বাংলাদেশের কয়েকজন পরিবেশ সাংবাদিক সরকারের সহযোগিতায় এবং আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার অর্থায়নে বায়ুদূষণের মাত্রা নির্ণয়ের জন্য গিয়েছিলাম উপমহাদেশের একাধিক নগরে। তখন এসব নগরীর দশা অন্তত ঢাকার চেয়ে উন্নত ছিল। সে কারণে কোনো কোনো সাংবাদিক বলতেন, ‘আমরা ঢাকায় যেন গ্যাসচেম্বারে বাস করছি। সেখানে ফিরতে ইচ্ছে করছে না।’ এর মানে আমরা এ দেশে বিষম অসুখে আছি। সুখের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। ঢাকা এখন বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক বায়ুদূষিত শহর। তার মানে, আমরা এ দিক দিয়ে তেহরান, দিল্লি, বেইজিং, লাহোরকে ‘হারিয়ে দিয়েছি’। অতএব, সবাই সহজেই বুঝতে পারছেন, বাংলাদেশের মানুষ কত সুখে।
এ দেশের রাজধানী ঢাকার চেয়ে বেশি অ-বাসযোগ্য নগরী হলো সিরিয়ার দামেস্ক ও আফগানিস্তানের কাবুল- দুটোই যুদ্ধবিধ্বস্ত। তার মধ্যে সিরিয়ায় বলতে গেলে টানা প্রায় এক যুগ যুদ্ধ চলছে। আফগান রাষ্ট্রে মাত্র কয়েক মাস আগে আপাতত যুদ্ধ থামলেও কখন আবার শুরু হয়ে যায়, ঠিক নেই। কিন্তু বাংলাদেশে তো বিগত ৫০ বছর কোনো যুদ্ধ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের ক্ষতি মুজিব আমলেই আমরা কাটিয়ে উঠেছি। তা হলে ঢাকার কোটি কোটি মানুষ এখনো কেন সুখের বদলে নিছক অবাসযোগ্য নগরে বসবাস করতে বাধ্য হয়?
সুখ অবিচ্ছিন্ন নয়; আবার এটা আপেক্ষিক দৃষ্টিকোণের বিষয়। সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ‘সুখ’ পরিমাপ করতে পারেন, জনগণ সুখী কতটুকু সেটিই বিবেচ্য। বাজারে গেলেই বোঝা যায়। আবার সুখ-দুঃখ দুটোই বাস্তবতা। উভয়কেই মেনে নিতে হবে এ দুনিয়ায়। কারণ কবির ভাষায় ‘চির সুখী জন ভ্রমে কি কখন ব্যথিত বেদন বুঝিতে পারে? তবুও মানুষ ‘সুখের লাগিয়া’ ঘর বাঁধে, যদিও অনেকের হায়হতাশা, তা ‘অনলে পুড়িয়া গেল’ বলে। তবে মনের সন্তুষ্টিই আসল সুখ। এ জন্য হাদিছে বলা হয়েছে, আল গেনা গেনান নাফস- মানে, মনে যে ধনী, সেই আসল ধনী।
প্রসঙ্গক্রমে বলখের বাদশাহ ইব্রাহিমের ঘটনা বলা যায়। তিনি খুব সুখী মানুষরূপে রাতে শয্যাশায়ী। তখন ছাদে কিছু একটা হাঁটছে টের পেয়ে বললেন, ‘কে ওখানে এত রাতে?’ জবাব এলো ‘আপনি কী করছেন?’ বাদশাহ বললেন, ‘বেয়াদব, আমি তোর জন্য ঘুমাতে পারছি না এত আরামের বিছানাতেও।’ ছাদ থেকে বলতে শোনা গেল, ‘আমি আল্লাহকে খুঁজছি। তুমি দুগ্ধ ফেন নিভ শয্যায় উনাকে পাবে না।’ বাদশাহ ভাবলেন, ‘সত্যিই, পাগল আমিই।’ প্রকৃত সুখী হতে তিনি সে দিনই দরবেশ হয়ে গেলেন। সুখ আরামের বিছানায় নয়, এটি তিনি বুঝেছিলেন।
‘সুখ’ একটি আপেক্ষিক বিষয় এবং এটি ব্যক্তির নিজস্ব দৃষ্টিকোণের ওপর নির্ভরশীল। তবুও যখন আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থা বা সংগঠন ‘সুখী’ দেশের মাপকাঠি নির্ধারণ করে দেয়, তখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে মানুষের মনে। বাংলাদেশ কতটা সুখে আছে, কিংবা অসুখী, তা বলে দিতে হয় না বাইরের কাউকে। আপনার চার পাশে বা দুই দিকে তাকালেই এটি অত্যন্ত সুস্পষ্ট হয়ে যায়, আমরা কেমন সুখে আছি। সাধারণ মানুষের একটা গান আছে, ‘আমরা সুহেই (সুখেই) আছি;/বাতাস খাইয়া পেট ফুলাইয়া/ড্যাংড্যাঙ্গাইয়া নাচি।’/গ্রাম দেশে একটা গল্প চালু আছে। তা হলো নানী-নাতি শীতের দিনে বিছানায় গায়ে ‘ওম’ লাগাচ্ছে। হতদরিদ্র আদরের নাতি আর তেমনি দরিদ্র ‘জানের নানু’। ছেড়া কাঁথা গায়ে দেয়া নাতির জিজ্ঞাসা, ‘আচ্ছা নানু, এখন বড়লোকরা কী করছে?’ গরিব ভিখারিণী নানুর তৎক্ষণাৎ জওয়াব, ‘কেন, মোটা কাঁথার তলে ঘুমাচ্ছে?’ আরেক দিন বর্ষার সময়ে নাতি তার নানীকে জিজ্ঞাসা করল, ‘নানু, এই সময়ে ধনীরা কী করে?’ নানী সবজান্তার ভঙ্গিতে বললেন, ‘তারা খাঁড় (গুড়) খাচ্ছে।’ নাতি ভাবল, কী আরামেই না ওদের দিনগুলো কাটে। অর্থাৎ এই গরিবদের সুখের ধারণা এমন-ই। মোটা কাঁথা আর মিষ্টি গুড়ই তাদের সীমানা। এর বেশি তারা ভাববে কী করে? তাদের অভিজ্ঞতা ও ধারণা নেই যে! এটাও সত্য, নিরবচ্ছিন্ন সুখ কিংবা চিরসুখী বলতে কিছু বা কেউ নেই।
