রাষ্ট্র চালনায় ভারসাম্য
21 August 2024, Wednesday
রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতিকে অনেক সময় এক করে ফেলা হয়। রাজনীতি করা সহজ কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন তত সহজ নয়। এ কারণে কোনো দল যখন ক্ষমতায় যায় সেটি নির্বাচন, গণ-অভ্যুত্থান বা অন্য কোনো উপায়েই হোক, এমন অনেক ব্যক্তি স্থান পান যাদের দৃশ্যত রাজনীতিতে বা ক্ষমতায় যাওয়ার ক্ষেত্রে অবদান তেমন উল্লেখযোগ্য নয় বলে মনে হয়। এটি এ কারণে হয় যে, রাজনীতি যতটা জটিল তার চেয়ে অনেক বেশি জটিল রাষ্ট্রনীতি।
রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রভাবশালী কিছু উপাদান থাকে, যেটিকে আমরা স্টেকহোল্ডার-সংশ্লিষ্টতা বলতে পারি। এসব উপাদানের কিছু দেখা যায়, আর কিছু দৃষ্টির আড়ালে থেকে যায়। এ ধরনের সব উপাদানের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে হয় মসৃণভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য।
এ বিষয়টির গভীরে যারা নজর রাখেন না তারা এই প্রশ্নের জবাব পান না যে, জিয়াউর রহমান যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় বসেন তখন যারা তাকে ক্ষমতায় আনেন তাদের অনেকে কেন দৃশ্যপটের অন্তরালে থেকে যান। অন্য দিকে মন্ত্রী বা উপদেষ্টা হিসেবে এমন অনেককে দেখা যায়, জিয়ার ক্ষমতায় আসার ক্ষেত্রে যাদের কোনো ভূমিকা ছিল না। একই ঘটনা আমরা এরশাদের সময়েও দেখতে পাই। এমনকি আন্দোলনের মুখে স্বৈরাচারের পতনের পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়া জয়ী হওয়ার পর যখন ক্ষমতায় বসেন তখন এমন অনেকে মন্ত্রিসভায় স্থান পান যারা কেন মন্ত্রী হলেন তা বুঝে উঠতে পারেননি অনেক নেতাকর্মীও। শেখ হাসিনার তিন সরকারের ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটে।
এটি এ কারণে হয় যে, রাজনীতিবিদদের ক্ষমতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য বাহন হিসেবে কাজ করে রাজনৈতিক দল বা রাজনীতি, কিন্তু রাষ্ট্রের এমন অনেক উপাদান রয়েছে যেগুলো সরাসরি রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে না। রাষ্ট্র পরিচালনায় ডিপ স্টেট বা গভীর ক্ষমতা বলয় বলে একটি ধারণা রয়েছে। এ টিকে স্টেকহোল্ডার ধারণা হিসেবে অনেক সময় উল্লেখ করা হয়। এই ডিপ স্টেটে কারা আছেন বা থাকেন সেটি একেবারে সংজ্ঞায়িত থাকে না। সব দেশে গভীর ক্ষমতা বলয়ে সব প্রতিষ্ঠানের সমান ভূমিকাও থাকে না। যেমন- মালয়েশিয়ায় গভীর ক্ষমতাবলয়ের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান হলো রাজ্য সুলতানরা। তারা পাঁচ বছরের জন্য রাজা নির্বাচন করেন। আর রাজা সশস্ত্রবাহিনীর প্রধান নিয়ন্ত্রক। রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা, থাকা বা বিদায়ের ক্ষেত্রে সুলতানদের অনেক বড় ভূমিকা থাকে। তারা পরোক্ষভাবে জনমত প্রভাবিত করতে পারেন, রাজনৈতিক মেরুকরণে ভূমিকা রাখতে পারেন আবার সরকার গঠন বা ভাঙনেও কলকাঠি নাড়তে পারেন। সামরিক বাহিনী, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা, শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায় আর মালয় সমাজপতিরা দেশটির ডিপ স্টেটের গুরুত্বপূর্র্ণ অংশ।
এসব বিষয় সাধারণত রাষ্ট্রের কোনো লিখিত আইন বা সংবিধানে বিধৃত থাকে না। কিন্তু যারা ক্ষমতার রাজনীতি করেন তারা বিষয়টি ভালোভাবেই অনুভব করেন। মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্র শাসিত দেশ বা গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতার পরিবর্তনের দেশগুলোতে গভীর ক্ষমতাবলয়ের গঠন কিছুটা ভিন্ন হয়। তবে সব দেশেই গভীর ক্ষমতাবলয়ের কাঠামোর মধ্যকার সমন্বয় রাষ্ট্রের স্থিতির জন্য দরকারি বিষয়।
বাংলাদেশে রক্তক্ষয়ী গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে (আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের মতে ৩৬ জুলাই) অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই গণ-অভ্যুত্থানের কিছু দৃশ্যমান চিত্র রয়েছে, কিছু রয়েছে অদৃশ্য। দৃশ্যত কোটা পুনর্বহালের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ আন্দোলন করেছে, এ জন্য তারা একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে সারা দেশে। দেশব্যাপী সমন্বয়করা এই কাঠামোর লিংকম্যান হিসেবে কাজ করেছেন। এটি প্রথমে ছিল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। এই আন্দোলন দমনে ব্যাপক রক্তক্ষয়ের ফলে সেটি আর কোটা সংস্কার দাবির মধ্যে সীমিত থাকেনি, হয়ে গেছে দ্বিতীয় স্বাধীনতার আন্দোলন। যার ভেতরে রাষ্ট্র-সংস্কার, কথা বলার স্বাধীনতা, দেশের সিদ্ধান্ত দেশের ভেতরে নেয়ার স্বাধীনতার মতো বিষয়ও চলে আসে।
একপর্যায়ে বিভিন্ন শ্রেণিপেশা নির্বিশেষে অভূতপূর্ব ছাত্রগণজাগরণ তৈরি হয়। যার সামনে ১৪৪ ধারা, কারফিউ, দেখামাত্র গুলি বা নির্বিচারে ব্রাশফায়ারও ঢাল হয়ে উঠতে পারেনি। ‘পেছনে পুলিশ সামনে স্বাধীনতার’ মতো অপ্রতিরোধ্য অবিস্মরণীয় বয়ান তৈরি করে ছাত্রছাত্রীরা।
দৃশ্যমান এ চিত্রের অন্তরালেও আরেকটি দৃশ্য ছিল। ‘৩৬ জুলাইয়ে’ আন্দোলনকারীদের বিজয় অনেক বেশি ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে এসেছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার মতে, সহ¯্রাধিক প্রাণহানি হয়েছে এতে। এর বাইরে আরো ১১ হাজার নিখোঁজ থাকার কথা বলা হচ্ছে। গুলিবিদ্ধ বা গুরুতর আহতের সংখ্যা এর দ্বিগুণেরও বেশি। তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত হতাহতের সংখ্যা নিরূপণ করা হয়তো সম্ভব হবে।
এ পর্যায়ে হতাহতের সংখ্যা যাই হোক, শেষ সময়ে আরো ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়ে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে শেখ হাসিনার নির্দেশ সেনাবাহিনী মেনে নিলে প্রাণহানির সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারত। শাসনতান্ত্রিক সরকারের আনুগত্য না করার সাংবিধানিক শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়ার পরও সেনা নেতৃত্ব দেশের মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালাতে অস্বীকার করে। ঠিক এর আগে সাবেক সেনাপ্রধানসহ অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা রাওয়া ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে সাধারণ মানুষের ওপর গুলি করার আদেশ না মানার আহ্বান জানিয়েছিলেন। যারা ১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের শেষ সময়গুলো প্রত্যক্ষ করেছিলেন তারা জানেন, এ প্রতিষ্ঠানটি ক্ষমতায় থাকা না থাকাকে কতটা প্রভাবিত করতে পারে।
জাতীয় নিরাপত্তার এমন অনেক বিষয় সেনাপ্রতিষ্ঠান দেখেন, যা সাধারণ রাজনীতিবিদরা এমনকি সুশীলসমাজের অনেকে দেখতে পান না। এ কারণে রাষ্ট্রনীতি পরিচালনায় সব স্টেকহোল্ডারের সাথে সমন্বয়ের গুরুত্ব অনেক বেশি। এ বিষয়টি উপেক্ষিত হওয়ার কিছু উদ্বেগজনক খবর এই মুহূর্তে শোনা যাচ্ছে। যা এত ত্যাগ, এত রক্তক্ষয়ে অর্জিত দ্বিতীয়ত স্বাধীনতাকে বিপন্ন করাার আশঙ্কা সৃষ্টি করছে।
রাষ্ট্রে স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে নিরাপত্তাবাহিনী তথা পুলিশ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। এই বাহিনীকে পতিত কর্তৃত্ববাদী সরকার নির্বিচারে ব্যবহারের কারণে তাদের বিষয়ে জনমনে তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল, ফলে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে দেশের মানুষকে অনেক নির্মম অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা দেখতে হয়েছে। এসব ঘটনায় বাহিনীর নৈতিক সাহস বা মনোবল অনেকটাই ক্ষুণ্ন হয়েছে। এটি ফিরিয়ে এনে তাদের দায়িত্ব পালনের স্বাভাবিক ধারায় আনতে বেশ সফল হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিধানের মতো পেশাদার দক্ষ বাহিনী হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য পুলিশে বেশ কিছু সংস্কারের পদক্ষেপ নিতে হবে। এসব পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণের উপদেষ্টা পরিষদে একজন সাবেক আইজিপি বা পুলিশ কর্মকর্তা স্থান পেলে সেটি তাদের আস্থা ফেরাতে সহায়তা করতে পারে। প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রতিনিধিত্বশীল ও আস্থাভাজন ব্যক্তির উপদেষ্টা পরিষদে থাকার মতোই এর গুরুত্বও কম নয়। গণহত্যার ঘটনাগুলো তদন্ত করলে দেখা যাবে বাড়াবাড়ি ধরনের কাজের সাথে কিছু পদস্থ পুলিশ বা র্যাব কর্মকর্তা যুক্ত এবং দলীয় ক্যাডার থেকে নিয়োগ করা লোকজনই এসব ঘটনা বেশি ঘটিয়েছে। এ জন্য কেউ পুরো পুলিশ বাহিনীর ওপর দায় চাপাতে চাইলে সেটি হবে অজ্ঞতাপ্রসূত। আর তাতে আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব পালনে এই বাহিনীকে পুরোপুরি সক্রিয় করা কঠিন হবে।
পুলিশহীন দেশের কয়েক দিনে সেনাবাহিনীর সর্বাত্মক চেষ্টা সত্ত্বেও লুটপাট ও বিশৃঙ্খলাপূর্ণ পরিস্থিতি দেখা গেছে এবং কিছু ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটেছে। রাষ্ট্রের পরিচালকরা ধীরে ধীরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে পেরেছেন, কিন্তু তাদের পুরোপুরি সক্রিয় করার ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে না পারলে স্বাভাবিকতা ফেরানো কঠিন হতে পারে। দ্বিতীয় দফায় একজন স্বনামধন্য সাবেক সেনাব্যক্তিত্বকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। পুলিশের ক্ষেত্রেও একই বিষয় বিবেচনা করা উচিত। দরকার হলে এ জন্য প্রধান উপদেষ্টার একজন বিশেষ সহকারী নিয়োগ করা যেতে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রথম সপ্তাহে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। তবে আগের সরকার দেশকে যে অবস্থায় রেখে গেছে সে ক্ষেত্রে আরো কিছু পদক্ষেপ জরুরি। জাতীয় নিরাপত্তার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা ও জ্বালানি নিরাপত্তা বিধানের রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে একজন যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিকে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তিনি নিশ্চয় জরুরি বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন। এ ক্ষেত্রে কিছু বাস্তবতা সামনে রাখা প্রয়োজন।
আমার জানা মতে, দেশে এখন দুই সপ্তাহের জ্বালানি তেলের মজুদ রয়েছে। বিলম্বিত মূল্য পরিশোধে যে জ্বালানি তেল আমদানির ব্যবস্থা রয়েছে তার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় নতুন কোনো সমঝোতা না হলে নগদ অর্থে তেল আমদানি করতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের বর্তমান ভঙ্গুর অবস্থায় এটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হবে। এই অবস্থায় বাকিতে জ্বালানি তেল পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে জরুরিভাবে। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে। আইন সংশোধন করে আদানির ঝাড়খণ্ড গোড্ডা প্লান্ট থেকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারে বিদ্যুৎ বিক্রির ব্যবস্থা করার বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ। দেশের অভ্যন্তরীণ বিদ্যুৎ প্রকল্পের উৎপাদন ক্ষমতার ব্যবহার বাড়িয়ে এটি মোকাবেলা করা সম্ভব। গরমের মৌসুম হওয়ায় এ দিকে জরুরি দৃষ্টি দিতে হবে।
এই সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রধান উপদেষ্টা প্রবাসীদের কিছু সুবিধাদানের ঘোষণা এবং তাদের প্রতি দেশ গড়ার জন্য ব্যাংকিং চ্যানেলে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠানোর আহ্বান জানালে তাতে ভালো সাড়া পাওয়া যেতে পারে।
সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে আসায় চালসহ অনেক পণ্যের দাম কমছে। এ ব্যাপারে কৃষকদের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি এবং সার ও অন্যান্য কৃষি উপকরণের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে একটি অলিগার্ক শ্রেণী তৈরি করেছিল আগের সরকার। সে সরকার বিদায় নেয়ার ১০ দিনের মাথায় চিনির দাম কেজিপ্রতি ১০ টাকা কমেছে। প্রকৃত ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সামনে আনতে পারলে অর্থনীতিতে গতি ফেরানো সম্ভব হবে। একই সাথে কোনো ব্যাংক যাতে অচলাবস্থার মধ্যে না পড়ে তার জন্য জরুরি পদক্ষেপ নেয়া হলে তা অন্তর্বর্তী সময়ে ঝুঁকি মোকাবেলায় সহায়তা করতে পারে।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন