
আলফাজ আনাম
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর এখন বছর অতিক্রান্ত হয়নি। এর মধ্যে ফ্যাসিবাদের সফট পাওয়ারগুলো সরব হয়ে উঠেছে। শেখ হাসিনার দেড় দশকের স্বৈরশাসনে নিপীড়নমূলক শাসনের পক্ষে ন্যায্যতা উৎপাদন করেছে এ দেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যম। অন্যদিকে বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো শেখ হাসিনার বিভাজনের রাজনীতিকে উসকে দিয়েছে। আমরা দেখছি, এ দুই পক্ষের দিক থেকে হাহাকার শোনা যাচ্ছে, যেন আগেই ভালো ছিলাম।
দেশে এক ধরনের অস্থিরতা চলছে। হাসিনার পতনের পর বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানগুলো একের পর এক দাবি-দাওয়া নিয়ে মাঠে নামছে। দেড় দশকে যাদের মুখে ভাষা ছিল না, তারাও সরব হয়ে উঠেছে। সবার লক্ষ্য দাবি আদায়ের জন্য রাজপথে নেমে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা।
ফলে প্রতিদিন রাজধানীর বড় অংশ কার্যত অচল হয়ে পড়ছে। এতে সরকারের ওপর মানুষ যে শুধু বিরক্ত হয়ে উঠছে তা নয়, যারা এসব আন্দোলন-সংগ্রাম করছেন, তাদের ওপর মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে। সরকারের মধ্যে সমন্বয়হীনতা বাড়ছে। এর একটি কারণ হলো রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তির উপদেষ্টা পরিষদে না থাকা।
অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা সরকারকে সব রাজনৈতিক দল সমর্থন দিয়েছিল। কিন্তু কয়েক মাস ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বিশেষ করে বিএনপির সঙ্গে সরকারের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। ফলে বিএনপি বিভিন্ন ইস্যুতে রাজপথে নেমে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। আবার ছাত্রদের রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিভাজন তৈরি হয়েছে। নতুন দল গঠনের কিছুদিনের মধ্যে একটি অংশ বেরিয়ে গিয়ে ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ বা আপ বাংলাদেশ নামে আলাদা প্ল্যাটফরম তৈরি করেছে।
ছাত্রদের দলের মধ্যে রয়েছে আদর্শিক বিভাজন। ইসলামপন্থি ও জাতীয়তাবাদী ধারার ছাত্রনেতারা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। বামপন্থিরা হয়েছে শক্তিশালী। অবশ্য যে রাজনৈতিক দলের বামপন্থিদের প্রভাব বাড়বে, সে দলের ভাঙন বা বিভাজন অনিবার্য। কারণ তাদের একটাই লক্ষ্য, অণু থেকে পরমাণু হওয়া। নিজের মতো চাপিয়ে দেওয়ার জন্য ছোট থেকে আরো ছোট হওয়া। ছাত্রদের দলও মনে হয় একই পরিণতির দিকে যাচ্ছে।
দেশের ভেতরে যখন নানাভাবে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে, তখন সীমান্তের ওপার থেকে সরকারের ওপর চাপ বাড়ানোর কৌশল নেওয়া হচ্ছে। সীমান্তজুড়ে চলছে পুশ ইনের চেষ্টা। স্থলপথে আমদানি নিষিদ্ধ করা কিংবা সীমান্তে সামরিক মহড়া চালিয়ে ভয় দেখানো ভেতর-বাইরের সমন্বিত প্রচেষ্টার অংশমাত্র। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে গণমাধ্যমে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা।
শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের পর সাধারণ মানুষের দাবি ছিল গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচার। একই সঙ্গে দেশের প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে ফ্যাসিবাদমুক্ত করা। কিন্তু অদৃশ্য কারণে এই দুটো কাজ শুরু থেকেই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অনভিজ্ঞ উপদেষ্টা পরিষদও যেন কোন কাজটি আগে করবে আর কোন কাজটি পড়ে করবে, তা নির্ধারণ করতে পারছে না।
আওয়ামী লীগের বিচারের বিষয়টি যদি সামনে আসে, তাহলে প্রথমে প্রশ্ন আসবে দলটির প্রথমসারির ক্ষমতাধর নেতারা কীভাবে পালিয়ে গেলেন? এ কথা সত্য, হাসিনা পলায়নের পর তিন দিন দেশে কোনো সরকার ছিল না। পুলিশ পালিয়ে গিয়েছিল। প্রশাসন ছিল বিশৃঙ্খল। কিন্তু এরপরও আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ নেতা দেশে ছিলেন। পরে তারা দেশত্যাগ করেছেন। এমনকি ক্যান্টনমেন্টে যারা আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাদের অনেকে নিরাপদে দেশ ছেড়ে চলে যান। আওয়ামী লীগ নেতাদের পালিয়ে যাওয়া ঠেকাতে তারা কার্যকর ভূমিকা নিতে পারেননি। এই নেতারা এখন বিদেশে বসে শুধু সরকার নয়, দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র করছেন। শেখ হাসিনা নিজে হত্যার হুমকি দিচ্ছেন।
আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে সবশেষ দেশ ছেড়েছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। তিনি প্রোটোকল নিয়ে সবাইকে জানিয়ে বিমানবন্দর দিয়ে দেশ ছেড়ে যান। এরপর ছাত্র-জনতা আবার বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। আন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও দলটির সহযোগী সংগঠনগুলো রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধন করে দলের বিচারের বিধান রেখে আইন সংশোধন করা হচ্ছে। আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হচ্ছে। কিন্তু এরপরও আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্র-জনতার মধ্যে হতাশা আছে এ সরকারের মেয়াদে কোনো বিচার শেষ হবে কি না?
অন্যদিকে ফ্যাসিস্টদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে চলছে এক ধরনের তামাশা। হরে দরে শত শত মানুষকে হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে। এসব মামলা পুলিশ বাদী হয়ে করেছে, এমন নয়। মামলার সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের সংশ্লিষ্টতা আছে। মামলার সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কও আছে। কিন্তু এসব মামলার মধ্য দিয়ে বিচারের বিষয়টি প্রশ্নের মুখে পড়তে যাচ্ছে।
গত দেড় দশকে ফ্যাসিবাদের পক্ষে ন্যায্যতা তৈরি করেছেন এ দেশের সংস্কৃতিকর্মী ও সাংবাদিকরা। কিন্তু তারা সবাই হত্যার নির্দেশদাতা বা হত্যার সঙ্গে জড়িত, এ কথা বলা যাবে না। তাদের অপরাধ সংজ্ঞায়িত করা দরকার ছিল। অপরাধের বিচার কীভাবে হবে, তার সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া বাতলে দেওয়া যেত। কিন্তু সরকার সেদিকে মনোযোগ দেয়নি। ফলে তারা আবার বাকস্বাধীনতা কিংবা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের স্বাধীনতার নামে রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের পরিবেশ সৃষ্টি করছেন।
আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে। এ আইনে নিষিদ্ধ সংগঠনের যেকোনো ধরনের তৎপরতার খবর প্রকাশ ও প্রচার বেআইনি করা হয়েছে। এ নিয়ে আওয়ামী সফট পাওয়ারের অংশ সাংবাদিকরা আপত্তি জানিয়েছেন। এর মধ্যে তারা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার আশঙ্কা দেখছেন। প্রশ্ন হলো, জেএমবির মতো নিষিদ্ধ সংগঠনের তৎপরতার খবর কি সংবাদপত্র প্রকাশ করে? তাহলে আওয়ামী লীগের খবর প্রচারে নিষেধাজ্ঞাকে তারা কেন মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পথে বাধা হিসেবে দেখছেন? আসলে তারা আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ করাকে মেনে নিতে পারছেন না।
ইউনূস সরকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করতে চাইছেÑএমন একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। আওয়ামী আমলে সরকারের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মিল রেখে বিরোধী মতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যা খুশি তা লেখা যেত। বছরের পর বছর ধরে জামায়াত-শিবির বা ইসলামপন্থিদের ওপর নিপীড়ন চালানোর পক্ষে বৈধতা তৈরি করেছে মূলধারার মিডিয়া।
কোনোপ্রকার তথ্যপ্রমাণ ছাড়া বহু রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে জঙ্গি ট্যাগ দিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকে জায়েজ করা হয়েছে। অভ্যুত্থানের পর দেশের মানুষ এখন গণমাধ্যমের এই ভূমিকা দেখতে চান না। তারা গণমাধ্যমেরও জবাবদিহি চাইছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় মূলধারার গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে এখন প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। যারা নিজেদের মিডিয়ার এলিট হিসেবে পরিচিত, তাদের ভুল খবর প্রকাশের জন্য ক্ষমা চাইতে হচ্ছে কিংবা খবর প্রত্যাহার করতে হয়েছে। এই ভুল স্বীকার নিজেদের তৈরি করা আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগছে। ফলে বলা হচ্ছে, গণমাধ্যম নাকি মবের চাপে পড়েছে।
ফ্যাসিস্টের সহযোগী সাংস্কৃতিক পাণ্ডারাও এখন মুখ খুলতে শুরু করেছেন। যারা প্রকৃত অপরাধী, তারা নিজেদের নিরপরাধ হিসেবে দাবি করছেন। আসাদুজ্জামান নূরের মতো ফ্যাসিবাদের পরিচিত সাংস্কৃতিক মুখ এখন নিজেদের নিরপরাধ দাবি করছেন। তার পক্ষে জনমত গঠনের চেষ্টা করা হচ্ছে। অথচ নীলফামারীতে তার গাড়িবহরে হামলার অভিযোগে যে মামলা করা হয়েছিল, সেই মামলার আসামিদের অন্তত তিনজনের লাশ পাওয়া গিয়েছিল। তারা সবাই ছিলেন ছাত্রদল ও শিবিরের নেতাকর্মী। এদের গুমের পর হত্যা করা হয়েছিল।
শেখ হাসিনার দুঃশাসনে সবচেয়ে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা। এখন বামপন্থি দলগুলো হয়ে উঠছে বিএনপির প্রধান মিত্র। এর মধ্যে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি সিপিবিও আছে। বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েমে সিপিবির সম্পৃক্ততা অনেক পুরোনো। শেখ মুজিবুর রহমানের একদলীয় শাসনের প্রধান সহযোগী ছিল সিপিবি। আবার শেখ হাসিনার দেড় দশকে শেখ হাসিনার শাসনে তারা প্রকাশ্য বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের নিপীড়নের পক্ষে সমর্থন জুগিয়েছে।
সিপিবির নেতারা পত্রিকায় কলাম লিখে শেখ হাসিনার দমন-পীড়নের পক্ষে জনমত গঠন করেছেন। গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে থাকা সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়নের অনুসারীরা এখন আবার আওয়ামী লীগকে কৌশলে ফিরিয়ে আনার পক্ষে জনমত গঠনের কাজ করে যাচ্ছেন। গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে থাকা বামপন্থিরা এখন পলাতক আওয়ামীদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে এক বয়ান তৈরি করার চেষ্টা করছেন, তা হলো মানুষের ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার অধিকার সীমিত হয়ে আসছে। দেশে ইসলামপন্থি মবের উত্থান হয়েছে। জনগণ যে এখন তাদের কাজের জবাবদিহি চাইছেন। সেই দিকটি তারা উপেক্ষা করছেন।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক