ব্রাজিল ফুটবল দলের কোচ তিতে একটা সাক্ষাৎকার দিয়েছেন গার্ডিয়ান পত্রিকায় (১৯ জুন ২০২২)। তিতেকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, আপনি কি কোনো কিছুকে ভয় পাচ্ছেন?
ব্রাজিলের কোচ বলেছেন, প্রত্যাশার চাপ একটা বিশাল সমস্যা। তবে ভয়ের বেলায় আমি নেলসন ম্যান্ডেলার কথাটা মনে রাখি, ‘সাহস হলো ভয়ের মুখোমুখি হওয়ার সক্ষমতা।’ তিতে বলেছেন, ‘নেলসন ম্যান্ডেলা যে সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন, তার সঙ্গে ছিল
ভয়। যখন আমি তাঁর এই বিষয়টা পাঠ করি, তারপর থেকে আমি দেখি যে আমি একজন সাধারণ মানুষ, আমার ভয় আছে, দুঃস্বপ্ন আছে, গায়ে কাঁটা দেয়। ভয় আছে, কিন্তু শঙ্কা নেই। মানে আগে থেকে ভীত হয়ে থাকি না।’
ফুটবল প্রসঙ্গে আরেকটা কথা আজকে পয়লা জুলাই প্রসঙ্গ ক্রমেই মনে আসবে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বড় ভক্ত ছিলেন ফারাজ আইয়াজ হোসেন। ১ জুলাই ২০১৬ হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় ২০ বছর বয়সী ফারাজকে আমরা হারাই। শুধু ফারাজ নন, অবিন্তা কবির, তারুশি জৈনসহ বিদেশি অনেক অতিথি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এবং বেকারির কর্মীদের আমরা সেদিন হারিয়েছিলাম। তাঁদের কারও আত্মত্যাগের মূল্য কারও চেয়ে কম বা বেশি নয়।
ফারাজের হাসিমুখটা সব সময় মনে পড়ে। মৃত্যুর মাত্র অল্প কিছুদিন আগে প্রথম আলোর মিলাদ মাহফিল ছিল পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে। ফারাজ সে উপলক্ষে সিএ ভবনে এসেছিলেন। ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও এমডি লতিফুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিনয়, ভদ্রতা, সৌজন্য আমরা মুগ্ধতার সঙ্গে স্মরণ করি, তা থেকে শিক্ষাও নেওয়ার চেষ্টা করি। প্রথম আলোর কোনো চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীও লতিফুর রহমান সাহেবকে আগে সালাম দিতে পারেননি, তিনিই আগে সালাম দিতেন। ফারাজ কিংবা তাঁর ভাই যারেফও একই রকমের।
এবং ফারাজ সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। চূড়ান্ত সাহসিকতা। হোলি আর্টিজানের সেই ভয়াল রাতে সশস্ত্র জঙ্গিরা ফারাজকে চলে যেতে বলেছিল। ফারাজ তাঁর বন্ধুদের ছেড়ে, বিদেশি অতিথিদের ফেলে নিজের প্রাণ বাঁচানোর সুযোগ নিতে চাননি। তিনি বন্ধুদের সঙ্গে সেখানে রয়ে গিয়ে মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়াকে শ্রেয় বলে বেছে নিয়েছিলেন। ২০১৬ সালের সেই দিনটার পরে ফারাজের নানা লতিফুর রহমান সাহেব আমাদের বলেছিলেন, ‘আমি প্রায়ই ভাবি, মাত্র ২০ বছর বয়সী ফারাজ ওই কঠিন মুহূর্তে যে সাহসী সিদ্ধান্ত এবং উচ্চায়ত মূল্যবোধের পরিচয় দিয়েছিল, আমরা কি তা একই রকম পরিস্থিতিতে পড়লে নিতে পারতাম?’
এখানে এসে নেলসন ম্যান্ডেলার সেই সাহস ও ভয়ের প্রসঙ্গটা আসে। নেলসন ম্যান্ডেলার জীবনী লেখক রিচার্ড স্টেঙ্গেল ম্যান্ডেলার সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটানোর অভিজ্ঞতা থেকে আহৃত শিক্ষা বা লেসনগুলোর সমন্বয়ে আরেকটা বই লিখেছেন—নেলসন ম্যান্ডেলা: পোর্ট্রেট অব অ্যান এক্সট্রা অর্ডিনারি ম্যান। সেই বইয়ের এক নম্বর লেসন বা শিক্ষা হলো ‘কারেজ ইজ নট দ্য অ্যাবসেন্স অব ফিয়ার।’ সাহস মানে ভয়হীনতা নয়। স্টেঙ্গেল লিখেছেন, ‘তিনি আমাকে শিখিয়েছেন: সাহস মানে ভয়ের অনুপস্থিতি নয়। সাহস হলো ভয়কে জয় করতে শেখা।’
ম্যান্ডেলার জীবন থেকে উদাহরণ দিয়েছেন স্টেঙ্গেল। ১৯৯৪ সালে একবার ম্যান্ডেলা তাঁর দেহরক্ষী মাইকের সঙ্গে বিমানে নাটাল যাচ্ছেন। পথে ম্যান্ডেলা বললেন মাইককে, বিমানের প্রপেলার ঠিকভাবে কাজ করছে না। মাইক পাইলটকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন, ঘটনা সত্য। ঘটনা জেনে ম্যান্ডেলা পত্রিকা পড়ায় মন দিলেন। কোনো ভাবলেশ নেই। বিমানবন্দর ফায়ার সার্ভিস–অ্যাম্বুলেন্সে ভরে গেল। ২০ মিনিট পর বিমান সামান্য ঝাঁকুনিসহ ঠিকভাবে নিরাপদে অবতরণ করল।
স্টেঙ্গেল বিমানবন্দরে ছিলেন। তিনি মাইককে জিজ্ঞেস করলেন, ঘটনা কী। মাইক বললেন, ‘আমি ভয়ে থরথর করে কাঁপছিলাম। কিন্তু যখনই ম্যান্ডেলাকে দেখলাম, তিনি শান্ত মুখে পত্রিকা পড়ছেন, তাঁর মুখ দেখে আমি খানিকটা সাহস পেলাম।’ ম্যান্ডেলা বিমান থেকে নেমে উপস্থিত মানুষের সঙ্গে হাসিমুখে করমর্দন করতে লাগলেন। তারপর স্টেঙ্গেল যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, বিমানে কী হয়েছিল, তখন ম্যান্ডেলা বললেন, ‘ওহ্, আমি খুবই ভয় পেয়েছিলাম।’
ফারাজের সাহস, উচ্চ মূল্যবোধ, হোস্ট বা মেজবান হিসেবে এ দেশের মহান ঐতিহ্যের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরার ঘটনা আমাদের মাথা উঁচু করেছে। দেশে-বিদেশে ফারাজের কারণে আমাদের সম্মান বেড়েছে।
আমরা লতিফুর রহমান সাহেবকে হারিয়েছি ২০২০ সালের ১ জুলাই। জীবনের শেষ দিনগুলো তিনি কাটিয়েছেন কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের পৈতৃক বাড়িতে। বাণিজ্যের নোবেল পুরস্কার বলে খ্যাত অসলো বিজনেস ফর পিস অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে লতিফুর রহমান সাহেব দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছিলেন। কিন্তু তা না পেলেও আমরা জানতাম, উদ্যোক্তা হিসেবে, বিজনেস লিডার হিসেবে তিনি সততা, দূরদর্শিতা, দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। তাঁর পরিবারের ওপর দিয়ে অনেক ঝঞ্ঝা গেছে, কিন্তু সবারই পাসপোর্ট বাংলাদেশি।
নেলসন ম্যান্ডেলার ওই উক্তিটার কথায় আবারও আসি। একবার একটা ঘটনা ঘটল, প্রথম আলো পত্রিকায় অনেকগুলো বেসরকারি সংস্থা থেকে বিজ্ঞাপন আসা বন্ধ করা হলো। নেলসন ম্যান্ডেলার মতোই লতিফুর রহমান সাহেব ছিলেন নির্বিকার। তিনি বলেছিলেন, ‘অনেক বছর পত্রিকার আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল, কয়েক বছর না হয় খারাপ যাবে, এতে বিচলিত হওয়ার কী আছে?’ আমরা জানি, প্রথম আলোর স্বাধীনচেতা অবস্থান শুধু প্রথম আলোর জন্যই নানা রকমের প্রতিবন্ধকতা ডেকে আনেনি, লতিফুর রহমান সাহেবকেও নানা রকমের চাপ মোকাবিলা করতে হয়েছে। কিন্তু তা কোনো দিনও তাঁর মুখের হাসি সরাতে পারেনি, তিনি কোনো দিনও বলেননি, আপনারা কাগজটায় একটু কৌশলী হোন।
ফারাজ ছিলেন লতিফুর রহমানের সবচেয়ে প্রিয় নাতি, প্রায় সার্বক্ষণিক সঙ্গী। ফারাজকে হারিয়েও তিনি ভেতরে-ভেতরে ভেঙে পড়েন। তা সত্ত্বেও তিনি ম্যান্ডেলার মতোই, ভয়কে জয় করার ব্রত নিয়েছিলেন। সাহসিকতা, মূল্যবোধ ও আদর্শবাদিতার উজ্জ্বল দুই উদাহরণ, দুই প্রজন্মের প্রতিনিধি, ফারাজ আইয়াজ হোসেন ও লতিফুর রহমান—দুজনের মৃত্যুবার্ষিকী একই দিনে। আজ দুজনকেই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।
● আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক
উৎসঃ প্রথম আলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন