টানা অবরোধের মধ্যে একদিকে রাজনৈতিক সহিংসতা-নাশকতা, অন্যদিকে পুলিশ-র্যাবের ক্রসফায়ার-গ্রেপ্তার বাণিজ্য বেড়েই চলেছে। ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত লাগাতার ৩০ দিনের অবরোধ, ঢাকা ও বিভিন্ন জেলায় ৪১৩০ ঘণ্টার হরতালে সারা দেশে বিভিন্নভাবে ৬৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন ৩২ জন। পুলিশ ও র্যাবের সঙ্গে কথিত (ক্রসফায়ার) বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন ১০ জন। মারপিট ও পুলিশি হামলায় মারা গেছেন ১০ জন। পুলিশ ও পিকেটারদের দুপক্ষের গোলাগুলিতে মারা গেছেন ১২ জন। অন্যান্যভাবে মারা গেছেন ৭ জন। নিহতদের মধ্যে যানবাহন শ্রমিকের সংখ্যা ১৯ জন। মোট নিহতের মধ্যে ১৫ জন রাজনৈতিক নেতাকর্মী। বাকি ৪৪ জনই সাধারণ মানুষ। অগ্নিদগ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিক্যালসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মৃত্যু সঙ্গে লড়ছেন দুই শতাধিক মানুষ। শুধু ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি আছেন ১১১ জন। এ সময়ের মধ্যে সারা দেশে মোট ১১শ যানবাহনে আগুন ও ভাঙচুর হয়েছে। মোট ১০ দফায় রেলে নাশকতা হয়েছে।
নাশকতা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় হুকুমের আসামি করা হয়েছে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের। এসব ঘটনায় দলের ৩৫ হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। এদের মধ্যে ১৪ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে। যদিও সরকারিভাবে বলা হচ্ছে, এ সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। ৩০ দিনের অবরোধ-সহিংসতায় বেশি মানুষ মারা গেছেন যেসব জেলায় সেগুলো হলোÑ কুমিল্লা, রংপুর, ঢাকা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর, বরিশাল, চট্টগ্রাম, যশোর, সিরাজগঞ্জ ও বগুড়া। বছরের প্রথম দিন থেকে এ পর্যন্ত দেশের ৬৪ জেলায় প্রায় ৪ হাজার ১৩০ ঘণ্টা হরতাল পালন করেছে স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। প্রায় এক মাস ধরে চলা বিরোধী কর্মসূচিতে রাজনৈতিক সহিংসতায় একদিনে নিহত ব্যক্তিদের সংখ্যা সর্বোচ্চ ছিল ২৯তম দিনে গত বুধবার। ওইদিন ১৫টি জেলার অন্তত ২৪টি স্থানে সহিংসতার ঘটনা ঘটে। দিনশেষে রাত ১২টা পর্যন্ত ২৫টি গাড়িতে পেট্রলবোমা হামলা ও অগ্নিসংযোগ হয়েছে। মারা গেছে ১২ জন। ভাঙচুর করা হয় অন্তত ২৭টি যানবাহন। ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা। বলেছেন, হামলায় হতাহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ সরকার দেবে। তিনি বলেন, হরতালে হামলা হলে বিমা কোম্পানি ইন্স্যুরেন্স দেয় না। বেশিরভাগ গাড়ির ফার্স্ট পার্টি ইন্স্যুরেন্স নেই। কিন্তু সরকার থেকে এখনো কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি মালিক ও শ্রমিকরা।
মন্ত্রীরা আরও বলেছিলেন, এক সপ্তাহেই ২০ দলীয় জোটের খেলা শেষ হয়ে যাবে। সেটা হয়নি। এখন পুলিশপ্রধান এক সপ্তাহের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে সরকারবিরোধী সহিংসতা খতম হয়ে যাবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন, নিরাপত্তা বৈঠকে সরকার সমর্থকদের উৎসাহিত করেছেন সরকারবিরোধী নেতাকর্মীদের সন্ত্রাসী-দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে আদালতে হাজির হতে, সব কটি জেলা-উপজেলায় যুগপৎ ‘পাবলিক ইন্টারেস্ট’ মামলা ঠুকে হয়রানির কৌশল দিয়ে জব্দ করতে। আর খোদ অর্থমন্ত্রী পার্লামেন্টেই বললেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী জোটনেত্রী খালেদা জিয়া ‘দেশের শত্রু’, ‘স্টুপিড’।
দেশের ‘তৃতীয় পন্থী’ ছুটকো রাজনীতিবিদরা, আর সুশীল সমাজের খুচরো নেতারাও বসে নেই। তারা ‘সংলাপ’, ‘সংলাপ’ বলে আওয়াজ তুলে চলেছেন, তাদের অন্তর্ভুক্ত করে সালিশ হিসেবে একটা সর্বদলসম্মত সংসদবহির্ভূত জাতীয় সরকার গঠনের ‘ফর্মুলা’ দিয়ে চলেছেন। তাতে বিভ্রান্তি বাড়ছে বই কমছে না। লোকে বলছে, সংলাপের লক্ষণ নেই, প্রলাপ বাড়ছে বিলক্ষণ। সংকট উত্তরণে নানা সুপারিশ আসছে বৈদেশিক মহল থেকেও। সরকারকে দমনপীড়ন বন্ধ করতে আর বিরোধী জোটকে সহিংস অবরোধ প্রত্যাহার করতে বলছেন তারা। আরও বলছেন, প্রথাগত রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থার বিভিন্ন স্তরের বিভিন্ন অংশীদারের সমন্বয়ে রাজনৈতিক সংলাপ আয়োজন, সংলাপের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক চর্চার রূপরেখা প্রণয়ন, মত প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করা, বিরোধী দলগুলোকে মত প্রকাশে শান্তিপূর্ণ উপায় অবলম্বন, ধৈর্য ও সংযম প্রদর্শন এবং সহিংসতা মোকাবেলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে কমিউনিটিভিত্তিক কার্যক্রম গ্রহণের কথা। তথা, রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সাংবিধানিক কাঠামোকে প্রকারান্তরে নতুন করে ঢেলে সাজানোর কথা বলছেন বৈদেশিক মহল বিভিন্ন সূত্রে অনানুষ্ঠানিকভাবে। ভারতীয় মিডিয়াও কিছুটা সুর পাল্টেছে, একতরফা শেখ হাসিনার প্রশাসনের সাধুবাদ আর সাধছে না ভারতীয় প্রচারযন্ত্র।
বাংলা ট্রিবিউনে সংবাদভাষ্যকার রঞ্জন বসু দোসরা ফেব্রুয়ারি যেমন লিখেছেন : দুই নেত্রী এনগেজ হলেই অযথা প্রশ্ন থেকে বাঁচে দিল্লি। ‘বাংলাদেশে যখনই কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা বা সহিংসতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, সাংবাদিকরা অবধারিতভাবে মিডিয়া ব্রিফিংয়ে জানতে চান, এ ব্যাপারে ভারতের প্রতিক্রিয়া কী? আর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সৈয়দ আকবরউদ্দীন প্রায় মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মুচকি হেসে জবাব দেন, আপনারা তো জানেনই, প্রতিবেশী দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলানো ভারতের স্বভাব নয়! বাংলাদেশের ভবিতব্য সে দেশের মানুষকেই স্থির করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি ...।
প্রায় এক মাস ধরে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক অবরোধ, সহিংসতা আর স্থবিরতা চলছে তাতে দিল্লিও কিন্তু এখন কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ না ফেলে বসে থাকতে পারছে না। এমনকি, সরকারিভাবেও।
এতে শুধু বাংলাদেশের উন্নয়ন বা প্রগতিই থমকে নেই, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতাও প্রশ্নের মুখে পড়ছে। কাজেই বিএনপিকে কোনো না কোনোভাবে এনগেজ করতেই হবে, যাতে রাস্তার অন্দোলন থেকে তাদের সরিয়ে আনা যায়!
দিনকয়েক আগে বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ দিল্লিতে এসে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করে গেছেন। তা নিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে কিছু লেখালেখি হয়েছে। তিনি শেখ
হাসিনার বার্তা নিয়ে এসেছিলেন, এমনটাও দাবি করেছেন কেউ কেউ। তবে আসল ঘটনা হলো, সেই বৈঠকের চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দিল্লিতে এইচটি ইমামের সাক্ষাৎ। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টাকে সেই বৈঠকে মোদি সরাসরি বলেছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য কিছু একটা উপায় আপনাদেরই বের করতে হবে।
এইচটি ইমাম, গওহর রিজভী আর মসিউর রহমান যথাক্রমে রাজনীতি, পররাষ্ট্রনীতি আর অর্থনীতিবিষয়ক এই তিন উপদেষ্টা হলেন দিল্লির ব্যাপারে শেখ হাসিনার চোখ-কান। এরা তিনজন ঘন ঘন সফরে ভারতে আসেন। মনমোহন সিংয়ের ইউপিএ আমল থেকেই এই রেওয়াজ চলে আসছে। আর আট মাস আগে বিজেপি সরকার দিল্লির ক্ষমতায় আসার পরও সেই রুটিনের কোনো ব্যতিক্রম হয়নি।
তবু এই ত্রয়ী যে দিল্লিতে তাদের বন্ধুদের গলায় ইদানীং কিছুটা বেসুরো আওয়াজ শুনছেন না তাও কিন্তু নয়। শেখ হাসিনার প্রতি ভয়ে হোক বা ভক্তিতে, ভারতের বিগত ইউপিএ সরকার বিএনপির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সব ধরনের সম্পর্ক মোটামুটি শিকেয় তুলে দিয়েছিল। কিন্তু এখন ক্ষমতাসীন বিজেপির একটা অংশ বিশ্বাস করে সেটা কোনো কাজের কথা নয়, বিএনপির প্রতিও বাংলাদেশে রীতিমতো পপুলার সাপোর্ট আছে। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, দুই দেশের অনেক অমীমাংসিত সমস্যা হয়তো বিজেপি আর বিএনপির মতো দুটো দক্ষিণপন্থী দল ক্ষমতায় থাকলে তবেই সমাধান করা সম্ভব। আওয়ামী লীগ সেটা কোনোদিনও করে উঠতে পারবে না। এমনকি বারাক ওবামার সদ্যসমাপ্ত ভারত সফরেও যখন দক্ষিণ এশিয়ার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে দিল্লি আর ওয়াশিংটনের আলোচনা হয়েছে, তখন ভারত মার্কিন প্রেসিডেন্টকে পরিষ্কার করে দিয়েছে, নেপাল হোক বা শ্রীলংকা-বাংলাদেশ, তারা ইনকুসিভ কূটনীতিরই পক্ষপাতী। অর্থাৎ এই প্রতিবেশী দেশগুলোতে কোনো একটি দল বা গোষ্ঠীকে ভারতীয় লবির বলে চিহ্নিত করা হবে, নরেন্দ্র মোদি সেই রেওয়াজ বন্ধ করতে চান বলেই মিস্টার ওবামাকে ব্রিফ করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা খালেদা জিয়াকে ‘শান্ত করার’ একটা ‘উপায়’ বের করতে পারবেন, এই দুরাশা ব্যক্ত করে তার টীকা সমাপ্ত করেছেন রঞ্জন বসু।
অন্যদিকে বিলাতের ‘দি ইকোনমিস্ট’ পত্রিকা অবশ্য যা বলেছে সেটা পাশ্চাত্য মহলের উপরিউক্ত ব্যবস্থাপত্রগুলোরও ব্যতিক্রম। মোদ্দা কথায় দি ইকোনমিস্ট এক রকম ভবিষ্যদ্বাণী করেছে বলা চলে যে, ক্ষমতার লড়াইয়ের মাঠে এ দেশের দীর্ঘদিনের ট্রাডিশন ‘রাজনৈতিক দাঙ্গাবাজি’, সেই খেলা শেষ হতে চলেছে। ‘টাইম আউট’ বা খেলা খতম বলে হুইসেল বাজাতে হবে অনিচ্ছুক সেনাবাহিনীকেই।
সাধারণ মানুষ অবশ্য ‘অনিচ্ছুক’ সেনাবাহিনীসহ ক্ষমতাবান কারও মধ্যেই এখন পর্যন্ত তাদের জন্য সত্যিকারের দরদের কোনো ইশারা খুঁজে পাচ্ছে না, শুধু আল্লাহতাআলার ওপরে ভরসা করেই তারা ‘সব নির্যাতন’ সহ্য করে চলেছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন