে এই প্রকল্পে রাজি করাতে পেরেছে বলে জানা গেছে। নতুন খরচ দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার। এই খরচের মধ্যে স্থানীয়দের ক্ষতিপূরণের বিষয়টিও রয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে প্রতিবছর ৩০ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে, যার ৯০ শতাংশ চীনের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের শিল্পায়নের জন্য প্রয়োজন হবে। চীনের এই অঞ্চলে ব্যাপক বিদ্যুৎ ঘাটতি রয়েছে, যে কারণে চীন এই প্রকল্পের জন্য মরিয়া হয়ে রয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে চীন যে মিয়ানমারের অবস্থানকেই শক্তভাবে সমর্থন করে যাবে, তা পরিষ্কার। আমাদের জন্য চীন মিয়ানমারের ওপরে তেমন চাপ দিতে পারবে বলে মনে হয় না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, প্রচণ্ড চাপের মাধ্যমে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের মৌলিক দাবিগুলো মানাতে না পারলে এ সংকটের সমাধান শুধু কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় হবে বলে মনে হয় না। তথাপি এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে আরও চাপ প্রয়োগ করা ছাড়া বিকল্প নেই। একই সঙ্গে যে দাবিটি উঠতে পারে সেটি হলো, রোহিঙ্গাদের গোত্র পরিচয়ে নাগরিকত্ব, যা মিয়ানমারে একসময় তাদের ছিল, ফিরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি ১৯৬১ সালের মাইয়ু ফ্রন্টিয়ার ডিস্ট্রিক্ট-এর মতো ওই তিন জেলা নিয়ে, দি ওয়া পালাং, দানো পাও কোকাং-এর আদলে অঞ্চল তৈরি করে সীমিত স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা। এ অধিকার পেতে হলে রোহিঙ্গাদের ‘রোহিঙ্গা’ হিসেবে নাগরিকত্ব থাকতে হবে। এ কারণেই অত্যন্ত সুচারুরূপে ১৯৮২ সালে নাগরিক ও গোত্র হিসাবের জন্য ১৮২৩-কে ভিত্তি ধরা হয়েছে। কারণ, মিয়ানমার বা বার্মা মনে করে, ওই সময়ে প্রথম অ্যাংলো-বার্মা যুদ্ধের পর আজকের রোহিঙ্গারা তৎকালীন আকিয়াবে এসেছিল, যা ঐতিহাসিক গবেষণায় ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
নাগরিকত্বের বিষয়ে রোহিঙ্গাদের দাবি নিয়ে শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা নেতাদেরও সোচ্চার হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ রোহিঙ্গা নেতাদের কথাও শুনতে পারে। জাতিসংঘের আমন্ত্রণেই এই নেতাদের উপস্থিতি হতে পারে। বাংলাদেশ মানবিক বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে যে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে, তা অপূরণীয়। যে পাহাড় ধ্বংস হয়েছে, তা আর গজিয়ে উঠবে না। যে পরিবেশ ধ্বংস হয়েছে, তা ফিরে পাওয়ার নয়। রোহিঙ্গা সংকট শুধু বাংলাদেশেরই নয়; এ মানবতার সংকট তৈরি করেছে মিয়ানমার এবং এর প্রতিকারও মিয়ানমারকে করতে হবে। দায়িত্ব রয়েছে বিশ্বের বড় দেশগুলোর। শুধু মুখের বাণী নয়, এ সমস্যার যৌক্তিক সমাধানে বিশ্ববাসী ব্যর্থ হলে আরেক ‘ফিলিস্তিনের’ জন্ম নেবে পূর্ব প্রান্তে।
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, বর্তমানে অনারারি ফেলো এসআইপিজিএনএসইউ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন