Image description
মীযানুল করীম

কয়েক দিন আগে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ‘হারুন স্যার’ মারা গেছেন। স্যারের পুরো নাম মোহাম্মদ হারুনুর রশীদ। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। তিনি রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে মারা যান। বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। এ দিক থেকে তার কম বয়স বলা যায় না। তার পরিবারের সদস্যরা বাংলা একাডেমিকে এই তথ্য জানান। কারণ, তিনি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ও সভাপতি ছিলেন। মহাপরিচালক থাকাকালে আমিও গিয়েছি উনার কাছে কয়েকবার। তিনি যে অভিধান বের করেছিলেন, এর প্রকাশনা অনুষ্ঠানে ছিলাম। কলকাতায় পর্যন্ত এর বিপুল চাহিদা ছিল। তিনি অভিধানে কাজে লাগিয়েছিলেন মরহুম প্রফেসর মোহাম্মদ আলীকে, যিনি তার বিভাগের সবচেয়ে সিনিয়র শিক্ষক ছিলেন।
 
হারুন স্যারের মৃত্যুর কথা শুনে মনে পড়ল, পিজি হাসপাতালে তার সাথে সাক্ষাতের কথা। স্যারের প্রথম স্ত্রী ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ওই হাসপাতালে মারা গিয়েছিলেন। সেখানে স্যারকে একটি টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে যেতে দেখি। স্যারের আপন বড় ভাই ছিলেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র সাংবাদিক ও লেখক আজিজ মিসির। তিনি বেশ কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। স্যারের পিতামহ ছিলেন খুব পরহেজগার, মাতামহ ছিলেন সুদখোর। এই দু’জনের মধ্যে কোনো মিলমিশ ছিল না। স্যারের পিতামহ তার মাতামহকে সুদ গ্রহণ ত্যাগ করতে বলেছিলেন। স্যারের বাড়ি ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া। স্যার বিশ্ববিদ্যালয়ে নামাজি সেক্যুলার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। দৈনিক নয়া দিগন্তে স্যারের মৃত্যুর পরে একটি ছবি ছাপা হয়েছে। স্যারের এক ভাই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে লজিং থাকতেন। স্যার ১৯৮৫ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেছিলেন। পরে তিনি বাংলা একাডেমিতে যোগ দেন প্রধান নির্বাহী বা মহাপরিচালক হিসেবে। তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন আমাদের দেশের একজন প্রবীণ গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের শিক্ষকের মেয়েকে। স্যারের দ্বিতীয় স্ত্রীকে দেখে প্রথম স্ত্রীর কথা মনে হয়েছিল।


স্যার আমাদের সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এফ রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি ছাত্র সংসদের সাথে মিলেমিশে কাজ করতে পারতেন। ছাত্র সংসদ তার বিরোধী মতাদর্শের অনুসারী হলেও ব্যক্তিগতভাবে তার অসুবিধা হতো না। তিনি হলের মাঠে কাজ করছেন, এরকম একটি ছবি আমার মনে ভাসছে, তখন হলের ক্ষমতায় ‘ইসলামী ছাত্রশিবির’ কিন্তু তাতে স্যারের কোনো অসুবিধা হচ্ছিল না।

স্যার প্রাধ্যক্ষ এবং শিক্ষক হিসেবে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। হলের দলমত নির্বিশেষে ছেলেদের কাছে এবং বিভাগের সব ছাত্রের কাছে তিনি প্রিয় ছিলেন। কারণ, তিনি ছাত্রদের সাথে মিশতে পারতেন। তিনি আমাদের ক্লাসমেট এক মেয়েকে বলেছিলেন, ‘তোমার ইংরেজি উচ্চারণ শুনে তোমার বাড়ি বাংলাদেশের কোন জেলায় তা বলে দেবো।’ ঠিকই মেয়েটির বাড়ি যে, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে, তা তিনি বলে দিয়েছিলেন। তিনি আমাদের প্রথম ‘Phonetics’ শিক্ষক। তখনো বাংলাদেশের অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিভাগ চালু হয়নি। ইংরেজি বিভাগের প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাস দেখে আমরা হতবাক হয়ে গেলাম। স্যারের ঐকান্তিক চেষ্টায় আমরা reading, speaking, listening I writing skill আয়ত্ত করলাম। স্যার বিখ্যাত ক্যামব্রিজ ভার্সিটি থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়েও কোনো গর্ববোধ করতেন না। অথচ তিনি নামের সাথে Cantab লিখতেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের তিনজন শ্রেষ্ঠ কবির কয়েকটি কবিতার অনুবাদ করেছিলেন। ‘The Three Poets’ নামে এই বই বের হয়েছিল। তিনি একজন লেখক হলেও তার পরিচয় দিতেন না। সিলেট এমসি কলেজ থেকে তিনি এসেছিলেন এবং আমাদের সময়ে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন। নিরাবরণ মানুষটি কাজেকর্মে ছিলেন অত্যন্ত সাধারণ। তিনি ছিলেন কর্মী পুরুষ। ঢাকার ইস্কাটনের বাসায় থাকতেন। তখন ফোনে কথা হয়েছিল জনৈক নেতার ছেলের ভর্তির ব্যাপারে। হারুন স্যার রেগুলার নামাজি ছিলেন। হয়তো তিনি তার পূর্বপুরুষের অভ্যাস পেয়েছিলেন। স্যারের দুই ছেলে, এক মেয়েকে চিনতাম।

হারুন স্যার স্কুলশিক্ষকের মতো ছিলেন আন্তরিক। তার মধ্যে কোনো অহঙ্কার ছিল না। তিনি সবার সাথে মিশতে পারতেন। স্কুলশিক্ষকের মতো তিনি সব ছাত্র-ছাত্রীকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন। Phonetics-এর মতো নতুন বিষয় তাকে ছাড়া কল্পনা করা যেত না। আল্লাহ তায়ালা তাকে বেহেশতে উচ্চ স্থান দান করুন।নয়াদিগন্ত