রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় গত চার মাসে তিন শতাধিক বিষধর সাপ উদ্ধার করা হয়েছে। নগরের বনশ্রী, আফতাবনগর, উত্তরা, খিলগাঁও, মিরপুরসহ একাধিক এলাকায় বাসা, গ্যারেজ এমনকি বহুতল ভবনের ফ্ল্যাট থেকেও এসব সাপ ধরা পড়েছে।
ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে বাংলাদেশ অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন নামের একটি সংস্থা গত চার মাসে ৩৫১টি সাপ উদ্ধার করেছে।
বাংলাদেশ অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, এর মধ্যে মাত্র তিনটি নির্বিষ, বাকিগুলো বিষধর। উদ্ধার হওয়া সাপগুলোর মধ্যে পদ্মগোখরা, রাসেল ভাইপার, খৈয়া গোখরা ও রাজ কেউটের মতো মারাত্মক প্রজাতির সাপ উদ্ধার করা হয়েছে।
বাংলাদেশে বর্ষাকালে সাধারণত সাপ বেশি দেখা যায়। কারণ সাপ আবাসস্থল হিসেবে যেসব গর্ত তৈরি করে তাতে বৃষ্টির পানি ঢুকে পড়লে সে আশ্রয়ের জন্য শুকনো স্থানের সন্ধানে উঁচু স্থান ও মানুষের বসতি বা ঘরে ঢুকে পড়ে।
কিন্তু ঢাকার মতো জনবহুল এলাকায় এ ধরনের বিষধর সাপ পাওয়ায় গবেষকদের কেউ কেউ বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। আবার কোনো কোনো গবেষক বিষয়টি স্বাভাবিক বলেই মনে করছেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ আহসান বিষয়টি ‘আনইউজুয়াল এবং চিন্তার’ বলে উল্লেখ করেছেন।
তিনি বলেন, ‘এটা আনইউজুয়াল তো বটেই। সাপ থাকতে পারে ঢাকা শহরে যদি ঝোপঝাড় থাকে। কিন্তু এতো সাপ কি করে হলো এটা তো চিন্তার বিষয়।’
বাংলাদেশ অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক আদনান আজাদ বলেন, সবচেয়ে বেশি সাপ উদ্ধার হয়েছে উত্তরার ১৮ নম্বর সেক্টরের রাজউক ফ্ল্যাট এলাকায়। এরপর বনশ্রী, খিলগাঁও ও আফতাবনগরে সাপের উপস্থিতি বেশি পাওয়া গেছে।
তিনি বলেন, ‘উত্তরার রাজউক ফ্ল্যাট এলাকার ১১টি ভবন থেকে সাপ উদ্ধার করেছি। ভবনের ৭ তলা, ৯ তলা থেকেও সাপ পাওয়া গেছে।’
এতো উঁচু ভবনে কীভাবে সাপ গেলে জানতে চাইলে আদনান আজাদ বলেন, যেসব ভবনের উপরের ফ্ল্যাটে সাপ পাওয়া গেছে সেগুলোর প্রতিটি ভবনের গেটের সাথে বাগান বিলাসের মতো লতানো গাছ রয়েছে। সেই গাছগুলো বেয়ে উপরে ওঠার জন্য ব্যবস্থা রয়েছে। সেখান থেকেই হয়তো সাপ বেয়ে উঁচু ভবনে উঠেছে।
আদনান আজাদ বলেন, শুধু খিলগাঁওয়ের একটি বাসা থেকেই সম্প্রতি ৩৮টি পদ্মগোখরা সাপ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ছিল বড় সাপ, বাচ্চা ও ডিম।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকায় হঠাৎ সাপের উপদ্রব বাড়ার পেছনে মূল কারণ পরিবেশগত পরিবর্তন।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ভেনোম রিসার্চ সেন্টারের রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট মো. মিজানুর রহমান অবশ্য মনে করেন, জলাশয় ও খাল-বিল ভরাট করে মানুষ বাসস্থান তৈরি করায় সাপের বাসস্থান সংকট তৈরি হয়েছে। তাই সাপ মানুষের বাসায় ঢুকে পড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, বর্ষাকালে বৃষ্টির কারণে গর্তে পানি ঢুকে গেলে সাপ শুকনো আশ্রয়ের খোঁজে বাসাবাড়িতে চলে আসে। আবার আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত তাদের প্রজননকাল হওয়ায় এই সময় সাপের সংখ্যা বেশি দেখা যায়।
উদ্ধার হওয়া সাপগুলোর মধ্যে প্রায় দুই শতাধিকই পদ্মগোখরা প্রজাতির।
আদনান আজাদ বলেন, ‘অক্টোবর-নভেম্বর পদ্মগোখরার প্রজননকাল। এই সময় একেক বাসা থেকেই এক ডজনের বেশি বাচ্চা সাপ উদ্ধার করছি।’
তিনি আরও জানান, ‘আগস্টে খৈয়া গোখরার প্রজননকাল ছিল। তখন এক বাসা থেকেই মা সাপসহ ২৭টি বাচ্চা উদ্ধার করেছিলাম।’
তবে বন বিভাগের ওয়াইল্ডলাইফ ক্রাইম কন্ট্রোল ইউনিটের ইন্সপেক্টর আব্দুল্লাহ আস সাদিক বলেন, ‘ঢাকায় সাপের উপদ্রবের কোনো আনুষ্ঠানিক তথ্য আমাদের কাছে নেই। উদ্ধার কার্যক্রম চালাতে সংগঠনটি কোনো অনুমতিও নেয়নি।’
অন্যদিকে বাংলাদেশ অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন জানায়, উদ্ধার করা সাপগুলো ঢাকার বাইরে বনাঞ্চল বা প্রাকৃতিক পরিবেশে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং প্রতিটি অভিযানের বিষয়ে বন বিভাগকে অবহিত করা হয়।
যদিও চার মাসে সাড়ে তিন শতাধিক সাপ উদ্ধার করা হয়েছে, তবু সাপের কামড়ে মানুষের ক্ষতির ঘটনা তেমন দেখা যায়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, সাপের উপদ্রব মূলত পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার ইঙ্গিত— মানুষের দখলে সাপের প্রাকৃতিক বাসস্থান কমে গেছে।
সূত্র : বিবিসি বাংলা