
অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা যেন এক মৃত্যুপুরী। যেখানে ইসরায়েলি বাহিনী নির্বিচারে হত্যা করছে অসহায় ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের। বোমাবর্ষণে ধসে যাওয়া ভবনের ধ্বংসস্তূপ থেকে বেরিয়ে, মৃত শিশুদের কোলে তুলে ক্যামেরার সামনে অসহায়ভাবে চিৎকার করছে গাজাবাসী। কিন্তু এমন নৃশংতারপরও কেন আরব প্রতিবেশীরা ইসরায়েলি বোমা হামলা থেকে তাদের রক্ষা করছে না? বিশ্ববাসী শুধু চুপচাপ দেখে যাচ্ছে গাজায় নিরীহ মানুষের করুণ মৃত্যু।
মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) মধ্যপ্রাচ্য ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলীর বিশ্লেষক সাবিনা আহমেদ নিজের ফেসবুকে একাউন্টে তুলে ধরেন নিরীহ গাজাবাসীর আর্তনাত এবং বিশ্ববাসীর অবস্থান সম্পর্কে।
আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করে ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্ন করতে একনায়কতান্ত্রিক অভিযানে নেমেছে ইসরায়েল উল্লেখ করে তিনি বলেন, চোখের সামনে গণহত্যা ঘটছে, একদম চোখের সামনে। ট্রাম্প আর নেতানিয়াহু এখনও বদ্ধপরিকর, গাজায় কোনো ফিলিস্তিনি থাকতে পারবে না। গাজাকে জনশূন্য করবেই করবে। এখানে কোনো আন্তর্জাতিক আইন চলবে না, চলবে কেবল এক পক্ষের জোর-জবরদস্তি।
বর্তমানে ইজরায়েলের প্রায় ৬০-৮০ শতাংশ লোক গাজা পলিসির বিভিন্ন দিক (যেমন সামরিক অপারেশন, ব্লকেড) সমর্থন করে, আর ইজরায়েলি ইহুদিদের মধ্যে এই সমর্থন আরও বেশি (৮০ শতাংশ পর্যন্ত), কিন্তু আরব ইজরায়েলিদের মধ্যে অনেক কম (গাজা শাসনের জন্য ৩-১৬শতাংশ)। নারী আর শিশু হত্যার সমর্থনে মার্চ ২০২৫ সালের একটা পোলে প্রায় ৪৭ শতাংশ ইজরায়েলি ইহুদি বলেছে, জয় করা শহরের সবাইকে মেরে ফেলা ঠিক, ইনক্লুডিং সিভিলিয়ানদের মৃত্যু, উইথ নারী-শিশু। জুন ২০২৫ সালের আরেক পোলে ৬৪ শতাংশ লোক (বেশিরভাগ ইহুদি) ভাবে গাজায় কোনো নিরীহ মানুষ নেই।
‘আল্লাহ যেন ইসরায়েলিদের অন্তরে মোহর মেরে দিয়েছেন,’ মন্তব্য করে বিশ্লেষক সাবিনা আহমেদ বলেন, ‘তারা জেনেবুঝে ত্রাণের ট্রাকগুলোর সামগ্রী নষ্ট করছে, যাতে গাজার মানুষ না খেয়ে আর বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। নেতানিয়াহুর পলিসি অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মার্চ থেকে গাজায় ত্রাণ প্রবেশ প্রায় বন্ধ, মে মাসে কিছু সীমিত ত্রাণ ঢুকলেও তা যথেষ্ট নয়।’
জাতিসংঘ জানিয়েছে, এই ব্লকেডে দুর্ভিক্ষ আরও ভয়াবহ হয়েছে, খাবারের অভাবে হাজারো মানুষ মৃত্যুর মুখে। আমেরিকান প্রাইভেট সিকিউরিটি ফার্মের সাথে নিয়ে ইজরায়েল গাজার দক্ষিণে ত্রাণ সেন্টার খুলেছে, যাতে মরিয়া মানুষ সেখানে জড়ো হয়। কিন্তু ত্রাণ নিতে এলে গুলি করে প্রতিদিন শতাধিক মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে, ইচ্ছাকৃতভাবে। এসবের ভিডিও রেকর্ড আর সাক্ষ্য আছে। তাদের পলিসি হলো, মানুষ যেন কষ্টে ভেঙে পড়ে গাজা ছেড়ে পালায়, আর কোনোদিন ফিরতে না পারে,’— বলেন সাবিনা আহমেদ।
তিনি বলেন, ‘গাজায় এখন দুর্ভিক্ষ চলছে। গত দুই সপ্তাহে খাবারের অভাবে ১০০ জন নারী ও শিশু মারা গেছে। ইউএনের রিপোর্ট বলছে, ২০২৫ সালে খাদ্যের তীব্র সংকটে ৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছে, আর হাজারো শিশু মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে। ইউনিসেফ বলছে, শিশুদের মৃত্যু এখন “মানবতার জন্য কলঙ্ক।’
‘সারা বিশ্বের নামকরা মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, গাজায় গণহত্যা হচ্ছে। গতকাল ইজরায়েলের দুই বড় সংস্থা, বেইটসেলেম আর ফিজিশিয়ান্স ফর হিউম্যান রাইটস ইজরায়েল, বলেছে, ইজরায়েল ইচ্ছাকৃতভাবে গণহত্যা চালাচ্ছে। তারা প্রমাণ দিয়েছে, গাজার হাসপাতাল, বিদ্যুৎ, পানি আর খাদ্য ব্যবস্থা ধ্বংস করা হচ্ছে। অর্থাৎ, চোখের সামনে গণহত্যা হচ্ছে। কিন্তু ইজরায়েল আর তার মুখপাত্ররা এখনও এটা অস্বীকার করছে। আন্তর্জাতিক আইনে গণহত্যায় সহায়তাকারী দেশ ও ব্যক্তিদের শাস্তি ভয়াবহ, আর ইজরায়েলের বিরুদ্ধে আইসিজে-তে মামলা ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। প্রচণ্ড সমালোচনার পর গত দুই দিনে ইজরায়েল কিছু ত্রাণের ট্রাক আর আকাশ থেকে সামগ্রী ফেলার অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু এটা টেম্পোরারি, মানুষ দেখানো নাটক। তারা ততক্ষণ থামবে না, যতক্ষণ না গাজা থেকে সবাইকে উচ্ছেদ করতে পারে।’
‘গাজাকে ঘিরে দুটো প্ল্যান এখন আন্তর্জাতিক মহলে ঘুরছে। একটা হলো ইজিপশিয়ান প্ল্যান। এতে গাজাকে পুনর্নির্মাণ করবে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, মিশর, ফ্রান্সসহ ইইউ দেশগুলো, আর ইউএন ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, মোট ৫৩ বিলিয়ন ডলারের ফান্ডে। গাজার স্কুল, হাসপাতাল, পানির লাইন ঠিক হবে, আর গাজাবাসীকে বাস্তুচ্যুত করতে হবে না।’
‘দ্বিতীয় প্ল্যানটা আমেরিকা-ইজরায়েলের। এতে গাজাকে ধ্বংস করে ছোট এনক্লেভে মানুষকে কেন্দ্রীভূত করা হবে, আর ফিলিস্তিনিদের সিনাই বা অন্য দেশে উচ্ছেদ করা হবে। ট্রাম্পের প্রস্তাবে গাজা ইজরায়েলের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে, আর ফিলিস্তিনিরা চিরতরে বিতাড়িত হবে। যত ডাক্তার গত কয়েক মাসে গাজায় চিকিৎসা দিতে গিয়েছিল, তারা ফিরে এসে বলছে, দুর্ভিক্ষে মানুষ মরছে, বিশেষ করে শিশু আর বৃদ্ধরা। তবু গাজাবাসীরা গাজা ছাড়বে না। তারা অত্যন্ত স্বাভিমানী, নিজেদের সম্মানে বাঁচা মানুষ। গাজার লিটারেসি রেট ৯৯শতাংশ, এমনকি এই ধ্বংসের মধ্যেও তারা শিক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে।’
তিনি আরও জানান, ‘এই সপ্তাহে গাজার পক্ষে একটা বড় খবর এসেছে। জি-৭ গ্রুপের তিনটা দেশ, ফ্রান্স, কানাডা, আর যুক্তরাজ্য, ফিলিস্তিনকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে। আগামী সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে তারা এটা ঘোষণা করবে। তবে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টার্মার বলেছে, ইজরায়েল যদি ওয়েস্ট ব্যাংকে সেটেলমেন্ট আর গাজায় যুদ্ধ বন্ধ না করে, তাহলে তারা টু-স্টেট সলিউশন মেনে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবে।’
এদিকে, ইজরায়েলের কেনেসেট গত সপ্তাহে ওয়েস্ট ব্যাংক দখলের জন্য আইন পাস করেছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত ওয়েস্ট ব্যাংকে ১০০৯ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে, আর ৭০০০-এর বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আইসিজে ২০২৪ সালে বলেছে, ওয়েস্ট ব্যাংক ও পূর্ব জেরুজালেমে ইজরায়েলের উপস্থিতি অবৈধ, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে তাদের সরে যেতে হবে।
নেতানিয়াহু সরকার যে সুযোগ পেয়েছে, পুরো ফিলিস্তিন দখল করতে পিছপা হবে না, আর তাদের পাশে থাকবে আমেরিকা। পুরো ইউরোপ ইজরায়েলের এই গণহত্যার পলিসির বিরুদ্ধে গেলেও, জার্মানি তাদের সাথে থাকবে।
ইজরায়েলিদের গ্রহণযোগ্যতা বিশ্বের সাধারণ মানুষের কাছে মুখ থুবড়ে পড়েছে। তাদের এই জায়নবাদী যুদ্ধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে পুরো বিশ্ব। গ্রিস, জাপান, আয়ারল্যান্ড, স্পেন, মালয়েশিয়া, এমনকি তুরস্ক আর দক্ষিণ আফ্রিকায় সাধারণ মানুষ ইজরায়েলি ট্যুরিস্টদের প্রত্যাখ্যান করছে। এটা সাধারণ ইজরায়েলিদের জন্য ভালো নয়। বিভিন্ন দেশের ডুয়াল ইজরায়েলি নাগরিকরা, যারা গাজায় যুদ্ধে সেনা হিসেবে লড়েছে, ফিরে গেলে তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। সাউথ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডায় এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের তদন্ত চলছে। আইসিসি ইতিমধ্যে নেতানিয়াহুসহ ইজরায়েলি নেতাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে।
বিশ্লেষক সাবিনা আহমেদ বলেন, ইজরায়েল যদি ওয়েস্ট ব্যাংক আর গাজা দখল করে সেটেলমেন্ট গড়ে ফেলে, তবু তাদের ভবিষ্যৎ শান্তিময় হবে না। যারা এই গণহত্যা চালিয়েছে, অবশেষে তারা আমেরিকা আর জার্মানি ছাড়া কোথাও গেলে আইসিসি-র হাতে গ্রেপ্তার হয়ে বিচারের মুখোমুখি হবে। তাদের ট্যুরিস্টদের জন্যও খোলা থাকবে মুষ্টিমেয় কয়েকটা দেশ। তাদের ইজরায়েলেই আটকে থাকতে হবে। যে মাটি তারা দখল করছে, হাজারো নিরীহ নারী, পুরুষ আর শিশুর রক্তে তা রঞ্জিত। সেই মাটিতেই তারা বন্দি হয়ে থাকবে। নিজেদের পাপের ফলেই ইজরায়েল হয়ে উঠবে তাদের জন্য একটা স্বেচ্ছা কারাগার।
লেখক :সাবিনা আহমেদ, মধ্যপ্রাচ্য ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলীর বিশ্লেষক