একটি বহুল প্রচারিত পত্রিকার প্রথম উপসম্পাদকীয়তে শুরুতেই বলা হয়েছে, ‘সুখবর আছে অনেকগুলো। বাংলাদেশ শতভাগ বিদ্যুতের দেশ হয়ে গেছে, বিচ্ছিন্ন চরেও পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ। ওয়ালটনের মতো কোম্পানিগুলোর ফ্রিজ বিক্রি হচ্ছে প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জে। সুখী দেশের বিশ্ব তালিকায় বাংলাদেশ এগিয়েছে ৭ ভাগ, ১০১ থেকে এসেছে ৯৪-তে’ ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যা-ই বলুক না কেন, আমাদের সুখ-অসুখ কোনটা বড়, তা বোঝার জন্য প্রত্যেকে নিজের দু’পাশে তাকালেই হয়। কথায় আছে, ‘সুখে থাকলে মানুষকে ভ‚তে কিলায়।’ আমাদেরকে ভ‚তে, না কিছু চিহ্নিত মানুষে কিলিয়েছে অকারণে, তা সবার জানা। সে জন্যই আজো অসুখের প্রাধান্য এ দেশে। সুখ নেই; কারণ শান্তি নেই দেশে।
সম্ভবত সার্কভুক্ত, দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে কেবল ভুটানেই জিডিপি বা ‘মোট অভ্যন্তরীণ’ উৎপাদনের বদলে সামগ্রিক সুখের সূচক রয়েছে। বোধহয়, পৃথিবীর কোনো দেশেই এমনটি নেই। ভুটান দেশটি ছোট। হিমালয়দুহিতা, প্রকৃতির সৌন্দর্যে ভরপুর এবং নানাবিধ ফলমূলে সমৃদ্ধ। তবুও দরিদ্র রাষ্ট্র যার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিংয়ের মতো অনেকেই বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন বা করছেন। দরিদ্র ভুটানে বোধহয়, এখনো নিজস্ব টিভি নেই এবং ‘কুয়েন্টসেল’ ছাড়া ইংরেজি পত্রিকা নেই। সে দেশের মানুষ কি অসুখী? কারণ সুখের মাপকাঠি তাদের নিজস্ব। তারা নিজেদেরকে সুখী ভাবলে কার কী বলার থাকতে পারে? তারা অনুন্নত হলেও অসুখী ভাবেন না নিজেদেরকে।
আমাদের এ দেশ ‘সুখী’। তবে এর পরই পত্রিকার খবর, বিশ্বে বায়ুদূষণে আমাদের ঢাকা নগরী বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। দুর্নীতিতে তো আমরা ওপরের দিকে আছিই। ঢাকা আগে ছিল মসজিদের ঐতিহাসিক শহর; আর বর্তমানে বিশ্বের সেরা অ-বাসযোগ্য নগর। তা হলে এ জাতি কোন ধরনের সুখী?
সুখ কেবল কাগজ কলমের ব্যাপার নয়; মানুষের অনুভ‚তি ও উপলব্ধির বিষয়। শান্তি ছাড়া সুখ হতে পারে না। বাংলাদেশ কেমন শান্তির দেশ, তা উন্নয়নের জোয়ার আর মেগা প্রকল্পের মহোৎসবও ঢাকেনি। এক দিকে উন্নয়ন চলছে। আরেক দিকে খুন খারাবি। এক দিকে সরকার টাকা ঢালছে উন্নয়নের জন্য; অন্য দিকে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অপরাধ, সন্ত্রাস আর দুর্নীতি। এর দায় বিশেষ কোনো ব্যক্তি বা দলের নয়; সবার। সমাজের সবাই এক হয়ে এগিয়ে আসতে হবে জনগণের সত্যিকারের সুখ শান্তি নিশ্চিত করার জন্য। না হয় এত বরাদ্দ, এত অবকাঠামো, এত পাবলিসিটি-সবই পানিতে যাবে। তা কি হতে পারে?
সরকারের দায়-দায়িত্ব সর্বাধিক। তবে সরকার তো একা কিছু করতে পারে না। আন্ না-সু আলা মুলুকিহিম। মানে, মানুষকে রাষ্ট্র প্রভাবিত করে। এটা যেমন সত্য তেমনি এটাও সত্য যে, মানুষ যেমন, সরকারও তেমনি হয়ে থাকে। তাই জনগণের সুখ শুধু কর্তৃপক্ষ বা প্রশাসন আনতে পারে না। সবাই মিলে তা করতে হয়। সে চেষ্টাই করা জরুরি।
উৎসঃ নয়া দিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন