নারায়ণগঞ্জ নগর করপোরেশনের প্যানেল মেয়র ও একজন বিশিষ্ট আইনজীবীসহ সাতজনকে দিনদুপুরে রাস্তায় আটক ও অপহরণ করে গুম, খুন আর তার জেরে শীতল্যা নদী থেকে ১১ লাশ উদ্ধারের ভয়ঙ্কর ঘটনা তদন্তে সরকার বাহাদুর, মহামান্য আদালত, পুলিশ কর্তৃপ ও র্যাব সদরের মধ্যে যেন বাগি¦তণ্ডার পিংপং খেলা শুরু হয়েছে। সরস টিকা-টিপ্পনিসহ সেই খেলার ধারা বিবরণী টকশো আর পত্রপত্রিকায় দিয়ে চলেছেন সুশীলসমাজের ধ্বজাধারীরা। একই সাথে সিগনাল মিলেছে বাংলাদেশের শাসনসঙ্কট নিয়ে কড়া ‘কূটনৈতিক নজরদারি’ বহাল। বিষয়টা মোটেও খেলা খেলা নয়।
২৭ এপ্রিল বিকেলে অনলাইনে খবর : কোর্টে একটা মামলায় হাজিরা দিয়ে ফেরার পথে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম তার গাড়ির চালক ও অপর তিন সঙ্গীসহ বেলা আড়াইটায় ফতুল্লা এলাকার শিবু মার্কেটের সামনে থেকে অপহৃত হয়েছেন। দুর্বৃত্তরা তার গাড়ি থামিয়ে র্যাব পরিচয় দিয়ে আটক করে তার ‘প্রাইভেট গাড়ি’তে উঠেই দ্রুত পালিয়ে যায়। বিকেল ৫টা নাগাদ খবর ছড়িয়ে পড়লে ওই কাউন্সিলরের অনুসারীরা ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সাইনবোর্ড এলাকায় টায়ার জ্বালিয়ে আন্তঃজেলা যান চলাচল অবরুদ্ধ করে। পুলিশ তাদের হটিয়ে দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। আরো খবর, কাউন্সিলরের গাড়ির পেছনে আরেকটি গাড়ির চালক তাদের অপহরণের চিত্র মোবাইলে গ্রহণ করেছিল সন্দেহে সেই গাড়ির চালক ও আরোহী আইনজীবী চন্দন সরকারও অপহৃত হয়েছেন একই কায়দায়।
মতাসীন দলের (বিদ্রোহী?) নেতা এবং এর সুশীল নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না এ সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে সংবাদমাধ্যম ও পুলিশের কাছ থেকে খবর নিয়ে জানতে পারেন : ‘২৭ এপ্রিল অপহরণের ঘটনা ঘটার পর সাংবাদিকেরা অকুস্থল পরিদর্শন করেছিলেন। সেখানে কেউ বলেননি যে, তারা ঘটনা দেখেছেন। ঢাকা রেঞ্জের এক পুলিশ কর্মকর্তা সরেজমিন ঘুরে এসে মন্তব্য করেছিলেন, এটাকে ঠিক গুম বলা যাবে না। এটাকে নিখোঁজ বলাই ঠিক হবে, যেহেতু কোনো প্রত্যদর্শী পাওয়া যায়নি।’
৩০ এপ্রিল মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধি সভার পররাষ্ট্রবিষয়ক এশিয়া প্যাসিফিক সাব-কমিটির কাছে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে বয়ান দিয়েছিলেন মার্কিন সরকারের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল। জবানবন্দিতে তিনি বলেছিলেন : ‘৫ জানুয়ারি (একতরফা) নির্বাচনের পর থেকে (বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে) বিরোধী দল, স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ও সুশীলসমাজকে যেভাবে হয়রানি করা হচ্ছে, তাতে ওয়াশিংটন হতাশ; আমরা বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের (ক্রসফায়ার) ধারাবাহিকতায় এবং গুম ও অপহরণের সংবাদে।’
ওই দিনই শীতল্যায় অপহৃতদের লাশের হদিস মিলল হাত-পা বাঁধা, পেটকাটা, ইটপুরে বস্তাবন্দী অবস্থায়। ইটের ওজনে আর পেটে পানি ঢুকে ডোবা লাশ ফুলে পচে ভেসে উঠেছে। পরবর্তী খবরে জানা যায়, আরো চারটি লাশ নদীতে ভাসমান পাওয়া গেছে, দু’জন মাঝি আর দু’জন জেলে। সংবাদদাতার অনুমান,
বস্তাবন্দী লাশ নদীতে ফেলে দেয়ার ঘটনা দেখে ফেলেছিল বলে তাৎণিকভাবে ওই চারজনকেও খুন করে নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছিল। পত্রপত্রিকায় আরো খবর আসে, যে ধরনের ইটপুরে বস্তাবন্দী লাশ ডোবানো হয়েছিল, একই ধরনের ইট পড়ে আছে নারায়ণগঞ্জ র্যাব-১১ দফতরের পাশে।
৩০ এপ্রিল রাত থেকে ১ মে সকালের মধ্যে অপহৃত সাত ব্যক্তির লাশের ময়নাতদন্ত হয় নারায়ণগঞ্জ সদর হাসপাতাল মর্গে। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে বলা হয়, ‘নিহতদের প্রত্যেককে মাথায় আঘাত করে অচেতন করার পর গলায় রশি পেঁচিয়ে শ্বাস রোধ করে হত্যা করা হয়। হত্যার আগে অজ্ঞান করার জন্য মাথায় আঘাত করা হয়। এরপর লাশ ফেলে দেয়া হয় নদীতে। নিহতদের বুক ও পেটে অস্ত্রাঘাতের চিহ্ন ছিল। সাতজনকে একই কায়দায় হত্যা করা হয়। যারা হত্যা করেছে তারা দ ও পেশাদার।’
ও দিকে অপহরণ ও লাশ আবিষ্কারের পরপরই নারায়ণগঞ্জের সরকারদলীয় অন্যতম সংসদ সদস্য শামীম ওসমান আওয়াজ তুলেছিলেন, তার লোক গুম, খুন হয়েছে; তিনি অপহরণের ১০ মিনিটের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীকে সব কথা জানিয়েছেন। প্রশাসনের সর্ষের মধ্যে ভূত আছে। অপরাধী পার পাবে না। পাল্টা আওয়াজ তুললেন মতাসীন দলেরই সদস্যা, নারায়ণগঞ্জের নগর করপোরেশন মেয়র সেলিনা হায়াত আইভি। বললেন : “(অপহরণের) পরপরই যদি অভিযান চালানো হতো, তাহলে হয়তো মানুষগুলোকে জীবিত উদ্ধার করা যেত, যেটি ত্বকীর েেত্রও হয়েছিল। আমরা বারবার অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনী ‘খুঁজছি’, ‘দেখছি’ ইত্যাদি বলে সময়পেণ করল। প্রশাসনে যারা আছেন, তারা প্রভাবশালীদের কথায় ওঠবোস করেন। বিগত ৩০ বছর নারায়ণগঞ্জে এটাই চলে আসছে। যে দলই মতায় থাকুক না কেন, প্রশাসনের কর্মকর্তারা প্রভাবশালী (একটি) পরিবার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কাজ করেছেন।”
উল্লেখ্য, মেধাবী স্বাধীনচেতা যুবক ত্বকীকে অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যার জন্য শামীম ওসমানের ভ্রাতুষ্পুত্র দায়ী বলে অভিযোগ। তদন্ত এগোয়নি, মামলা হয়নি। আইভি আরো বলেন : ‘২০১৩ সালের ৮ মার্চ তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যার পর থেকে নারায়ণগঞ্জ অশান্ত হয়ে ওঠে। এর পর থেকে জেলায় শিশুহত্যা বেড়ে যায়। এ পর্যন্ত জেলায় ২০-২২ জন শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। আমি মনে করি, ত্বকী হত্যার বিচার হলে এতগুলো শিশু হত্যার ঘটনা ঘটত না। (আরো) একটি কারণ মাদক। পুরো নারায়ণগঞ্জে মাদকের ছড়াছড়ি। প্রশাসনের নাকের ডগায় এখানে মাদক ব্যবসায় চলছে। (এখন) কোর্টে হাজিরা দিতে এসে, আইনের আশ্রয় নিতে এসে কেউ যদি অপহৃত হন এবং লাশ হয়ে ফিরে আসেন, এর চেয়ে মর্মান্তিক আর কী হতে পারে।’
তিন পুরুষ ধরে প্রভাব গড়ে ওসমান পরিবারের ‘গডফাদার’ শামীম এখন সন্ত্রাস ও ছায়া প্রশাসন চালাচ্ছেনÑ এমন ইঙ্গিত দিয়ে আইভি নিজেরও নিরাপত্তাহীনতার কথা বললেন : ‘আমার নিজের জন্য নয়, আমি কর্মীদের ব্যাপারে শঙ্কিত। যারা আমার পে নির্বাচন করেছেন, তাদের বিভিন্ন মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। জেলে পাঠানো হচ্ছে। বিশেষ করে বন্দর থানা ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় আমার কর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়া এবং তাদের তুলে নেয়ার পাঁয়তারা চলছে বলে শুনেছি।’
১ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ নিয়ে নির্বিকারভাবে রসনা-কণ্ডূয়ন করলেন। দোষারোপের রাজনীতির চলতি রেওয়াজ মোতাবেক গাজীপুরের ভাওয়াল সরকারি কলেজ মাঠে শ্রমিক লীগ আয়োজিত মে দিবসের সভায় তিনি টিপ্পনি কাটলেন : ‘বিএনপির এক নেতা বলেছেন, চোরাগোপ্তা আন্দোলন করবে। চোরাগোপ্তা আন্দোলন করে নাকি সরকারের পতন ঘটাবেন। এখন দেশে যে চোরাগোপ্তা হত্যাকাণ্ড হচ্ছে, এর জন্য তারাই যে দায়ী, এর মধ্যে আর কোনো সন্দেহ নাই। যাদের চুরি করা অভ্যাস, হত্যা ও চোরাগোপ্তা রাজনীতিতে বিশ্বাস, তারাই এসব করে।’
মৃদুভাবে একটা প্রতিবাদ অবশ্য এসেছে তারই দলীয় সাবেক নেতা, বর্তমানে সুশীল নাগরিক মাহমুদুর রহমান মান্নার প্রতিক্রিয়ায়। একটা গোলটেবিল বৈঠকে তিনি বললেন : নারায়ণগঞ্জের ঘটনার ১০ মিনিট পর শামীম ওসমানের ফোন। এরপর গাজীপুরের সমাবেশে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, এটা বিএনপি ঘটিয়েছে। ভণ্ডামির একটা সীমা থাকা উচিত! তিনি না জেনে কেন এটা বলবেন যে, বিএনপি এটা করেছে? প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আমরা আস্থা রাখতে চাই। নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় তিনি কী বিচার করেন, দেখতে চাই।
৩ মে বিকেল ৫টায় মানিক মিয়া এভিনিউর সামনে সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা গুম, খুন অপহরণের প্রতিবাদ করার জন্য সমবেত হন। কিন্তু পুলিশ সমাবেশের জন্য আনা মাইক ও অটোচালককে আটক করে নিয়ে যায়। সমাবেশের ব্যানার, ফেস্টুন ও লিফলেট কেড়ে নেয়। পরে পুলিশের নিষেধাজ্ঞা উপো করে মানিক মিয়া এভিনিউর সামনে কথা বলেন সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা। টিআইবির চেয়ারপারসন, আইন ও সালিস কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, ‘সারা দেশে গুম, অপহরণ, হত্যা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন, শঙ্কিত। আমাদের শেষ মৌলিক অধিকারটুকুও সঙ্কুচিত হতে চলেছে। এটা হতে পারে না।’
৩ মে রাতে কাউন্সিলর নজরুলসহ সাত অপহরণ ও হত্যা মামলায় এজাহারভুক্ত সন্দেহভাজন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের আরেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি নূর হোসেনের বাড়িতে একটানা ৬ ঘণ্টা অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। রক্তের দাগসহ একটি মাইক্রোবাস উদ্ধার হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। ৪ মে নেতাকর্মীদের নামে ‘মিথ্যা’ মামলা, গুম-খুন ও ‘আওয়ামী সন্ত্রাসী হামলার’ প্রতিবাদে গণ-অনশন কর্মসূচি পালনের সময় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর বললেন : ঘটনার পর এত দিন হয়ে গেলেও অভিযান হয়নি; জনগণ যখন ফুঁসছে, তখন দৃষ্টি ভিন্ন খাতে ফেরানোর জন্য এ ধরনের আইওয়াশ করা হচ্ছে।
৪ মে নারায়ণগঞ্জও ফুঁসে উঠেছিল। নজিরবিহীন হরতাল পালন করল নগরবাসী, তবে মহাসড়কে আন্তঃজেলা পরিবহন বন্ধ করেনি। ইতোমধ্যে স্থানীয় পাবলিক আর পুলিশের সন্দেহের তীর হুকুমের আসামি হিসেবে প্রত্যভাবে ধাবিত হয়েছে কাউন্সিলর নজরুলের এলাকা সিদ্ধিরগঞ্জের অপর কাউন্সিলর ও মাফিয়া আধিপত্যের প্রতিদ্বন্দ্বী নূর হোসেনের দিকে। হরতালের সময় ‘নজরুলের লোকজন’ নূর হোসেনের ‘অবৈধ দখলকৃত’ সাবেক বিএনপি সংসদ সদস্য গিয়াসউদ্দিনের বেদখল বদরউদ্দিন সুপার মার্কেটে হানা দিয়ে ‘নূর হোসেনের আস্তানা’ ভাঙচুর করে। হরতালের সমর্থনে এক পথসভায় সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে বলেছে, ‘একদিন আসবে, নিহতদের সন্তানদের মতো আপনার সন্তানেরাও কাঁদবে।’
তবে মিডিয়ায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছেন নিহত নজরুলের শ্বশুর, সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম। হরতালের দিন দুপুরে নারায়ণগঞ্জ রাইফেলস কাবে গণমাধ্যমের কাছে তিনি বলেন : নূর হোসেনের টাকা নিয়ে নজরুলকে হত্যা করেছে র্যাব। মাহমুদুর রহমান মান্না লিখলেন, শহিদুল ইসলাম র্যাব ১১-কে এ ঘটনার জন্য দায়ী করলেন সাংবাদিকদের সামনে। বললেন, এলাকার লোকজন দেখেছে, র্যাব ১১-এর গাড়ি ওখানে দীর্ঘণ ছিল, যে গাড়িতে করে তাদের উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। মেয়ের কষ্টে হোক কিংবা নিজের কষ্টে হোক, সাহস করে শহিদুল ইসলাম যদি এসব কথা না বলতেন, তবে কি এগুলো সামনে আসত? সাংবাদিকেরা তো বের করতে পারেননি কিছু। আরো ভয়াবহ তথ্য তিনি দিয়েছেন আমাদের। বলেছেন, এই অমানবিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে ছয় কোটি টাকার চুক্তিতে এবং র্যাবের সাথে এই চুক্তি সম্পাদনে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেছেন এক মন্ত্রীপুত্র। র্যাব-১১-এর সিইও একই মন্ত্রীর জামাতা। ঘটনার মামলায় প্রধান আসামি নূর হোসেনের সাথে নারায়ণগঞ্জ-৪-এর সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের দেখা হয় ঘটনার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই। তারপর তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। প্রশ্ন করলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বললেন, তিনি আমাদের নজরদারিতেই আছেন। গত ৯ মে দৈনিক আমাদের সময় প্রকাশ করেছে, নারায়ণগঞ্জের সাত অপহরণ-খুনের প্রধান আসামি নূর হোসেন ঘটনার পর চার দিন মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার পুত্র দীপু চৌধুরীর আশ্রয়ে ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। দীপু চৌধুরী তাকে উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টরের একটি বাসায় রেখেছিলেন। এর পরই গ্রেফতার এড়াতে নূর হোসেন অন্যত্র চলে যান। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যে বললেন, সব কিছু তাদের নজরদারির মধ্যেই আছে, সে কথা এখন কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
৫ মে র্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগের কথা বিচারপতি মো: রেজাউল হক ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চের নজরে আনার পর স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আদালত একটি নিরপে তদন্ত কমিটি গঠন করে সাত দিনের মধ্যে কাজ শুরু করার নির্দেশ দেন, যার নেতৃত্বে থাকবেন জনপ্রশাসনের একজন অতিরিক্ত সচিব এবং সদস্য হিসেবে জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়ের দু’জন করে থাকবেন। র্যাবের বিরুদ্ধে যেহেতু অভিযোগ উঠেছে, তাই মামলার তদন্তে এই বাহিনীকে সম্পৃক্ত না করতে বলেছেন আদালত। তদন্ত কমিটি হয়েছে ঠিকই, গণশুনানিও শুরু হয়েছে, কিন্তু দেখা যাচ্ছে পাবলিকের আস্থা নেই, কিংবা ভয় আছে। স্যা দিতে নিহতদের স্বজন ছাড়া তেমন কেউ এগিয়ে আসছেন না।
সাত গুম খুনে র্যাবের সম্পৃক্ততার অভিযোগের জেরে ৬ মে র্যাব-১১-এর সিইও লে. কর্নেল তারেক সাঈদসহ তিন সামরিক কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করে আগাম অবসরে পাঠানো হয়। সেনাবাহিনীর পর্যবেণে সেনানিবাসের লগ এরিয়ায় তাদের নজরবন্দী রাখা হয় এবং অস্ত্রসহ তাদের মোবাইল ফোন ইত্যাদি জব্দ করা হয়েছে। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী তাদের নিজস্ব তদন্তও শুরু করেছে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে। এ দিকে হাইকোর্টে একটি রিট মামলা করে বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের বেঞ্চ থেকে ড. কামাল হোসেন ১১ মে এক আদেশ জারি করিয়েছেন, যাতে পুলিশ মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) র্যাবের অবসরে পাঠানো তিন কর্মকর্তাকে অবিলম্বে গ্রেফতারে প্রয়োজনীয় পদপে নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি বা বিশেষ কোনো আইনের সুনির্দিষ্ট ধারায় অভিযোগ আনা সম্ভব না হলে ৫৪ ধারায় তথা সন্দেহজনক গতিবিধির জন্য তাদের গ্রেফতার করতে বলা হয়েছে। হাইকোর্টের এই আদেশ সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আদালতের রায় হাতে পাওয়ার পর আইনসম্মত ব্যবস্থা নেয়া হবে। তদন্ত চলাকালে হাইকোর্টে রিট করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত, তা বিবেচনার দাবি রাখে। রিটকারীর কাছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকলে তা তদন্ত কমিটির কাছে দিতে পারতেন।’
১১ মে একই দিনে হুকুমের আসামিসহ অন্যান্য সন্দেহভাজন ও আলামতের তদন্ত সম্পর্কে নারায়ণগঞ্জের নয়া পুলিশ সুপার সংবাদ সম্মেলন করেছেন। ২৭ এপ্রিল কাউন্সিলর নজরুলসহ সাতজনকে অপহরণের পর নারায়ণগঞ্জের তৎকালীন পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলামকে বদলি করা হয়। তিন দিন পর লাশ উদ্ধারের পর নরসিংদী থেকে নারায়ণগঞ্জে নয়া পুলিশ সুপার হিসেবে আসেন ড. মহিদ উদ্দিন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, আসামিদের গ্রেফতারে আরো সময় লাগবে। ঘটনার পর ১২-১৩ দিন বেশি সময় নয়। এ হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি নূর হোসেন দেশের বাইরে পালিয়ে গেছেন বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো কোনো সূত্র জানালেও পুলিশের কাছে কোনো তথ্য নেই। চাকরিচ্যুত সামরিক বাহিনীর তিন কর্মকর্তাকে গ্রেফতারের বিষয়ে হাইকোর্টের দেয়া নির্দেশনা অনুযায়ী পুলিশ কাজ করবে।’
আড়ালে জেলা পুলিশের বিদায়ী বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আশঙ্কা প্রকাশ করেন, হত্যাকাণ্ডটি নিয়ে অতিমাত্রায় রাজনীতিকরণ এবং ‘একপথে’ চলমান তদন্তে নেপথ্যের অনেক ইন্ধনদাতাই রা পেয়ে যেতে পারে। দৃশ্যমান অনেক তদন্তই ‘আইওয়াশ’ আবার অদৃশ্যমান অনেক তদন্তই দৃশ্যমান না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। র্যাবের অভিযুক্ত তিন কর্মকর্তার কাছ থেকে তথ্য পাওয়া কঠিন হতে পারে। ওই র্যাব কর্মকর্তাদের তথ্য গোপন করার মতো যথেষ্ট কৌশল জানা আছে।
অন্য দিকে, পত্রিকায় একই দিনে একান্ত সাাৎকার দিয়েছেন র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান। বলেছেন, নারায়ণগঞ্জের সাত অপহরণ ও খুনের প্রধান আসামি নূর হোসেন কলকাতায় অবস্থান করছে। ঘটনার তিন দিন পর সে ভারতে পালিয়ে গেছে। তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। তাকে গ্রেফতার করতে পারলেই সব রহস্য উন্মোচিত হবে। অপহরণের পরপরই স্থানীয় এমপি তাকে ফোন করে সাতজনের অপহরণের বিষয়ে জানিয়েছিলেন। তাৎণিকভাবে তিনি র্যাব-১১-এর জবাবদিহি তলব করলে তারা বলেছে, কাউকে তারা গ্রেফতার বা আটক করেনি। এখনো র্যাবের আটকের বিষয়ে তেমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে দাবি করেন কর্নেল জিয়া। আরো বলেন, আমরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও পেয়েছি। নিহত নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদ চেয়ারম্যান যে র্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন, তিনিও ঘটনার সাথে জড়িত কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কারণ মাত্র ছয় মাস আগেও শহীদ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে জিডি করেছিলেন নজরুল। পরদিন শহিদুল ইসলাম চেয়ারম্যান একই পত্রিকায় পাল্টা জবাব দিয়ে বলেছেন : ফেরারি আসামি নূর হোসেনকে কলকাতায় পালিয়ে যেতে সহায়তা করেছেন খোদ র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান।
এরই মধ্যে ৯ মে ইউরোপ দিবসে নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম হানা। একই সাথে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ফের সংলাপের আহ্বান জানান তিনি। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ভারপ্রাপ্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার নিক ল সম্প্রতি অপহৃত সুনামগঞ্জের বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক মুজিবুর রহমান মুজিবকে উদ্ধার করে ফেরত দেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
সুশীলসমাজের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে বিরোধী জোটনেত্রী খালেদা জিয়া র্যাব বিলুপ্তির দাবি তুললেন। সরকারের মন্ত্রীরা পাল্টা আওয়াজ তুললেন : র্যাব নিয়ে রাজনীতি করবেন না। র্যাব নিয়ে যারা রাজনীতি করে তারা জঙ্গিবাদের দোসর। নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় বিএনপি ও সুশীলসমাজ তদন্ত বাধাগ্রস্ত করছে; দেশকে অস্থিতিশীল করার রাজনীতি শুরু করেছে।
টকশোতে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. তুহিন মালিক বললেন : বর্তমান রাজনীতিতে আমাদের নৈতিক অবস্থা হলোÑ ‘যখন আমার সঙ্গে থাকে সঙ্গী, বিরুদ্ধে গেলে জঙ্গি। আমার বিরুদ্ধে থাকলে কসাই, আমার পে থাকলে বিয়াই।’ বর্তমান রাজনীতিতে নিজের জন্য আল-ফায়দা আর অন্যের জন্য আল-কায়েদা। প্রধানমন্ত্রী নিজেই কয়েকবার বলেছেন, দেশ চলছে মদিনা সনদে। আবার বলছেন, মা দুর্গা গর্জে চলে এসে ঘরে ঘরে ফসল দিচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের শীতল্যা নদীতে নিজের দলের লোক ভেসেছে বলে এত কথা, কিন্তু মার্চ মাসে মেঘনা নদীতে ১৯ লাশ ভেসেছে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় এবং লাশগুলোর প্রতিটি ছিল বিরোধী দলের। আওয়ামী লীগের কথা ছিল জনগণকে শান্তির ঘুম উপহার দেবে, এখন দিচ্ছে আতঙ্কের গুম। আওয়ামী লীগ ফের বাকশাল হয়ে গেছে; তাকে যতই গণতন্ত্র শেখান আর গণতন্ত্র হবে না।
মিডিয়ায় হুঁশিয়ারি এসেছে, নারায়ণগঞ্জে সেভেন মার্ডারসহ সারা দেশে গুম, খুনের ঘটনায় মানবাধিকার পরিস্থিতি প্রশ্নবিদ্ধ; বিদেশী উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্রগুলো আবারো ‘পর্যবেণ’ খাতায় রেখেছে বাংলাদেশকে। গুম ও খুনের তালিকা বিদেশী কূটনীতিকদের হাতে দিয়ে বিএনপির ধরনার ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো দেশ প্রকাশ্যে বলছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে তারা সরব থাকবে।
মাহমুদুর রহমান মান্না লিখেছেন : নূর হোসেন নারায়ণগঞ্জের মাদক সাম্রাজ্যের অধীশ্বর। ১১টি অস্ত্রের লাইসেন্স ছিল তার ও তার সহযোগীদের। সহযোগীদের মধ্যে যারা অস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছিলেন, তাদের কেউ ছিলেন পেশায় ট্রাকচালক বা হেলপার। প্রশ্ন উঠেছে, তারা অস্ত্রের লাইসেন্স পেলেন কিভাবে? ১০ মে বাংলাদেশ প্রতিদিন তার প্রথম পাতায় নারায়ণগঞ্জের সাবেক ডিসি মনোজ কান্তি বড়ালের সাথে নূর হোসেনের একটি ছবি ছেপেছে। লিখেছে, নূর হোসেন চলতেন ডিসি-এসপির সাথে এবং এ সখ্য থেকেই ১১ অস্ত্রের লাইসেন্স। ১০ মে বাংলাদেশ প্রতিদিন লিখেছে, বাবার মাদক স্পট থেকে ফেনসিডিল সেবনে মাদকাসক্ত হয়েই গত বছর পারিবারিক কলহে অভিমানে আত্মহত্যা করেছে নূর হোসেনের ছেলে বিপ্লব হোসেন। বিপ্লবকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে নূর হোসেন নিজেই, এ রকম অভিযোগ ছিল সিদ্ধিরগঞ্জের সর্বত্র। মৃত্যুর পর বিপ্লবের লাশ নূর হোসেনের নির্দেশে ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করা হয়। ছেলের নামাজে জানাজায় ছিলেন ২০০ থেকে ৩০০ আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর সদস্য, যাতে লাশ নিয়ে কোনো কথা না ওঠে।
‘কী করে একজন ট্রাকের হেলপার (নূর হোসেন) প্রথমে জাতীয় পার্টি, এরপর বিএনপি এবং অতঃপর আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে অপরাধ জগতের ডন হয়ে গেলেন, সে কথা এখন সারা দেশের মানুষের জানা। এসব কি রাজনৈতিক দলের নেতারা জানতেন না? জাতীয় পার্টি, বিএনপি ও আওয়ামী লীগÑ তারাই তো পেলেপুষে তাকে বড় করেছে, ছায়া দিয়েছে। সে ছায়া দেখেই র্যাব, পুলিশ, প্রশাসন তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। দোষ আলাদা করে র্যাব, পুলিশ কিংবা প্রশাসনের নয়; দোষ রাজনীতির। দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন