চীনের দিক থেকে এমন ‘শত্রুতা’ ইসরায়েল আশা করেনি। চীন কার্যত ইসরায়েলের সঙ্গে মৈত্রীর সব সেতু পুড়িয়ে দিয়েছে গাজা গণহত্যার পর। হামাসের হামলা নিয়ে চীনের বিবৃতি আর ইরানের বিবৃতির মধ্যে পার্থক্য কেবল ভাষায়, বক্তব্য অভিন্ন। তারা উভয়ই হামাসের হামলাকে ‘সন্ত্রাসী’ তো বলবেই না, উল্টা একে বলেছে ফিলিস্তিনিদের আত্মরক্ষার অধিকার। এটাকে তারা যুদ্ধও বলছে না, বলছে ‘গাজা গণহত্যা’।
চীন ফিলিস্তিনের পক্ষে কতটা শক্তভাবে দাঁড়িয়েছে তার আলামত পাওয়া যায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিজে) চীনা প্রতিনিধির বক্তব্যে:
আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সংগ্রামে ফিলিস্তিনি জনগণ বিদেশি নিপীড়ন রুখতে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজ সম্পূর্ণ করতে বল প্রয়োগের আশ্রয় নিয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনে এটা তাদের অবিচ্ছেদ্য অধিকার। কথাটা কে বলছে? কথাটা বলছে চীন। চীন কী? দুনিয়ার অন্যতম বিখ্যাত বাজার বিশ্লেষক ডেভিড পি গোল্ডম্যান বলছেন, ২০২৪-এর এপ্রিলে চীন গ্লোবাল সাউথের ৬ বিলিয়ন মানুষের বাজারে সেরা রপ্তানিকারকের জায়গাটা নিয়ে নিয়েছে।
এবং তারপর বেইজিং হামাস প্রতিনিধি দলকে ডেকে নিয়ে গিয়ে সমাদরে আলোচনায় বসিয়েছে। তাহলে কী ঘটছে? হামাসের লড়াই এগিয়ে আনছে নতুন বৈশ্বিক নিরাপত্তা-বন্দোবস্ত এবং চীন-ইসরায়েল বৈরিতা?
গত ১৭ মার্চ কাতারে হামাসের নেতা ইসমাইল হানিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন চীনের রাষ্ট্রদূত ওয়াং কেজিয়ান। ছবি: সংগৃহীত
তাহলে দুনিয়া কোন দিকে হেলে পড়েছে? যেদিকে চীন, রাশিয়া ও ইরান একসঙ্গে দাঁড়ায়, সেই দিকটাই ভারী। যখন নেতানিয়াহু ও বাইডেনের মধ্যে চিকন কিন্তু ধারালো দূরত্ব; তখন ন্যাটোস্তানের আরামকেদারা আরব রাজতন্ত্রগুলি বলছে, তোমাদের গান আর শুনতে ভালো লাগছে না, ‘গাইবি যদি গা ওই দিকে অর্থাৎ (ইসরায়েলের দিকে) মুখ করে। আরব আমিরাতের মার্কিন ঘাঁটির বোমারু বিমানগুলি সরিয়ে নিতে হচ্ছে কাতার ও ওমানে, জর্ডানের বাদশার মতো বশংবদ ব্যক্তিও ইসরায়েলের ইরান হামলায় ব্যবহৃত হতে নারাজি জানিয়ে দিয়েছে।
ঠিক সেই সময়, ঠিক সেই সময়ে বিশ্বের পরাশক্তিগুলির নতুন প্রজন্ম ওরফে ব্রিকসের পূর্ণ সদস্যপদ পেয়েছে ইরান। এ মাসেই কাজাখস্তানের আস্তানায় ব্রিকসের নিকটাত্মীয় সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনে চীন ও রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ইরানের পাশে থাকার কথা জোরের সঙ্গেই জানান দিয়েছেন। সিরিয়ায় ইরানের দূতাবাসে হামলার জবাবে ইরানের বর্ণিল ও বিস্ময়কর পাল্টা জবাবের ঘটনা এর পরের কাহিনি।
যে দুনিয়া কেবল বাইডেন-নেতানিয়াহুর ফোনালাপের খবর শুনে অভ্যস্ত, তারা এখন জানছে যে, ইরানের হামলার পরে ইরানি ও রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে ফোনালাপ করেছেন। একই রকম আলাপ হয়েছে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গেও। তারপরও গণমাধ্যমে আসে চীনের তরফে বিখ্যাত উক্তিটি যে, ‘ইরান জানে কী করে পরিস্থিতি সামলাতে হবে।’
বাইডেন ও নেতানিয়াহুর ব্যক্তিগত সম্পর্কে চিড় ধরলেও পুতিন ও শি জিনপিংয়ের ব্যক্তিগত যোগাযোগ আরও নিবিড় হচ্ছে। পুতিনের এই বেইজিং সফর তার প্রকাশ্য স্টেটমেন্ট।
এর মধ্যেই ইরান মধ্যপ্রাচ্যের খেলার নিয়ম সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। এখন ফিলিস্তিনের পক্ষে দাঁড়ানো বিশ্বজনমতের সামনে প্রশ্ন: কীভাবে এবং কার মাধ্যমে এই বর্বর গণহত্যা বন্ধ হবে? এই প্রশ্নের লেজে রয়েছে আরেকটা প্রশ্ন, ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পূর্ণ পরাজয় ঘটবে কখন? দয়া করে অপেক্ষা করুন, ঠিক এটাই এখন আলোচনা করছেন পুতিন ও শি। এবং ওই যে বললাম, ব্যক্তিগতভাবে মুখোমুখি বসে।
ইউক্রেন থেকে গাজা সবখানেই চীনের ভূমিকা হলো এটা দেখানো যে, পশ্চিমারা নয়, বিশ্বের সামনে বিকল্প নিরাপত্তা ব্যবস্থা দিতে পারে চীন-রাশিয়া, গ্লোবাল সাউথ, ব্রিকস কিংবা অন্য যে নামেই তাকে ডাকা হোক। মনে রাখা দরকার, চীন বিশ্বের বৃহত্তম তেল আমদানিকারক দেশ। এর জন্য তার ইরানকেও লাগবে, আরবকেও লাগবে। চীন জানে, বিশ্বের প্রায় দুইশ কোটি মানুষ মুসলমান, এরাই তার বৃহত্তম বাজার এবং বিশ্বনেতৃত্ব পেতে হলে মুসলমানদের সমর্থন তার চাই। কেবল চীন কেন, গত কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস দেখুন। বিশ্ব যারা শাসন করেছে তাদের বাস হয় মধ্যপ্রাচ্যের কোনো রাজধানীতে, নতুবা তারা মধ্যপ্রাচ্যকে পদানত করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিশ্ব শাসনের স্মৃতি তেমন আর টিকে নাই। তবে সাম্রাজ্যের সিংহাসনের পাদানি হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের নতজানু ভূমিকা এখনও স্মৃতিতে তাজা।
সাম্রাজ্যের সিংহাসনে ওঠার একটা পাদানি লাগে। ওখানে দাঁড়িয়েই দেখানো হয় যে, আমরাই সাম্রাজ্য, আমরাই মালিক। ইউরো-মার্কিন সাম্রাজ্যের পাদানি হলো আরব অঞ্চল। রোমান সাম্রাজ্য থেকে ঔপনিবেশিক আমল হয়ে আজতক আরব জাহান ক্ষমতা ও সম্পদের স্নায়ুকেন্দ্র হয়ে আছে।
পশ্চিমাদের একাধিপত্য শেষ হবে তখন যখন আরব চীন-রাশিয়ার সঙ্গে আরও জড়িয়ে যাবে। আর এটা ঘটবে তখন যখন ফিলিস্তিন মুক্ত হবে। ফিলিস্তিনের মুক্তি তাই বিশ্বমুক্তির শর্ত। তেমনি আরব মুক্ত না হলে ফিলিস্তিন মুক্ত হবে না। ইসরায়েলকে দমন করা ছাড়া সেটা অসম্ভব।
ফিলিস্তিনিরা যে লড়াই চালাচ্ছে গত ৮০ বছর, সেটাই দুনিয়ার সবচেয়ে মারাত্মক সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াই। আজ ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্বজনমত যেভাবে সজাগ, সেটা ইউরো-মার্কিন একাধিপত্যকে দুর্বল করে ফেলেছে।
এই সুযোগে এগিয়ে যাচ্ছে অক্ষশক্তির তিন দেশ: চীন-রাশিয়া-ইরান। তুরস্ক ও ভারত দোদুল্যমান। এই দোদুল্যমানতা তাদের পরাশক্তি হবার পথে বাধা।
