ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ান বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার পর দেশটির প্রতি নজর আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের। কেন কিভাবে এই দুর্ঘটনা ঘটল এ নিয়ে প্রাথমিকভাবে বিশ্ব-মিডিয়ার ফোকাস থাকলেও ইরানি এস্টাবলিশমেন্ট সঙ্গত কারণেই প্রশাসন ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্ন রাখার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে। দুর্ঘটনার ইস্যু নিয়ে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা অথবা উদ্ধারে দীর্ঘ সময় লাগার কারণ কী তা নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ চললেও ইরানি কর্তৃপক্ষ সে দিকে কম মনেযোগী। তারা সামনে চলার পথেই অধিক নজর রাখছেন বলে মনে হয়।
সময়টি অতি সংবেদনশীল
ইরানের এই দুর্ঘটনা এমন এক সময় ঘটেছে যখন ইরাইলের গাজা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রাম ও প্রতিরোধ কার্যক্রমে ইরান অন্যতম পক্ষ হয়ে উঠেছে। আর দেশটি এই ভূমিকা পালন করছে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর সত্তাকে চ্যালেঞ্জ করে।
২০২১ থেকে ২০২৪ সময়কাল প্রেসিডেন্ট রাইসির জন্য মোটেই বেশি সময় নয়। কিন্তু এ সময়ে তিনি ইরানকে বৈশ্বিকভাবে প্রাসঙ্গিকতার এমন এক স্তরে নিয়ে গেছেন, যা তাকে সর্বোচ্চ নেতা আলি খামেনির সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী হিসেবে আলোচনায় নিয়ে আসে।
রাইসির মৃত্যুর শূন্যতা তাৎক্ষণিকভাবে ইরানের শাসনব্যবস্থা এবং বিশেষভাবে মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিরোধ অক্ষশক্তির তৎপরতায় যে মাত্রায় হোক না কেন, প্রভাব ফেলবে। তবে এতে ইরানি ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা সামান্যই।
যে দুর্ঘটনায় রাইসির মৃত্যু ঘটেছে, চলমান সময়ে সংবেদনশীলতার কারণে তা নিয়ে সন্দেহ অনিবার্যভাবে ডালপালা ছড়াবে। উত্তর রোডেশিয়া (১৯৬১), চীন (১৯৭১), পাকিস্তান (১৯৮৮) এবং পোল্যান্ডে (২০১০) উচ্চ রাজনৈতিক কর্মকর্তা নিহত হওয়ার মতো বিমান দুর্ঘটনাগুলো নিয়ে এখনো আলোচনা হয়। এ ক্ষেত্রেও একটি প্রশ্ন সম্ভবত জল্পনাকে চালিত করবে যে, রাইসির মৃত্যু থেকে রাজনৈতিকভাবে কারা লাভবান হবে? এমনকি হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হওয়ার কারণ যদি শেষ পর্যন্ত নাও জানা যায়, তবুও এটি ইরানে পরবর্তী সময়ে কী ঘটবে, সে সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দিতে পারে।
নতুন নেতৃত্বে কে আসবেন
ইব্রাহিম রাইসিই ইরানের প্রথম ব্যক্তি নন যিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার প্রথম মেয়াদ শেষ করেননি। তার আগে, আবুল হাসান বানিসদর প্রতিদ্বন্দ্বী উপদলের হাতে বরখাস্ত হয়ে রাষ্ট্রপতির প্রথম মেয়াদ শেষ করতে পারেননি (২২ জুন, ১৯৮১), মুজাহিদিন ই-খালকের বোমা হামলায় নিহত হন মোহাম্মদ আলী রাজাই (৩০ আগস্ট, ১৯৮১)। এই তিনজন ছাড়া বাকি ছয় প্রেসিডেন্টই টানা দুই মেয়াদ পূর্ণ করেছেন ইরানে।
ইরানের সংবিধানের ১৩১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : ‘রাষ্ট্রপতির মৃত্যু, অভিশংসন, পদত্যাগ, অনুপস্থিতি বা অসুস্থতার ক্ষেত্রে বা রাষ্ট্রপতির পদের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে এবং বাধা বা অন্যান্য বিষয়ের কারণে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত না হলে, রাষ্ট্রপতির প্রথম সহকারী তার ক্ষমতা ও দায়িত্বপ্রাপ্ত হবেন। প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার, বিচার বিভাগীয় কর্তৃপক্ষের প্রধান এবং রাষ্ট্রপতির প্রথম সহকারীর সমন্বয়ে গঠিত একটি কাউন্সিল সর্বাধিক ৫০ দিনের মধ্যে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’
এই বিধান অনুসারে প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্টকে ইরানের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করা হয়েছে। সেই সাথে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের দিনক্ষণও জানিয়ে দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা ইরনা গত সোমবার জানিয়েছে, ২৮ জুন শুক্রবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রার্থীরা ৩০ মে থেকে ৩ জুন পর্যন্ত নিবন্ধন করতে পারবেন এবং ১২ জুন থেকে ২৭ জুন সকাল পর্যন্ত প্রচারণা চলবে।
ইরানের ভেতরে-বাইরে নতুন প্রেসিডেন্ট কে হবেন, তা নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রথমে আসতে পারে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ মোখবারের নাম। তিনি একজন মধ্যপন্থী রক্ষণশীল ব্যক্তি। মোখবার রাইসির কর্মীদের মধ্যে তেমন জনপ্রিয় ছিলেন না। মোখবারকে প্রাথমিকভাবে খামেনির সুপারিশে ভাইস প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত করা হয়েছিল আর যদি সর্বোচ্চ নেতা তাকে নির্বাচনে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন তবে তিনি তা করতে পারেন।
মূলনীতিবাদী শিবিরের একজন সদস্য সাঈদ জলিলির নামও এসেছে প্রতিযোগিতায়। তিনি কট্টরপন্থী হিসেবে পরিচিত। জলিলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যেকোনো সংলাপ ও চুক্তির বিরোধিতা করেন। তিনি ২০১৩ এবং ২০২১ সালে রাষ্ট্রপতি হওয়ার জন্য দু’টি ব্যর্থ প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন। রাইসির অভ্যন্তরীণ বৃত্ত তাকে সমর্থন করতে পারে।
বর্তমানে সড়ক ও নগর উন্নয়ন মন্ত্রী মেহরদাদ বজরপাশ অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী হিসেবে পরিচিত। এর আগে তিনি মাহমুদ আহমাদিনেজাদের ২০০৫-২০১৩ সরকারের সিনিয়র পদে ছিলেন। তিনি রাইসি প্রশাসনের ভেতরে ও বাইরে শক্তিশালী। রাইসির টিমের অর্ধেক বজরপাশকে সমর্থন করবে, আর বাকি অর্ধেক জলিলিকে বেছে নেবে বলে মনে করা হয়।
রিপাবলিকান গার্ড এয়ার ফোর্সের একজন প্রাক্তন কমান্ডার, তেহরানের সাবেক মেয়র ও বর্তমান পার্লামেন্ট স্পিকার মোহাম্মদ বাকের কালিবাফ বেশ কয়েকবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেয়ার চেষ্টা করেছেন। রাইসির মৃত্যুর আগে, তাকে রাষ্ট্রপতির সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। পরলোকগত রাষ্ট্রপতির দল তাকে সংসদের স্পিকার নির্বাচিত হতে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। এখন তিনি সম্ভবত তার রাষ্ট্রপতি হওয়ার স্বপ্নের আগের চেয়েও কাছাকাছি। তিনি জালিলিবিরোধী রক্ষণশীল এবং কিছু মধ্যপন্থী ভোটারকে আকৃষ্ট করতে পারেন।
পররাষ্ট্রনীতিতে উদার দৃষ্টিভঙ্গিধারী আলী লারিজানি মধ্যপন্থী এবং রুহানির মিত্র। ২০০৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে পার্লামেন্টের স্পিকার ছিলেন। তীব্র সমালোচনা সত্ত্বেও লারিজানি পারমাণবিক চুক্তি পাস করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ২০২১ সালের নির্বাচনে খামেনির অনুগত থাকা সত্ত্বেও লারিজানিকে প্রতিযোগিতা থেকে বাধা দেয়া হয়েছিল।
ইরানের অন্যতম জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ এবার নির্বাচনে আসতে পারেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ২০১৫ সালে চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য তার আলোচনার দক্ষতার অবদান রয়েছে। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৮ সালে একতরফাভাবে চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সাথে, জারিফের জনপ্রিয়তা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। মূলনীতিবাদীরা জারিফকে তাদের সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে দেখেন, কিন্তু অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, তিনি অভিভাবক পরিষদ থেকে অনুমোদন পাবেন না। ২০২১ সালে, অনেক সংস্কারপন্থী নেতা জারিফকে নির্বাচনে নামতে অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু তিনি প্রত্যাখ্যান করেন।
বয়স হওয়া সত্ত্বেও, ৭৫ বছর বয়সী আলী আকবর সালেহির প্রতি ঐতিহ্যগত রক্ষণশীল, সংস্কারবাদী এবং মধ্যপন্থীদের মধ্যে যথেষ্ট সমর্থন রয়েছে বলে মনে করা হয়। তিনি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির জনক এবং ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তির সাফল্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। সালেহি ২০২১ সালে নির্বাচনে অংশ নেয়ার কথা বলেও পরে প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেন।কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন সাবেক মধ্যপন্থী গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ আবদুল নাসের হেমতিকে ২০২১ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। হেমতির বিদেশী নীতি ও অর্থনীতিতে উদার মতামত রয়েছে এবং তিনি ২০২১ সালে জয়ী হলে জারিফকে তার প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ করতে চেয়েছিলেন।
ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সাবেক প্রধান আলী শামখানি গত বছর সৌদি আরবের সাথে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের জন্য চীনা মধ্যস্থতায় একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি একজন সাবেক রিপাবলিকান গার্ড কমান্ডার এবং সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রীও। সংস্কারবাদী এবং মধ্যপন্থীরা তাকে নেতিবাচকভাবে দেখেন, কারণ শামখানি রুহানির দ্বিতীয় মেয়াদে পারমাণবিক চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টার বিরোধিতা করেছিলেন।
রাইসি হত্যার পেছনে ইসরাইল?
অনেকেই ইরানের প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যুর পেছনে ইরানের চিরশত্রু ইসরাইলের সম্ভাব্য ভূমিকা থাকার ব্যাপারে সন্দেহ করছেন। তারা এটিকে ‘হত্যা’ বলে মনে করেন। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সাবেক সদস্য নিক গ্রিফিন বলেছেন, ‘মোসাদের (ইসরাইলের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা) এই ঘটনায় জড়িত থাকার জন্য স্পষ্টত গাজা/হিজবুল্লাহ/ইরান/ইসরাইল উত্তেজনার বাইরেও আরো কারণ রয়েছে। সত্যি এটি ঘটে থাকলে অবাক হওয়ার কিছু হবে না...।’
এক্সের একটি পোস্টে গ্রিফিন বলেন, ‘রাইসি এবং তার আজারবাইজানীয় প্রতিপক্ষ তাদের সীমান্তে দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতার একটি মেগা প্রকল্প কিজ কালাসি জলবিদ্যুৎ বাঁধটি উদ্বোধন করেছেন। দু’টি শিয়া রাষ্ট্রের মধ্যে ‘সম্পর্কের উন্নতি’ আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়ার মধ্যে উত্তেজনা প্রশমিত করতে সহায়তা করতে পারে। এটি ইসরাইলের কাম্য হওয়ার কথা নয়।’
অন্য একজন বিশ্লেষক রাইসিকে ‘ইসরাইল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের বিরুদ্ধে ইরানের প্রক্সি যুদ্ধের পেছনে একজন প্রধান কৌশলবিদ বলে অভিহিত করে বলেছেন, ...তিনি নির্মমভাবে ভিন্নমত চূর্ণ করেছেন, যারা তার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন তাদের নির্যাতন ও হত্যা করেছেন।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ইসরাইলি কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, এই দুর্ঘটনার সাথে তারা জড়িত নন। রাইসির ‘হত্যাকাণ্ডে’ ইসরাইলের সম্ভাব্য ভূমিকার তত্ত্বটি তেলআবিব ও তেহরানের মধ্যকার সাম্প্রতিক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। গত মাসে ইসরাইল দামেস্কে ইরানি জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদিকে হত্যা করে। এ ছাড়া ইসরাইল কয়েক বছর ধরে ইরানের সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তা এবং পরমাণু বিজ্ঞানীদের লক্ষ্য করে অসংখ্য হামলা চালিয়েছে।
তবে এখন পর্যন্ত এই দুর্ঘটনায় ইসরাইলের সম্পৃক্ততা নিয়ে ইরান সরকারিভাবে কোনো কথা বলেনি।
দেশীয় রাজনীতিতে প্রভাব কী
২০২১ সালে রাইসি কার্যভার গ্রহণ করেন এবং ২০২৫ সালে পুনরায় নির্বাচন করবেন বলে ব্যাপকভাবে প্রত্যাশিত ছিল। তার মৃত্যুর সম্ভাব্য রাজনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে যে ধারণা পাওয়া যায় তার মধ্যে রয়েছে-
প্রথমত, সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে একটি বৈশিষ্ট্য দেখা যায় যে, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে রক্ষণশীল শিবিরে সীমিত করা। ২০২২ সালের সহিংস বিক্ষোভের পর ইসলামী প্রজাতন্ত্রের মূল মতাদর্শের অটল অনুগামী হিসেবে বিবেচিত দলগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা সীমিত রাখার প্রতি গুরুত্ব দেখা যায়। এবার এই কঠোরতা কিছুটা শিথিল হতে পারে। তদারকি সংস্থাগুলো ইরানের রাজনীতিতে সংস্কারবাদী বা মধ্যপন্থী হিসেবে বিবেচিত ব্যক্তিদের প্রার্থিতা বাতিল করার জন্য এবার ততটা উদ্যোগী নাও হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, সর্বোচ্চ নেতা খামেনি রক্ষণশীলদের ঝগড়া-বিবাদের বিষয়ে তিরস্কার করেছেন, তবে রাইসির মৃত্যুর পর সরকারের শীর্ষে অপ্রত্যাশিত শূন্যতার কারণে ফাটল আরো গভীর হতে পারে।
তৃতীয়ত, নির্বাচনী প্রক্রিয়া ক্রমবর্ধমান দুর্বল অনুশীলনে পরিণত হয়েছে। ২০২০ ও ২০২৪ সালের আইনসভা নির্বাচনে এবং সেই সাথে ২০২১ সালে ভোটের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। ২০২১ সালের যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে রাইসি জিতেছিলেন তাতে ভোটদান ছিল ৪৮.৮ শতাংশ, যা ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের কম ভোট পড়ার রেকর্ড। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর ওপর এবার গুরুত্ব দেয়া হতে পারে।
সামাজিক ও রাজনৈতিক বিধিনিষেধের পাশাপাশি একটি ক্রমাগত অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে বৈষম্য বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যায়। সরকার রাইসির মৃত্যুকে কাজে লাগিয়ে এবার জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানাতে পারেন।
রাইসির পররাষ্ট্রনীতির উত্তরাধিকার
স্বল্প সময়ে পররাষ্ট্রনীতি প্রশ্নে রাইসির উল্লেখযোগ্য সাফল্য রয়েছে। রাইসি ও আমির আবদুল্লাহিয়ান তার আরব প্রতিবেশীদের সাথে ইরানের সম্পর্ক পরিবর্তনের তত্ত্বাবধান করেছেন। চীনের সহায়তায় দীর্ঘ দিনের শত্রু সৌদি আরবের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে তারা কাজ করেছেন। তারা সিরিয়ায় ইরানের কূটনৈতিক কম্পাউন্ডে ইসরাইলি হামলার পরে, প্রথমবারের মতো ইসরাইলের ওপর বড় আকারের সরাসরি আক্রমণ করেছেন।
বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, রাইসির মৃত্যু ইরানি পররাষ্ট্রনীতিতে তেমন প্রভাব ফেলতে পারবে না। পররাষ্ট্রনীতি অনেকটা একচেটিয়াভাবে সর্বোচ্চ নেতার ডোমেইন। ইরানের পররাষ্ট্রনীতি সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল দ্বারা নির্ধারিত হয় এবং সর্বোচ্চ নেতা তাতে ভেটো দিতে পারেন। পারমাণবিক কর্মসূচিতেও একই ধরনের গতিপথ দেখা যেতে পারে।
রাইসির সময় ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ চলাকালে মস্কোর সাথে তেহরানের সম্পর্ক গভীর হয়। মধ্যপ্রাচ্যে, উপসাগরীয় আরব প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্ক উন্নত হয়। আর ইসরাইল ও তার মিত্রদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরো গভীর হয়। এ ছাড়া পররাষ্ট্র সম্পর্কে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো চীনের সাথে উষ্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি এবং সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন ও বৃহত্তর ব্রিকসের মতো বহুপক্ষীয় সংস্থায় সদস্যপদ গ্রহণ।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি, আঞ্চলিক নীতি এবং অভ্যন্তরীণ নীতির জন্য ইরানের ওপর আরোপিত ক্রমবর্ধমান পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও একটি ‘প্রতিরোধ অর্থনীতি’ গড়ে তোলায় বেশ কিছু তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি হয় এ সময়ে।
এ সময়টিতে চীন রাশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্ক উন্নত হলেও পশ্চিমের সাথে ইরানের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এটি স্পষ্ট নয় যে, এই দু’টি মৃত্যু ইরানের বৈদেশিক সম্পর্কে বড় পরিবর্তন আনবে কি না। নতুন রাষ্ট্রপতি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের ভিন্নমুখী নীতিগুলো গঠন করার ক্ষমতার ক্ষেত্রে একই কাঠামোগত সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হতে পারেন।
প্রকৃতপক্ষে, আগামী কয়েক সপ্তাহের জন্য, ইরান অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মনোনিবেশ করবে, কারণ দেশটি তার নবম রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করবে। এর পাশাপাশি পার্লামেন্টের একজন স্পিকার ও বিশেষজ্ঞদের অ্যাসেম্বলির চেয়ার নিশ্চিত করবে।
রাইসির মৃত্যুতে অনেক কিছুই হয়তো অপরিবর্তিত থাকবে। ইরানে সব রাষ্ট্রীয় বিষয়ে চূড়ান্ত বক্তব্য রাষ্ট্রপতির পরিবর্তে সর্বোচ্চ নেতার রয়েছে। ফলে ইরান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের প্রতি তার শত্রুতা অব্যাহত রাখবে। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে প্রক্সি জঙ্গিগোষ্ঠীকে সমর্থন করবে এবং তার পারমাণবিক নীতি বজায় রাখবে। আর রাইসির মৃত্যু ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সামগ্রিক নীতিতে বড় পরিবর্তন আনবে এমনটি আশা করা যায় না।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন