
মাসুম খলিলী
স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশে ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট (এফপিটিপি) পদ্ধতি অনুসারে নির্বাচন হয়ে আসছে। এ ব্যবস্থা পাকিস্তান এবং তারও আগে ব্রিটিশ আমলে চালু ছিল। বস্তুত বিশ্বের যেসব দেশে ব্রিটিশ উপনিবেশ বা তাদের প্রভাব ছিল সেগুলো স্বাধীন হওয়ার পর নির্বাচন পদ্ধতি হিসাবে ব্রিটিশ ব্যবস্থাই গ্রহণ করে। বাংলাদেশেও সেটাই হয়েছে। অন্য দিকে অনেক গণতান্ত্রিক দেশে আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি চালু রয়েছে। ইউরোপের অধিকাংশ দেশে এই নির্বাচনব্যবস্থাই চালু। দু’টি নির্বাচন ব্যবস্থারই কিছু সীমাবদ্ধতা ও কিছু সুবিধা আছে। এ কারণে উভয় নির্বাচনপদ্ধতি অনুসরণকারী অনেক দেশ তাদের নির্বাচনপদ্ধতি সংস্কার করে দুই ব্যবস্থার সমন্বয়ে একটি মিশ্রব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। মিশ্রব্যবস্থাটিও আবার সব দেশে এক নয়।
কোন দেশে কোন পদ্ধতি
এফপিটিপি : বিশ্বে কয়েকটি দেশে এখনো ভোটে প্রথম হওয়া ব্যক্তি নির্বাচিত হবার ব্যবস্থা পুরোপুরিভাবে ব্যবহৃত হয়। এই পদ্ধতিতে একেকটি নির্বাচনী এলাকার ভোটাররা একজন প্রার্থীকে ভোট দেন, আর যিনি সবচেয়ে বেশি ভোট পান তিনিই বিজয়ী হন, এমনকি সেটা যদি মোট ভোটের ৫০%-এর অনেক কমও হয় তবু তিনি জয়ী বলে ঘোষিত হন। এটি সাধারণত একক সংসদীয় নির্বাচনী এলাকা ব্যবস্থায় প্রয়োগ হয়।
এফপিটিপি পুরোপুরিভাবে চালু থাকা দেশগুলো হলো, যুক্তরাজ্য (হাউজ অব কমন্স নির্বাচনে সম্পূর্ণ), যুক্তরাষ্ট্র (কংগ্রেসের হাউজ ও প্রায় সব রাজ্যে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বাদে), কানাডা (সংসদীয় (ফেডারেল) নির্বাচন সম্পূর্ণ, ভারত (জাতীয় সংসদে পুরোপুরি), বাংলাদেশ (জাতীয় সংসদে পুরোপুরি), নাইজেরিয়া (জাতীয় সংসদে ব্যবহার হয়), ঘানা (সংসদীয় নির্বাচনে সম্পূর্ণ), বাহামা (সংসদ নির্বাচনে) ও সিয়েরা লিওন (এফপিটিপিতে প্রত্যাবর্তন)।
পিআর : আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রাপ্ত মোট ভোটের অনুপাতে সংসদে আসন পায়। এটি সাধারণত বহুদলীয় ও প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রে বিশেষভাবে জনপ্রিয়। বিশ্বজুড়ে পিআর ব্যবস্থা চালু থাকা প্রধান প্রধান দেশ হলো- নেদারল্যান্ডস (ভোটের শতকরা ১% পেলেই আসন পায়), সুইজারল্যান্ড (ক্যান্টনভিত্তিক পিআর; সরাসরি গণভোটেও গুরুত্ব), ফিনল্যান্ড (সংসদের সব আসন পিআরের মাধ্যমে হয়), নরওয়ে (পিআর অঞ্চলভিত্তিক, জাতীয় ভারসাম্যে গুরুত্ব), সুইডেন (জাতীয় ও আঞ্চলিক পিআর মিলিয়ে সুষম প্রতিনিধিত্ব), ডেনমার্ক (বহু ছোট দল সংসদে স্থান পায়), বেলজিয়াম (খণ্ডিত দলীয় প্যাটার্ন), স্পেন (প্রাদেশিক ভিত্তিতে পিআর; বড় দল কিছুটা সুবিধা পায়), পর্তুগাল (পিআর ব্যবস্থায় দলীয় নিয়ন্ত্রণ প্রবল), অস্ট্রিয়া (প্রাদেশিক ও জাতীয় স্তরে পিআর), ইতালি (সময় সময় পদ্ধতিতে পরিবর্তন), গ্রিস (আংশিক পিআর- বিজয়ী দলকে অতিরিক্ত আসন দেয়া হয়), দক্ষিণ আফ্রিকা (জাতীয় তালিকা থেকে আনুপাতিকভাবে এমপি নির্বাচন), ইসরাইল (একক জাতীয় আসন, ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন)।
আঞ্চলিকভাবে পিআর ব্যবস্থার প্রয়োগ হয় : লাতিন আমেরিকার আর্জেন্টিনা, চিলি, উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ে, ইকুয়েডর, কলম্বিয়া। এসব দেশে অঞ্চলভিত্তিক পিআর তালিকা থাকে। ইউরোপ : অধিকাংশ দেশ (ইইউভুক্ত প্রায় সব দেশ) পিআর ব্যবহার করে, ভিন্ন ভিন্ন ভ্যারিয়েন্টে এর ব্যবহার হয়। আফ্রিকা : নামিবিয়া, মোজাম্বিক, অ্যাঙ্গলা, লেসোথো ইত্যাদিতে পিআর চালু রয়েছে। এশিয়া : শ্রীলঙ্কার সংসদে পিআর ব্যবস্থায় ভোট হয়। ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ানে মিশ্রব্যবস্থায় পিআর একটি উপাদান।
মিশ্রপদ্ধতি : বিশ্বে কয়েকটি দেশে আনুপাতিক প্রতিনিধি নির্বাচনপদ্ধতি এবং এফপিটিপি মিশ্ররূপে চালু রয়েছে। এই মিশ্রপদ্ধতির দু’টি সাধারণ রূপের একটি হলো মিশ্র সদস্য আনুপাতিক (এমএমপি) ব্যবস্থা, যেখানে পিআর প্রাধান্য পায়। অন্যটি হলো সমান্তরাল ব্যবস্থা, যেখানে পিআর এবং এফপিটিপি মিশ্র সদস্য আনুপাতিকভাবে থাকে। পিআর প্রাধান্য পায় এমন দেশের মধ্যে জার্মানির সংসদ বানডেসটাগ-এর জন্য ভোটাররা দু’টি ভোট দেয়। এর একটি দেয় একজন প্রার্থীর (এফপিটিপি) পক্ষে, আরেকটি দেয় দলকে (পিআর)। নিউজিল্যান্ডে পিআর ফলাফলই মোট আসনের ভাগ্য নির্ধারণ করে; এফপিটিপি আসন পিআর-এর মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে। স্কটল্যান্ড (যুক্তরাজ্যের অংশ) আঞ্চলিক পিআর আসন দিয়ে ভারসাম্য আনা হয়।
সমান্তরাল ব্যবস্থায় পিআর ও এফপিটিপি উভয় পদ্ধতি আলাদা আলাদা প্রভাব ফেলে। এই ব্যবস্থায় জাপানে নিম্নকক্ষের কিছু আসন এফপিটিপি, কিছু আসন পিআর তালিকা থেকে হয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় ২০২০ সাল থেকে সীমিত পিআর যুক্ত হয়েছে। নেপালে ৬০% এফপিটিপি এবং ৪০% পিআর পদ্ধতিতে দলীয় তালিকা থেকে এমপি হয়, যেখানে সংরক্ষিত গোষ্ঠী বিবেচনা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ভেনিজুয়েলার মিশ্র নির্বাচনী ব্যবস্থায় অনেকবার পরিবর্তন হয়েছে। রাশিয়ায় ৫০% এফপিটিপি এবং ৫০% পিআর ব্যবস্থায় এমপি হন; তবে বাস্তবে এটি কতটা সঠিকভাবে হয় তা নিয়ে বিতর্ক আছে।
অন্য কিছু দেশে আঞ্চলিক বা বিশেষ ক্ষেত্রে মিশ্রপদ্ধতি চালু আছে। এমন দেশের মধ্যে মেক্সিকোতে ৩০০ আসন এফপিটিপি, ২০০ পিআর এর মাধ্যমে প্রতিনিধি নেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। ইতালিতে সময় সময় পদ্ধতি পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে মিশ্রপদ্ধতি অনুসরণ হচ্ছে। উরুগুয়েতে প্রার্থী ও পার্টির ভোটের মধ্যে ভারসাম্য রাখা হয়।
এফপিটিপি-পিআর বিতর্ক
বাংলাদেশে রাষ্ট্র সংস্কারের এজেন্ডা সামনে আসার পর থেকে বিদ্যমান এফপিটিপি ব্যবস্থা পরিবর্তনের দাবি উঠছে। সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যেও এ বিষয়টি স্থান পেয়েছে। সংস্কার প্রস্তাবে সংসদের উচ্চকক্ষ পিআর এবং নিম্নকক্ষ এফপিটিপি পদ্ধতিতে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। তবে নারী আসন পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। ফ্যাসিবাদবিরোধী বড় দলের মধ্যে বিএনপি বিদ্যমান ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলন পিআরকে জোরালোভাবে সমর্থন করছে।
তারেক রহমান বা বিএনপির সর্বোচ্চ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘নির্বাচনব্যবস্থা’ সংস্কারের বিষয়ে অনুসিদ্ধান্তমূলক স্পষ্ট ঘোষণা দেয়া হয়নি। তবে ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগের তামাশার নির্বাচনের আগে ও পরে বিএনপির অনেক নেতা নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের কথা বলেছিলেন। এখন অবশ্য দলের নেতারা পিআর পদ্ধতির জোর বিরোধিতা করে কথা বলছেন। বিএনপির এর বিরোধিতার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, বর্তমান বাস্তবতা হলো বাংলাদেশে প্রচলিত ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট ব্যবস্থায় বিজয়ী দলের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। পিআর পদ্ধতিতে বিজয়ী দল সেটি নাও পেতে পারে। আর একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে অন্য দলের সাথে কোয়ালিশন করতে হবে, যেটি বিএনপির নেতারা হয়তো কাম্য মনে করেন না। দ্বিতীয়ত, প্রচলিত ব্যবস্থায় বড় দলের পক্ষেই বেশি সুবিধা থাকে। ভোটের অনুপাতের তুলনায় বড় দলের আসনপ্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকে অনেক বেশি। বিএনপি এই সুবিধা পেতে চায়। তৃতীয়ত, বিদ্যমান ব্যবস্থায় মনোনীত প্রার্থীরা সরাসরি নির্বাচন করেন বলে দলের পক্ষে সমর্থন আদায়ে তৃণমূলপর্যায়ে ব্যাপক সক্রিয়তা থাকে, সাংগঠনিকভাবে দল পুনর্গঠনের সুযোগ থাকে, দলের কার্যক্রমে আর্থিক প্রবাহ তৈরি হয়। পিআর ব্যবস্থায় এ সুযোগ কম।
এর বাইরে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মনে করে, পিআর ব্যবস্থা ফ্যাসিবাদের অনুপ্রবেশের সুযোগ তৈরি করতে পারে, যা ‘বাংলাদেশকে বিভক্ত ও অস্থিতিশীল’ করে দিতে পারে এবং বিপর্যস্ত কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক দলের পুনরাবির্ভাব ঘটাতে পারে। বিএনপির প্রভাবশালী হয়ে ওঠা নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ ও অন্য কয়েকজন সিনিয়র নেতা সতর্ক করেছেন পিআর ও স্থানীয় সরকারের দাবি জাতীয় নির্বাচনের বিলম্ব বা বাধার হাতিয়ার হতে পারে। কোন কোন নেতা এ ব্যবস্থায় সংখ্যালঘুরা ক্ষমতাশালী হয়ে সংসদে অনেক আসন পাবে এবং তারা সরকার গঠনকে প্রভাবিত করতে পারে বলেও যুক্তি দেখান। এ ব্যবস্থায় তুলনামূলক ছোট দল বড় দলকে জিম্মি করতে পারে, যার ফলে সরকার গঠন ও এর স্থিতি বিপন্ন হতে পারে।
জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলনসহ বেশ কিছু ডান বাম মধ্যপন্থী দল পিআর নির্বাচনের পক্ষে জোর সমর্থন জানাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তাদের যুক্তির শীর্ষে রয়েছে বিদ্যমান ব্যবস্থায় ফ্যাসিবাদ আবার ফিরে আসতে পারে। এফপিটিপি ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে পতিত সরকার তিনটি মেয়াদের নির্বাচনকে হাস্যকর ব্যবস্থায় পরিণত করে ফ্যাসিবাদ কায়েম করে। এই ব্যবস্থায় নির্বাচন হলে তাতে পেশিশক্তি কালো টাকা আর প্রশাসনিক শক্তি প্রয়োগ করে জনসমর্থনকে ব্যর্থ করে দেবে। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় বেসামরিক ও পুলিশ প্রশাসনে প্রভাব বিস্তারকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। দ্বিতীয় যুক্তি হলো, পিআর পদ্ধতিতে জনগণের ভোটের সর্বোচ্চ মূল্য দেয়া হয়, জনগণ যতটা সমর্থন যে দলকে করে সে দল ততটা আসন লাভ করে। এ পদ্ধতিতে কেন্দ্র দখল বা ভোট ডাকাতির অবকাশ থাকে কম, পেশিশক্তি বা অর্থের দাপট নির্বাচনকে কলুষিত করতে পারে না। তৃতীয় যুক্তি হলো, এই ব্যবস্থায় দীর্ঘ মেয়াদে রাজনৈতিক সহনশীলতা সৃষ্টি হয়। এ ব্যবস্থায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের সম্ভাবনা কমে যায় বলে সরকার গঠনে অন্য দলের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়, যা রাজনৈতিক সহাবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টি করে। এ পদ্ধতির পক্ষে আরেকটি যুক্তি হলো, এতে রাষ্ট্রের সব জনগোষ্ঠী তাদের প্রতিনিধিত্বের সুযোগ পায় বলে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতা কমে যায়।
কী করা যেতে পারে
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন নির্বাচনী ব্যবস্থা ও অন্যান্য সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য তৈরি করে জুলাই সনদ প্রণয়নের চেষ্টা করছে। এই প্রচেষ্টায় একক মতের পরিবর্তে সমন্বিত মতের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের আগ্রহ রয়েছে। এ প্রচেষ্টায় দু’টি প্রধান মতের মধ্যে সমন্বয়ে একটি সমাধান সূত্র বের করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে একটি মানদণ্ড গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, সেটি হলো- কর্তৃত্ববাদের ফিরে আসা ঠেকাতে কোন পদ্ধতি উপযুক্ত।
বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা বারবার ফিরে আসার পেছনে প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে : ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, বিজয়ীদের সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ নেয়া, নির্বাচনী ব্যবস্থার দুর্বলতা, দুর্বল সংসদীয় জবাবদিহির ব্যবস্থা, দলীয় প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থা, ছোট দলের রাজনৈতিক অস্তিত্ব সঙ্কট, ভোটারদের প্রতিনিধিত্বহীনতা ইত্যাদি। এফপিটিপিতে এক আসনে সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থী জয়ী হয়। আর এই ব্যবস্থায় ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ও একদলীয় নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়। পিআর-এ ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন হয়। জনমত আরো নিখুঁতভাবে প্রতিফলিত হয়; ছোট দল টিকে থাকে। অন্য দিকে মিশ্র ব্যবস্থায় ভারসাম্য রক্ষা করে; স্থানীয় ও জাতীয় প্রতিনিধিত্ব সম্ভব করে তোলে।
তিনটি দেশের নির্বাচনব্যবস্থা সামনে রেখে এই সমন্বয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এই তিন দেশ হলো জার্মানি, তুরস্ক ও নেপাল। তিনটি দেশ এফপিটিপি ও পিআর ব্যবস্থার সমন্বয় করে যার যার মতো মিশ্রব্যবস্থা তৈরি করেছে। এই ব্যবস্থার শুরুর দিকে কিছুটা রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হলেও শেষ পর্যন্ত রাজনীতি ও সরকারে স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে। জার্মানিতে একই সাথে ব্যক্তি ও দল নির্বাচনের ব্যবস্থায় এফপিটিপি অনুসারে ব্যক্তি পছন্দ ও স্থানীয় নেতৃত্বে বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এ ব্যবস্থায় অ্যাঞ্জেলা মার্কেল কোয়ালিশন করেও দুইবারের বেশি সরকার গঠনে সক্ষম হন। তুরস্কে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এফপিটিপি ও দুই রাউন্ড নির্বাচনী ব্যবস্থায়, এমপি নির্বাচিত হন পিআর অনুসারে। ন্যূনতম আসনপ্রাপ্তির জন্য একটি ভোটপ্রাপ্তির (বর্তমানে ৭ শতাংশ) শর্ত থাকে। এ ব্যবস্থায় ২০০২ সাল থেকে এরদোগানের একে পার্টি ক্ষমতায় আছে। দেশটি এখন এক প্রভাবশালী আঞ্চলিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। নেপালের ফেডারেল সংসদে ৬০ ভাগ সদস্য এফপিটিপি এবং ৪০ ভাগ পিআর সিস্টেমে জয়ী হন। এ ব্যবস্থা প্রাদেশিক সংসদেও কার্যকর রয়েছে। ফেডারেল ও প্রাদেশিক সংসদ সদস্যরা আনুপাতিক ভোট দিয়ে উচ্চ পরিষদ নির্বাচন করে। সব ব্যবস্থার মধ্যে সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা রয়েছে। রাজতন্ত্র অবসান পরবর্তী সময়ে নেপালে সরকার নিয়ে অস্থিরতা দেখা দিলেও এখন সেটি অনেকখানি কেটে গেছে।
বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় সমন্বয়ের কোনো বিকল্প নেই। এতে বিদ্যমান ব্যবস্থা বহালের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তি যেমন হারবে না, তেমনিভাবে যারা পুরোপুরি পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাইছেন তাদেরও জয় হবে না। মাঝখানে কর্তৃত্ববাদের ফিরে আসার রাস্তা বন্ধ হবে। এ ক্ষেত্রে উচ্চ পরিষদ পুরোটা আনুপাতিক ভোটের ভিত্তিতে এবং নিম্ন পরিষদের ৪০০ আসনের (নারী আসনসহ) দুই-তৃতীয়াংশ এফপিটিপি এবং এক-তৃতীয়াংশ পিআর ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা হতে পারে।