
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ‘লাইভে’ এসে থানা পুলিশের এক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) পেটানোর হুমকি দিয়েছে চট্টগ্রামের চিহ্নিত শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ হোসেন। মঙ্গলবার (২৯ জানুয়ারি) রাত ১০টা ৩৯ মিনিটে নিজের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে ‘লাইভে’ এসে নগর পুলিশের বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসি আরিফুর রহমানকে এমন হুমকি দেয় সে। লাইভে এই তরুণ ‘কোনও অবস্থাতেই তার হাত থেকে ওসি বাঁচতে পারবেন না’ বলেও হুঁশিয়ারি দেয়। ২ মিনিট ২৭ সেকেন্ডের এই লাইভ ভিডিওতে ওসিকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতেও শোনা যায়। এ ঘটনায় ওসি বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার রাতে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। গতবছরও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক লাইভে এসে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া পৌরসভার তৎকালীন মেয়র অধ্যক্ষ সিপার উদ্দিন আহমদকে হত্যার হুমকি দেয় এক যুবক। এ ঘটনায় ওই বছরের ১৯ মে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন সিপার উদ্দিন।
কেবল মারধর বা হত্যার হুমকিই নয়, ফেসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটতে দেখা গেছে। মডেল ও অভিনেত্রী তানজিম তাসনিয়ার আত্মহত্যার ঘটনার সেটি বড় করে সামনে আসে। রাজধানীর ধানমন্ডি ৯ এর ১ নম্বর রোডের একটি বাড়ির দ্বিতীয় তলার ফ্ল্যাট থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তিনি ফেসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।
বর্তমানে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ কোটির বেশি। অন্য অনেক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থাকলেও ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারীর সংখ্যাই বেশি। ফেসবুকে সাধারণত পড়ালেখা, বেচাকেনা, দাফতরিক সভা, অনলাইনভিত্তিক চিকিৎসা, বিভিন্ন আন্দোলনের প্রচার-প্রচারণা, চাকরির খবর, গবেষণা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির অনুশীলন ও বিনিময় করতে দেখা যায়। এতে নতুন যোগ হয়েছে অপরাধ প্রকাশের প্রবণতা। বিশ্লেষকরা বলছেন, ভাইরাল হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে এধরনের আচরণ করে থাকে। ক্ষমতা প্রদর্শন ও বিচারের মুখোমুখি হওয়ার ভীতি না থাকার কারণে অহরহই এসব ঘটাতে পারছেন বলেও মনে করেন তারা।
‘আত্মহত্যা প্রবণতা ও কারণ’ নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছে আঁচল ফাউন্ডেশন। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান তানসেন রোজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ২০২২ সালে ফেসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যার একটি ঘটনা ব্যাপকভাবে গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার পরে এক মাসে ৭-৮টা এরকম ঘটনা আমরা পেয়েছিলাম। ব্যক্তি যখন পরিবার বা সম্পর্কের বিষয়ে হতাশার মধ্যে থাকে তখন তার মধ্যে একধরনের হিরোইজম কাজ করে, এবং যার জন্য তার ভোগান্তি তাকে ‘দেখিয়ে দেওয়ার’ প্রবণতা থাকে।
তিনি বলেন, ‘‘সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে যে ঘটনাটি দেখা গেছে, ব্যক্তি-সম্পর্কের জেরে সে লাইভে এসে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। এধরনের ঘটনাগুলোকে কাউকে না কাউকে ‘শিক্ষা দেওয়া’, ‘অন্যের মধ্যে তার কষ্টটাকে প্রবাহিত করা’র মতো বিষয়গুলো কাজ করে বলে আমার মনে হয়।’’
কোনও জায়গা থেকে অপরাধ প্রকাশ করতে ফেসবুক লাইভ ব্যবহার করে জানতে চাইলে মনোরোগ বিশ্লেষক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘অ্যাটেনশন সিকিং বিহেভিয়ারের কারণে অপরাধীরা যখন অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায় তখন তারা এধরনের আচরণ করে। যে লাইভে এসে পেটানোর কাজটি করছে বা যে হুমকি-ধামকির ভিডিও ধারণ করতে সহায়তা করছে, তারা নিজেদের অপরাধী মনে করে না। এবং তাদের আচরণকে যৌক্তিক মনে করে। অন্যের কাছে হিরো সাজার চেষ্টা থেকে এরকম করে থাকতে পারে। আবার যারা হুমকি দিচ্ছে, তারা অনেক মানুষের মধ্যে ক্ষমতা জাহির করার জন্যও এমনটা করে থাকে। এটাকে আমরা ম্যালড্যাপটিভ কৌশল বলে থাকি, এটা ভালো কৌশল না কিন্তু অপরাধীরা এটা গ্রহণ করে।
সাইবার বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা মনে করেন, অপরাধী তার অপরাধের ভিডিও আপলোড করে সবাইকে একটা বার্তা দিতে চায়। সে যে কত ক্ষমতাবান, সেটা দেখানোর পাশাপাশি অন্য অনেককে সে কী করতে পারে; সেটাও বুঝিয়ে দিতে চায়।
তিনি বলেন, ‘আত্মহত্যা যারা করে তাদের ক্ষেত্রে একরকম মানসিকতা কাজ করে, যারা লাইভে মারধর দেখায়, তাদের প্রেক্ষাপট আরেকরকম। আমাদের মনস্তাত্ত্বিক ডিজিটাল বেইজ হয়ে গেছে। পার্থিব জগৎ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে এমন বিস্তৃত হয়েছে, যে সবাই মনে করে— এটাই পৃথিবী। ফলে নৃশংস হত্যাযজ্ঞটাও সে মুঠোফোনে ভাইরাল করতে চায় একধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে।’