
শ্রম অসন্তোষ, ডলার সংকট, উচ্চ সুদহার, গ্যাস-বিদ্যুত্ সংকটে ভুগছে দেশের পোশাক খাত। ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরও এখনো এই খাতের অস্থিরতা কাটেনি। বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে পোশাক শ্রমিকরা নিয়মিতই মাঠে নামছেন। এ ছাড়া গ্যাস সংকটসহ নানামুখী সমস্যায় কমেছে উত্পাদন।
রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে রপ্তানিকারকরা সময় মতো উত্পাদন, রপ্তানি, কাঁচামাল আমদানি এবং পরিবহন সংকটে কয়েকটি আন্তর্জাতিক ক্রেতা ও ব্র্যান্ড এ দেশ থেকে কার্যাদেশ সরিয়ে নিচ্ছে।
আর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে ভারতসহ প্রতিযোগী দেশগুলো লাভবান হচ্ছে। ভারত সরকার নিজ দেশের পোশাক রপ্তানিকারকদের আর্থিক সহায়তা বাড়ানোর পরিকল্পনা করায় বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে আরো বাধার মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা। এরপর এই পোশাকশিল্পই দেশের অর্থনীতির মূল কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। দেশের মোট জিডিপির ১০ শতাংশ আসে পোশাক খাত থেকে। এর মধ্যে কেবল গত বছরই ৫৪ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ।
ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিস্টিক্যাল রিভিউ ২০২৩-এর তথ্যানুযায়ী, ২০০৫ সালে বিশ্ববজারে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের অংশ ছিল ২.৫ শতাংশ, কিন্তু গত বছর তা বেড়ে হয়েছে ৭.৯ শতাংশ। ২০০০ সালে বাংলাদেশ ৪.৮২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পোশাক রপ্তানি করেছিল। তবে গত ২২ বছরে রপ্তানির পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে এবং গত বছর পোশাক রপ্তানি থেকে ৩৫ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে।
গত দুই দশকে পোশাক খাতের এই সম্প্রসারণের পেছনে কয়েকটি কারণ আছে। এর অন্যতম হলো চীনের পরে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক সরবরাহকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করেছে। একই সঙ্গে বৈশ্বিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের অংশীদারি বেড়েছে। পোশাক খাতের এই সম্প্রসারণের অন্যতম চালিকা শক্তি হচ্ছে সম্প্রসারিত প্রাইমারি টেক্সটাইল খাত, যেখানে এরই মধ্যে ২৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ করা হয়েছে।
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের কয়েকটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তারা নতুন করে ৫৪ মিলিয়ন ডলারের অর্ডার পেয়েছে। নয়াদিল্লির বাইরের আরেকটি গ্রুপ জানিয়েছে, গত আগস্টে তারা স্প্যানিশ ফ্যাশন ফার্ম জারার কাছ থেকে ১৫ শতাংশের বেশি অর্ডার পেয়েছে।
গত এক বছরে তৈরি পোশাক, নিটওয়্যার ও টেক্সটাইলশিল্পের ১৪০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে তৈরি পোশাক খাতে ৭৬টি, নিট খাতে ৫০টি এবং টেক্সটাইল খাতের ১৪টি কারখানা রয়েছে। এক বছরে ১৪০টি কারখানার মোট ৯৪ হাজার কর্মী চাকরি হারিয়েছেন বলে খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) জানিয়েছে, এক বছরে সংগঠনটির সদস্যভুক্ত ৭৬টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এসব কারখানায় কাজ করা ৫১ হাজার কর্মী চাকরি হারিয়েছেন। শ্রমিকদের ঠিকমতো বেতন দিতে পারছে না অন্তত ১৫৮টি কারখানা।
এদিকে তৈরি পোশাকের রপ্তানি ক্রয়াদেশ না থাকা ও কাঁচামাল আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলতে না পারায় বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের ১৬টি কারখানা লে-অফ বা বন্ধ ঘোষণা করেছে বেক্সিমকো গ্রুপ কর্তৃপক্ষ। এতে প্রায় ৪০ হাজার পোশাক শ্রমিক কর্মচ্যুত হয়েছেন। এর অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে পোশাকশিল্প এলাকায়।
জানতে চাইলে তৈরি পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পোশাক খাত দেশের অর্থনীতি আর কর্মসংস্থানে বড় ধরনের অবদান রাখছে। তবে এখন নজর দিতে হবে উচ্চ মূল্যের পোশাক উত্পাদনে। এ জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন, গ্যাস-বিদ্যুত্ এবং ব্যাংকিং সেবা ও দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে। বাড়াতে হবে প্রযুক্তির নির্ভরতাও।
কাঁচামাল আমদানির এলসি কমেছে ৩৩ শতাংশ
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ঋণপত্র বা এলসি খোলা হয়েছে ৫৮ কোটি মার্কিন ডলারের। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল প্রায় ৮৭ কোটি ডলার। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ঋণপত্র খোলা কমেছে ২৯ কোটি ডলার বা ৩৩ শতাংশ।
ঋণপত্র খোলা কমার পাশাপাশি কমেছে ঋণপত্র নিষ্পত্তির হারও। চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তি হয়েছে ৬৯ কোটি ডলারের। গত অর্থবছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ৮৫ কোটি ডলারের। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে ১৬ কোটি ডলারের বা ১৯ শতাংশ।
মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র খোলা কমে যাওয়ার অর্থ হলো বিনিয়োগ থমকে যাওয়া। আর বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থানের সুযোগও বাড়বে না। ফলে অর্থনীতিতে দীর্ঘ মেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সমিতি বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পোশাক খাতের কার্যাদেশ কিছু বাড়লেও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এসব কারখানার ক্রয়াদেশ দেশের মধ্যে অন্য কারখানগুলো পেয়েছে। তা ছাড়া চীন থেকে স্থানান্তরিত ক্রয়াদেশের একটি অংশ পাচ্ছে বাংলাদেশের কারখানাগুলো। তবে বর্তমানে সব কিছু ছাপিয়ে শিল্পাঞ্চলের আইন-শৃঙ্খলা ও কারখানার নিরাপত্তা বড় দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
তৈরি পোশাক খাতের ৬০০-৭০০ বিলিয়ন ডলারের বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অনেক সুযোগ আছে উল্লেখ করে বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘চীন থেকে স্থানান্তরিত এবং আমেরিকার চায়না বিমুখ এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারছে না বাংলাদেশ। এ জন্য দেশের পোশাক খাতের টেকসই উন্নয়ন অপরিহার্য। এ ছাড়া যে সব পণ্যে দেশের সক্ষমতা আছে সেসব পণ্য নিয়ে বিশ্ববাজারে কাজ করতে হবে। সনাতন কাপড়ের পরিবর্তে প্রাকৃতিক তন্তুর পোশাকের (ম্যান মেইড ফাইবারের) ওপর জোর দিতে হবে। মৌলিক পোশাক রপ্তানির নির্ভরতা কমিয়ে সুপরিকল্পিত এবং সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।
প্রসঙ্গত রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর (বায়োমেট্রিকস ডেটাবেইস অনুসারে) তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে তৈরি পোশাক কারখানায় ৩৩ লাখ ১৭ হাজার ৩৯৭ জন শ্রমিক রয়েছেন। এর মধ্যে ৫২.২৮ শতাংশই নারী শ্রমিক। সংখ্যার হিসাবে নারী শ্রমিক রয়েছেন ১৭ লাখ ৩৪ হাজার ৪৫৯ জন।
অন্যদিকে নিট (গেঞ্জিজাতীয় পোশাক উত্পাদন) পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর তথ্যানুযায়ী, নিট সেক্টরে ১৭ লাখ ২৫৫ জন শ্রমিক রয়েছেন। যার ৬২ শতাংশ অর্থাত্ ১০ লাখ ৫৪ হাজার ১৫৭ জন নারী। সব মিলিয়ে দেশে তৈরি পোশাক খাতে ৫০ লাখ ১৭ হাজার ৬৫২ জন শ্রমিক রয়েছেন। যার ৫৫.৫৭ শতাংশ অর্থাত্ ২৭ লাখ ৮৮ হাজার ৬১৬ জন নারী শ্রমিক।
তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, তৈরি পোশাক খাতে মোট লোকবল ৪৩ লাখ ১৬ হাজার জন বলে জানায় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। বিবিএসের জরিপের তথ্যানুযায়ী তৈরি পোশাক খাতের ৩৭.৫১ শতাংশ অর্থাত্ ১৬ লাখ ১৯ হাজার জন নারী শ্রমিক।