কেবল ইরান নয়, সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলির সঙ্গেও চীন নিবিড় লেনাদেনার সম্পর্ক পাতাচ্ছে। ইরান-সৌদি সম্পর্কের জ্বালাপোড়াও অনেকটা নিভেছে চীনের কৌশলী দূতিয়ালিতে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নও আরব জাতীয়তাবাদ কাজে লাগিয়ে মধ্যপ্রাচ্য থেকে পশ্চিমাদের সরাতে চেয়েছে। এ ব্যাপারে তারা কিছুটা সফল হলেও সৌদি প্রচারিত রক্ষণশীল ইসলাম এবং কমিউনিজমবিরোধী তৎপরতার কারণে সেটা স্থায়ী হয়নি। ঠিক যে কায়দায় যুক্তরাষ্ট্র কমিউনিজমবিরোধী প্রচার চালাত, সেই একই কায়দায় চীনের জিংজিয়াং প্রদেশের উইঘুর মুসলমানদের ওপর চীনা কর্তৃপক্ষের দমন-পীড়নকে দেখিয়ে মুসলমানদের মধ্যে থেকে চীনবিরোধী জঙ্গিগোষ্ঠী তৈরি করতে চাইছে।
এই জিংজিয়াং হলো বেল অ্যান্ড রোড উদ্যোগের একটা বড় কেন্দ্র। ঠিক যে কারণে ভারত ও চীনা প্রকল্পের জন্য জায়গা বের করতে আরাকানে রোহিঙ্গা বিতাড়ন হয়েছে, একই রকম প্রয়োজন থেকে চীনের জিংজিয়াংয়ের কঠোরতা জারি রয়েছে। কিন্তু চীন তো অন্তত নারী ও শিশুদের ওপর গণহত্যা চালায়নি; যেভাবে পশ্চিমা জোট চালাচ্ছে ফিলিস্তিনের ওপর।
তাই আখেরে মুসলমানদের চীনের বিরুদ্ধে ততটা ক্ষেপিয়ে তোলা যাবে না বলেই মনে হয়।
এখন ইসরায়েল কী করবে? তারা চীন ছেড়ে ভারতের দিকে ঝুঁকছে। ভারতও এই সুযোগে পাশ্চাত্যের ইহুদিবাদী লবির কোলে চড়ে বিশ্বশক্তি হবার ফন্দি কষছে। করতেই পারে। কিন্তু মুশকিল হলো, বিশ্বের দুই বিলিয়ন মুসলমান, দেড় বিলিয়ন চীনা যত বড় অর্থনীতি হতে পারে, ততটা অন্যদের পক্ষে হওয়া কঠিন। কারণ, একা চীনের বাণিজ্য পশ্চিমাদের সম্মিলিত বাণিজ্যের চাইতে বড় হয়ে উঠেছে গ্লোবাল সাউথে। আর চীন তো এই ধাপে এটাই চাইছে, গ্লোবাল সাউথের নেতৃত্ব ও সমর্থন।
বেইজিং তার চেহারা দেখিয়ে ফেলেছে। তারা যে কোনো রকম ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের বিপক্ষে। তারা এই মুহূর্তেই যুদ্ধবিরতি চায়, এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি তাদেরও দাবি। প্রেম নয়, মানবতা নয়, শান্তি নয়; অন্য কোনো বোধ তাদের চালিত করছে। বিশ্বের নতুন নিরাপত্তা বন্দোবস্তের খাতিরেই এটা তাদের দরকার।
হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলার আগে মধ্যপ্রাচ্য কেন বিশ্বের ভূরাজনীতিই অনেক জটিল ছিল, অস্পষ্টও ছিল খেলোয়াড়দের চেহারা। হামাসের অপারেশন কেবল ফিলিস্তিনি প্রশ্নকেই দুনিয়ার এক নম্বর মনোযোগে ও সমর্থনে আনতে সক্ষম হয়নি, চীন-রাশিয়া-ইরান এবং তাদের প্রতিরোধের অক্ষশক্তির জন্য এগিয়ে যাওয়ার পথনকশা তৈরি করে দিয়েছে। হামাস মার্কিন-ইসরায়েল-ব্রিটেন-ফ্রান্স-অস্ট্রেলিয়া-ভারতকে বিশ্বের সামনে এবং চীন-রাশিয়ার সামনেও বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। সত্যিকার গেইম-চেঞ্জার তাহলে কে হলো?
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক; সমকালের পরিকল্পনা সম্পাদক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন