আফগানিস্তান ও তালেবান
19 December 2021, Sunday
আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় রয়েছে বিগত আগস্ট মাস থেকে। কিন্তু দীর্ঘ সময়েও তারা বিদেশের স্বীকৃতি, সমর্থন কিংবা সাহায্য পায়নি। এমন প্রেক্ষাপটে গতকাল রোববার ওআইসির সংশ্লিষ্ট বিশেষ সম্মেলন পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে শুরু হওয়ার কথা আফগানিস্তানকে সাহায্য করার জন্য। এটা বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোর আন্তর্জাতিক ফোরাম অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশনের সপ্তদশ বিশেষ সম্মেলন। এতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ অনেক অমুসলিম অধ্যুষিত দেশও যোগ দিচ্ছে। আর খোদ আফগান তালেবানের প্রতিনিধি তো আছেনই। শনিবারের আগেই শ’খানেক বিদেশী মেহমান এতে যোগ দিতে ইসলামাবাদ পৌঁছে যান এবং আরো আসছেন বলে জানা যায়। যা হোক, এ সম্মেলনের আগেই আফগান জনগণের জন্য সাহায্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কথা হলো, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তবুও এত বিলম্বে কেন? কথায় আছে, ‘সে-ই তো মল খসালি/তবে কেন লোক হাসালি?’ আফগানিস্তানে সাহায্য যখন দেয়াই হবে, তা যেন যথাসময়ে দেয়া হয়। না হলে, অসময়ের দশ ফোঁড়েও কাজ হয় না’ যা সময়ের মাত্র এক ফোঁড়েই সারা যায়। ‘চোর পালিয়ে যাওয়ার পর বুদ্ধি বেড়ে গেলে’ তাতে গৃহস্থের কোনো লাভ নেই।
গত মাসে সৌদি আরবে ওআইসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এবারকার সম্মেলনের কথা জানিয়েছিল। এরপর পাকিস্তান উদ্যোগটিকে স্বাগত জানিয়ে তার রাজধানীতে এটা করতে রাজি হয়। পাক পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশির কথা হলো, এর উদ্দেশ্য হচ্ছে আফগান রাষ্ট্রে বিরাজমান মানবিক সঙ্কটের প্রতি দুনিয়ার সবার দৃষ্টি আকর্ষণ।’ অর্থাৎ তারা স্বীকার করে নিলেন, তালেবানের ভয়ে বা লজ্জায় সে দেশে সম্প্রতি কোনো আর্থিক সাহায্য বা ত্রাণ সহায়তা না দিয়ে অমানবিক কাজ করা হয়েছে মাসকে মাস। ইসলামাবাদের এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন উপলক্ষে সংশ্লিষ্টদের কেউ বলেছেন, ‘স্থিতিশীলতার স্বার্থেই এমন সম্মেলন আয়োজন করা উচিত।’ কেউবা বলেন, ‘শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আফগানিস্তানে নানাভাবে সাহায্য করা দরকার।’ অর্থাৎ, ওআইসির মতো বড় সংগঠন এত বিলম্বে এ সম্মেলনে মিলিত না হয়ে আফগানিস্তানে তালেবান ঠেকাতে পারেনি। বরং সে দেশে শান্তি-স্থিতির পরিপন্থী কাজ করেছে। এটা অন্তত এমন কোনো সংস্থার করা উচিত নয় যার নাম ‘ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা’। তাদের কাজ অশান্তি-অস্থিতিশীলতায় সহযোগিতা প্রদান করা নয়। বরঞ্চ এর উল্টোটাই তাদের কর্তব্য।
তালেবান ‘মন্দ’ বলে ধরে নিলেও নিজেরা তো তাদের চেয়ে উত্তম হতে হবে। এ উপলব্ধি সংশ্লিষ্ট সবার থাকা উচিত। এ যাবৎ ‘যদি ও কিন্তু’র ওপর তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, যা হাস্যকর ও অযৌক্তিক। কারণ কে আগামী দিনে কেমন হবে, তা আগে থেকে বলা যায় না। আমেরিকা যে সাম্রাজ্যবাদী দেশ হয়ে উঠবে, তা কি আব্রাহাম লিংকন ধারণা করেছিলেন? কেননা, এ দেশের প্রতিষ্ঠাই হয়েছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়ে। একই শ্বেতাঙ্গ ও পূর্বপুরুষের জাতি হলেও তারা যে অত্যাচার চালিয়েছে, আমেরিকায় সেটি বেনজির। তাই আমেরিকার মুক্তির বিকল্প ছিল না। অথচ আফগানিস্তানে এই আমেরিকাই চিত্রিত হয়েছে ‘দখলদার’ হিসেবে। বাস্তবতা এটাই। সে জন্যই তালেবানের ক্ষমতারোহণ এবং জনগণের তাতে প্রায় সবার সম্মতি। অথচ সে দেশে কোনো নির্বাচনও হয়নি।
তালেবানের cheracter certificate অবশেষে দিলেন খোদ হামিদ কারজাই যিনি নিজে আফগানিস্তানের পাশ্চাত্যপন্থী প্রেসিডেন্ট থাকাকালে তাদের হত্যার টার্গেট ছিলেন। তিনি এবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আসলে তালেবান কাবুলের ক্ষমতা দখল করেনি। তাদের আসতে হয়েছে আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি সদলবলে পালিয়ে যাওয়ায়। অন্যথায়, লুটপাট-বিশৃঙ্খলা দেখা দিত। আমাকে তালেবানরা কাবুল না ঢোকার কথা জানায়। কিন্তু পরিস্থিতি তাদের এ পথে ঠেলে দিয়েছে। আমিই তাদের আমন্ত্রণ জানাই কাবুলে আসতে।’ অবশ্য কারজাইয়ের এ কথাটা আরো অনেক আগে জানানোর দরকার ছিল। তিনি নারী অধিকার প্রসঙ্গে তালেবানের সমালোচনার নিন্দা জানিয়েছেন।
বসনিয়ার একজন অ্যাকাডেমিশিয়ান অভিযোগ করেছেন, ‘মূলত পাশ্চাত্যই সে দেশে জঙ্গিবাদের বিস্তারের জন্য দায়ী। তারাই উসকানিমূলক আচরণ করে উদার সমাজগুলোকে উগ্র বানিয়ে দিচ্ছে।’ তিনি এ বিষয়ে দীর্ঘ নিবন্ধ রচনা করেছেন এবং বলেছেন, যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তখন পাল্টা প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক যদিও তা সর্বদা সমাধান নয়। তেমনি আফগানিস্তানকেও উগ্রবাদের উর্বর ক্ষেত্র বানিয়েছে একই পাশ্চাত্য। তদুপরি, সে দেশে তালেবানের অজুহাতে বাইরের সাহায্য বন্ধ করে দেয়ায় যুদ্ধের চেয়ে বেশি মানুষ প্রাণ দিচ্ছে। এ জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ত্বরিত পদক্ষেপ জরুরি। সে দেশে সরকারি-বেসরকারি নির্বিশেষে সবার ত্রাণ অপরিহার্য।’
এ প্রসঙ্গে কয়েকজন আন্তর্জাতিক সাহায্য সংগঠক বলেছেন, ‘আফগান ব্যাংক-সমেত পুরো অর্থনীতি ধসে পড়ার উপক্রম। কিন্তু বিশ্বের ব্যাংকিং সিস্টেম আফগানিস্তানে সরাসরি কাজ করতে পারছে না এর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে। তাই যুক্তরাষ্ট্রসহ জাতিসঙ্ঘের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হবে। তাহলে ইউরোপের সহযোগিতাও সহজ হবে। তখন আফগান ব্যাংকগুলো আর আন্তর্জাতিক অর্থব্যবস্থা হতে বিচ্ছিন্ন থাকতে বাধ্য হবে না। তা না হলে তারা বাইরের অর্থ নিতে পারবে না।’
জানা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সীমিতভাবে অর্থ ছাড় দিয়েছে। সৌদি আরব তা করেছে’ তাদের অনেক পরে। আফগানিস্তানের সরকারি কর্মচারীরা অনিশ্চিত অবস্থায়। বলা হয়েছে, মার্কিন অর্থ বিভাগ জাতিসঙ্ঘ এবং কিছু এনজিওকে আফগান দেশে সুনির্দিষ্ট মানবিক তৎপরতা চালাতে লাইসেন্স দিয়েছে। অপর দিকে আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলো আফগান সরকারের সাথে লেনদেনের বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক অর্থাৎ বিরত থাকতে চায়।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন