
সামনের পথ কঠিন এবং অনেক চ্যালেঞ্জ এখনো বিদ্যমান বিশেষত নির্বাচনের পূর্ববর্তী রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা এবং বিচার প্রক্রিয়ার দ্রুততা- তবুও এই এক বছরে জাতি বুঝে গেছে : মুক্তি শুধু শাসক পরিবর্তনে নয়; বরং কাঠামোগত রূপান্তরের মধ্যেই নিহিত। এক বছরের মাথায় বলা যায়, জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে একটি নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা হলেও এই সরকার এখনো অন্তর্বর্তী, এখনো তার পরীক্ষার সময়। তবে স্বচ্ছতা, জনগণের অংশগ্রহণ ও গণতান্ত্রিক সংস্কারের ধারাবাহিকতা যদি বজায় থাকে- তবে ২০২৬ সালের ‘জনগণের সংবিধান’ ও নতুন সরকার গঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি দীর্ঘমেয়াদি বিকল্প রাষ্ট্রগঠনের পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হতে পারে।
২০২৪ সালের ‘জুলাই বিপ্লব’ ছিল বাংলাদেশের সমসাময়িক ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। শেখ হাসিনার দীর্ঘকালীন কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান এবং একটি অন্তর্বর্তী ‘গণমুক্তি সরকারের’ অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করে। গত এক বছরে এই সরকার বিভিন্ন খাতে সংস্কার, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, আর্থিক স্বচ্ছতা ও কৌশলগত স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
এক বছর আগে ৪ আগস্ট বিপ্লব-পরবর্তী পরিস্থিতিতে সংবিধানিক ধারাবাহিকতা ভেঙে পড়ে। জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ ও নির্বাচন কমিশন প্রায় অচল হয়ে পড়ে। এই প্রেক্ষাপটে গণ-অভ্যুত্থান সমন্বয় কমিটির প্রস্তাবে একগুচ্ছ বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক নেতৃত্ব নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস হন প্রধান উপদেষ্টা। সংবিধানের ৭ ও ১১ অনুচ্ছেদকে ভিত্তি করে ‘জনতার পূর্ণ ক্ষমতা’র রেফারেন্স দিয়ে এই সরকার গঠিত হয়।
রাজনৈতিক সংস্কার ও অন্তর্বর্তী শাসনকাঠামো
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার মূলত একটি ‘জন অংশগ্রহণমূলক প্রশাসনিক কাঠামো’ গড়ে তোলে। সর্বদলীয় প্রতিনিধি, নাগরিক সমাজ, ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি এবং বিচারপতি ও বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে গঠিত ‘জাতীয় রূপান্তর কমিশন’ এ সময় সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। সাবেক সরকারের দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিক, আমলা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। ‘ট্রাইব্যুনালে’র আওতায় মানবতাবিরোধী অপরাধ, অর্থ পাচার ও রাজনৈতিক হত্যা মামলার বিচার শুরু হয়েছে- যেখানে ৩৫ জুলাই হত্যাকাণ্ড এবং র্যাব-পুলিশের গুম-খুন ছিল অন্যতম প্রাধান্যপ্রাপ্ত।
এই এক বছরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পদক্ষেপ ছিল ‘নতুন সংবিধান প্রণয়ন কমিশন’ গঠন। ছয়টি প্রধান সংস্কার কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দল ও অন্য স্টেকহোল্ডারদের সাথে বৈঠক করে জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদের খসড়া চূড়ান্ত রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে হস্তান্তর করেছে।
প্রথম ধাপে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের খসড়ার ১৬৬টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে ৬২টি বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো সার্বিকভাবে একমত হয়েছে। ৩০ জুলাই রাতে কমিশন এই খসড়া দলগুলোর কাছে পাঠিয়েছে, যা জুলাই সনদ হিসেবে প্রতিপন্ন হবে। এর প্রধান প্রস্তাবের বিষয়বস্তুর মধ্যে রয়েছে সংবিধান সংশোধন, আইনসভা ও স্থানীয় সরকারকাঠামো, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, নির্বাচন ও বিচার ব্যবস্থা, দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপ ইত্যাদি। দ্বিতীয়পর্যায়ে আরো বিষয়ে ঐকমত্যের বিষয়ের মধ্যে রয়েছে, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন, সদস্যদের যোগ্যতা, মাতৃভাষা ও নাগরিক পরিচয় নির্ধারণ, স্থানীয় সরকারের স্বায়ত্তশাসন, জাতীয় সমন্বয় কাউন্সিল, উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়া, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ, প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা ইত্যাদি।
প্রধান সিদ্ধান্তে একমত হওয়া বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে, স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন : পেশাদারিত্ব ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে আলাদা পুলিশ ওভারসাই বডি গঠন প্রভৃতি। প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল এক ব্যক্তির সর্বোচ্চ ১০ বছরে সীমিত করার বিষয়ে সব দল একমত হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি নির্ধারণ : ‘সাম্য’, ‘মানবিক মর্যাদা’, ‘সামাজিক সুবিচার’, ‘গণতন্ত্র’ ও ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি’ যুক্ত করার প্রস্তাব এসেছে; আটটির মতো বিষয়ে সামগ্রিক ঐকমত্য হয়েছে, কিন্তু এ আটটি বিষয়ের প্রস্তাবের বিপক্ষে লিখিত নোট জমা দিয়েছে বিএনপি।
অর্থনৈতিক সংস্কার ও স্বনির্ভরতার পথ
ব্যাংকিং খাতে নজিরবিহীন লুটপাট ও দুর্নীতির অভিযোগে বাংলাদেশ ব্যাংকের পুরনো বোর্ড বাতিল করা হয়। আর্থিক সংস্কার কমিশনের নেতৃত্বে আর্থিক খাতের ডিজিটাল অবকাঠামো পুনর্গঠন চলছে। একইভাবে, বিইআরসি, পেট্রোবাংলা, পিআইডি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ একাধিক সংস্থা ও বিভাগে তদন্ত-পরবর্তী ব্যাপক পুনর্বিন্যাস হয়েছে। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের ঋণনির্ভর নীতির বাইরে গিয়ে সরকার বিকল্প অর্থনৈতিক জোটে (ব্রিকস প্লাস, বিমসটেক অর্থনৈতিক ফোরাম) সক্রিয়তা বাড়ায়। চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ উদ্যোগের সাথে নয়া শর্তসাপেক্ষে পুনঃসংলাপ শুরু হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরে আইসিটি ও লেনদেনভিত্তিক সিন্ডিকেটের অপতৎপরতা উন্মোচন করে বেশ কিছু শীর্ষ কর্মকর্তা বরখাস্ত ও অভিযুক্ত হন। আরটিজিএস ও সুইফট ব্যবস্থার প্রভাবমুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করতে নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তোলা হয়। বিপ্লবোত্তর সরকার শ্রমিকবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন করে রফতানিমুখী শিল্পের সঙ্কট নিরসনে নানা উদ্যোগ নেয়। কৃষি ও কুটিরশিল্পে পুনঃবিনিয়োগ শুরু হয়।
বড় অর্জনের একটি হচ্ছে, ‘জাতীয় রাজস্ব কাঠামো সংস্কার’, যেখানে অপ্রয়োজনীয় ভ্যাট এবং মধ্যবিত্তের ওপর অতিরিক্ত চাপ কমিয়ে মাল্টিন্যাশনাল ও করপোরেট গ্রুপগুলোর ওপর নতুন ‘উৎপত্তিস্থলভিত্তিক কর’ প্রবর্তন হয়েছে। এনবিআর পুনর্গঠন করে একটি স্বশাসিত ‘রাজস্ব অধিদফতর’ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। জমি কর মওকুফ, কৃষিঋণের সুদ মওকুফ এবং পল্লী উৎপাদনকেন্দ্রিক বাজার কাঠামো গড়ার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার জন্য সরকারি ক্রয়মূল্য নীতিতে সংস্কার হয়েছে।
ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা
২০২৪ সালের গণবিক্ষোভ দমনকালে সেনা-পুলিশের গুলিতে দেড় হাজার জন নিহত হওয়ার ঘটনার বিচারের দাবি জোরালোভাবে উঠে আসে। গণহত্যা ট্রাইব্যুনাল গঠন করে ১৭টি পৃথক হত্যাকাণ্ডের তদন্ত শুরু হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি, র্যাবের ডিজি এবং কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়েছে। জনসাক্ষ্য গ্রহণ, ভিডিও প্রমাণ ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম চলছে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর এক বছরে মুক্তি পেয়েছেন প্রায় আট হাজার রাজনৈতিক বন্দী, যারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ বিভিন্ন আইনে আটক ছিলেন। গঠিত হয়েছে ‘সত্য-উদ্ঘাটন কমিশন’, যা ২০০৯-২৪ সময়কালের রাজনৈতিক নিপীড়ন, গুম ও জেল-জুলুমের প্রামাণ্য দলিল প্রস্তুত করছে। বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করে একটি স্বাধীন বিচার কমিশন গঠন করা হয়। রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি, গুমের তদন্ত কমিশন ও পুলিশি নির্যাতন প্রতিরোধে ‘জননিরীক্ষা প্রক্রিয়া’ চালু করা হয়। তবে এখনো হয়রানিমূলক অনেক মামলা রয়ে গেছে।
২০২৫ সালের মার্চে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে প্রথম সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়েছে। এক বছরের মধ্যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অন্তত তিনটি মামলায় সরাসরি আদালতে অভিযোগ গঠন হয়েছে, যা জবাবদিহিমূলক বিচারব্যবস্থার পথে একটি বড় পদক্ষেপ।
শিক্ষা ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে পরিবর্তন
ছাত্রদের সূচিত আন্দোলনে স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি সরকারের বিশেষ দৃষ্টি থাকে। বিশেষ উদ্যোগে ঢাকা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকার অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবাস নির্মাণের জন্য জরুরি প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়। সাম্প্রতিক সাহিত্য উৎসব, ভাষা দিবস ও মুক্তচিন্তা উৎসবগুলোতেও স্পষ্টভাবে বাকস্বাধীনতার নবজাগরণ দেখা যায়।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কমিটি গঠন করে শিক্ষায় ভর্তিকেন্দ্রিক দুর্নীতির অবসান ঘটানো হয়েছে। পাঠ্যক্রম থেকে সাম্প্রদায়িক ও বাজারমুখী চিন্তার প্রচার বাদ দিয়ে একাধিক প্রতিষ্ঠানিক সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে ‘মুক্ত তথ্য আইন’ পাস হয়েছে। রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমকে স্বায়ত্তশাসিত করা হয়েছে। বেসরকারি টেলিভিশন ও অনলাইন মিডিয়া পর্যবেক্ষণে স্বাধীন সম্প্রচার কমিশন গঠন হয়েছে। ফেসবুক, ইউটিউবসহ প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্মে সরকারের নিয়ন্ত্রণ নয়; বরং গণতান্ত্রিক জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় ‘সোশ্যাল মিডিয়া আদালত’ পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়েছে।
কূটনৈতিক ভারসাম্য ও পানিসম্পদ কৌশল
অন্তর্বর্তী সরকার প্রথম থেকেই ‘ভারসাম্যভিত্তিক বহুপক্ষীয় কূটনীতি’র কথা বলে আসছে। এশিয়ার দুই বৃহৎ শক্তি ভারত-চীনের মধ্যে কৌশলগত ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার দিকে নজর দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। চীনের সাথে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর পাশাপাশি ভারতীয় আধিপত্যবাদী নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে তিস্তা ও ফারাক্কা চুক্তি পুনর্নবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
সেই সাথে সরকার নতুন করে তিস্তা ও ফারাক্কা পানিবণ্টন চুক্তির আলোচনায় আন্তঃআঞ্চলিক ফোরামের মাধ্যমে সক্রিয় হয়েছে। ‘আঞ্চলিক পানিসম্পদ অধিকার কমিশন’ গঠনের প্রস্তাব আঞ্চলিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। বিআইএল, এশিয়ান রিভার কমিশন ও রিজিওনাল ট্রানজিট রিভিউ প্রোগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশ আঞ্চলিক ট্রানজিট ও পানিবণ্টনে স্বার্থ সুরক্ষার নতুন কাঠামো তৈরি করছে।
জাতিসঙ্ঘে একটি বিশেষ অধিবেশনে বাংলাদেশ গণ-অভ্যুত্থানের সফলতা তুলে ধরে ‘ডেমোক্র্যাটিক ট্রানজিশন মডেল’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এতে আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার কয়েকটি দেশ বাংলাদেশকে অনুসরণযোগ্য দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করে।
মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক রূপান্তরের অগ্রগতির কারণে এক বছরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের ওপর থেকে বেশির ভাগ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছে। ত্রিপক্ষীয় বিনিয়োগ বোর্ড গঠনের মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশী, প্রবাসী রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সরাসরি চুক্তির সুযোগ তৈরি হয়েছে।
নিরাপত্তা খাত পুনর্গঠন
জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী বড় চ্যালেঞ্জ ছিল রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ। ফোর্স সমন্বয় বোর্ড গঠন করে পুলিশ, র্যাব, এনএসআই ও ডিজিএফআইকে গণতান্ত্রিক জবাবদিহির আওতায় আনা হয়েছে। বিতর্কিত ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত অনেক কর্মকর্তা বরখাস্ত হয়েছেন। ‘জননিরাপত্তা ট্রাইব্যুনালে’র মাধ্যমে র্যাব সদস্যদের বিচার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। পুলিশ বাহিনীর গঠনতান্ত্রিক পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে কমিউনিটি পুলিশিং চালু হয়। র্যাবের কর্মকাণ্ডে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় এর ‘সন্ত্রাসবিরোধী অপারেশন ইউনিট’ বিলুপ্ত করা হয়।
বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে পুরনো আগ্রাসী মনোভাব রোধে সীমান্তে যৌথ পর্যবেক্ষণ ও মানবাধিকার নিরীক্ষা চালু হয়। নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন রোধে সীমান্ত হত্যা বন্ধে ভারতকে কঠোর বার্তা দেয়া হয়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কি করেছে
অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরে দীর্ঘদিনের ওষুধ সিন্ডিকেটের আধিপত্য কমাতে অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত কিছু পদক্ষেপ নেয়। ‘জাতীয় ওষুধ নীতিমালা-২০২৫’ প্রণয়ন করা হয়, যেখানে দেশীয় উৎপাদকদের উৎসাহিত করা এবং জীবনরক্ষাকারী ওষুধের সর্বোচ্চ মূল্য নির্ধারণে কঠোর নিয়ম আরোপ করা হয়। ওষুধ প্রশাসনের ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থা চালু হয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যালসহ দেশের ১০টি বড় হাসপাতালে ই-হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা চালু হয়।
রোগীর ডেটা ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণ, ওয়ার্ড পর্যায়ে উপস্থিত ডাক্তারদের মনিটরিং এবং সরকারি ওষুধের সরবরাহ স্বচ্ছ করতে ‘হেলথ অ্যাক্সেস ট্র্যাকার’ চালু করা হয়। নাগরিক ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র, ব্র্যাক স্বাস্থ্য কর্মসূচি এবং ‘স্বাস্থ্য আন্দোলন পরিষদে’র সাথে ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ইউনিয়নপর্যায়ে ১২ হাজার নতুন কমিউনিটি ক্লিনিক সহকারী নিয়োগ। ৪৫টি জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভ্রাম্যমাণ স্বাস্থ্যসেবা ইউনিট চালু, যা দিনে প্রায় ৫০ হাজার মানুষকে সেবা দেয়।
ধর্ম মন্ত্রণালয় : সামাজিক সহনশীলতা ও ধর্মীয় সুরক্ষা
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হলো হজ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও ব্যয় হ্রাস। হজ প্যাকেজ খরচ ২০২৩ সালের তুলনায় গড়ে ২৫ শতাংশ কমানো হয়। ডিজিটাল হজ পোর্টাল চালু করে পাসপোর্ট, টিকা, প্রশিক্ষণ ও যাত্রাসূচি একত্র করা হয়। সৌদি আরবের সাথে সরাসরি চুক্তির ফলে মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। এবার নানা চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও সব হজগমনেচ্ছু হজ পালন করতে পেরেছেন।
কওমি ও সাধারণ শিক্ষার সমন্বয় উদ্যোগের অংশ হিসেবে কওমি মাদরাসায় বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি পাঠক্রম চালুর পাইলট প্রকল্প নেয়া হয়। জেলার মাদরাসায় মিশ্র কারিকুলাম (ধর্মীয়+জেনারেল) পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়। অন্তর্বর্তী সরকার ধর্ম মন্ত্রণালয় সঙ্কট নিরসনের পাশাপাশি কাঠামোগত সংস্কারের দিকে এগিয়েছে। সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় এর প্রভাব সরাসরি প্রতিফলিত হয়েছে।
ধর্মীয় সংখ্যালঘু নিরাপত্তা ও পুনর্গঠনে ধর্ম মন্ত্রণালয় বিশেষ উদ্যোগ নেয়। সনাতন, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসবে সরকারি সহায়তা বৃদ্ধি। ধর্মীয় শান্তি ও সহাবস্থানের সংস্কৃতি নতুনভাবে চর্চা শুরু হয়েছে, যা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা কমাতে সহায়ক হয়েছে।
এক বছর পর, কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ
অন্তর্বর্তী সরকারের অর্জনগুলোর বাইরে সমালোচনার জায়গাও রয়েছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে এখনো কার্যকর নীতিমালা অনুপস্থিত। সিন্ডিকেটবিরোধী অভিযান অনেক জায়গায় রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট বলেও অভিযোগ রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে এখনো কিছু চক্র দুর্নীতিতে সক্রিয়। শিল্প খাতে বিদেশী বিনিয়োগ আশানুরূপ গতি পায়নি। চাঁদাবাজির ওপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ আসেনি। দেড় দশকের লুটপাটের পরও ব্যাংকগুলোকে সরকার সচল রাখতে পেরেছে, কিন্তু কাঠামোগত সংস্কারে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ এখনো নিতে পারেনি। অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে আগের সরকারের রাজনৈতিক সহযোগী ও অলিগার্কদের টাকা পাচারে সহায়তাকারীরা এখনো রয়ে গেছে।
বর্তমান সরকারের ওপর সাধারণ মানুষের তিনটি বড় প্রত্যাশা ছিল। প্রথমত, ফ্যাসিবাদী শাসন যাতে বারবার ফিরে আসতে না পারে তার জন্য শাসন ব্যবস্থায় কার্যকর কিছু পরিবর্তন, যার জন্য সংবিধানে হাত দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। সংবিধান সংশোধনের সাধারণ গ্রহণযোগ্য পথ হলো আইনসভায় তা অনুমোদন করা। কিন্তু বাংলাদেশে অতীতে একাধিক বিপ্লব ও অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আগে পরিবর্তন পরে সংবিধানের সংশোধনী অনুমোদন করা হয়েছে। জনআকাক্সক্ষাকে সবার ওপরে স্থান দেয়া হয় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পরে। এ বিষয়ে সরকারের কোনো জোরালো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
সরকার গণহত্যা ও গুম-খুনকে বিচারের আওতায় আনার পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু এখনো কোনো বিচার শেষ করা সম্ভব হয়নি। জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী এক বছরে সরকার কাঠামোগত পরিবর্তনের পাশাপাশি জনগণের আস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে সাফল্য ও সীমাবদ্ধতা দুটোই রয়েছে। সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো টেকসই ও কার্যকর গণতান্ত্রিক রূপান্তর। যেনতেন একটি নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর দেশের মানুষ চায় বলে মনে হয় না। তারা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে দ্রুত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আশা করে। এখনো আস্থা আনার মতো তেমন পদক্ষেপ অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দৃশ্যমান নয়। ফ্যাসিবাদী সরকারের নির্বাচিত ব্যক্তিকে শীর্ষে রাখা অনেক অনাহত ঝুঁকি নিয়ে আসতে পারে বলে জনগণের মধ্যে ভয়ও রয়েছে।
যদিও সামনের পথ কঠিন এবং অনেক চ্যালেঞ্জ এখনো বিদ্যমান বিশেষত নির্বাচনের পূর্ববর্তী রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা এবং বিচার প্রক্রিয়ার দ্রুততা- তবুও এই এক বছরে জাতি বুঝে গেছে : মুক্তি শুধু শাসক পরিবর্তনে নয়; বরং কাঠামোগত রূপান্তরের মধ্যেই নিহিত। এক বছরের মাথায় বলা যায়, জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে একটি নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা হলেও এই সরকার এখনো অন্তর্বর্তী, এখনো তার পরীক্ষার সময়। তবে স্বচ্ছতা, জনগণের অংশগ্রহণ ও গণতান্ত্রিক সংস্কারের ধারাবাহিকতা যদি বজায় থাকে- তবে ২০২৬ সালের ‘জনগণের সংবিধান’ ও নতুন সরকার গঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি দীর্ঘমেয়াদি বিকল্প রাষ্ট্রগঠনের পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হতে পারে।