ঋণ কেলেঙ্কারিতে জড়িত এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকাকালীন বেসরকারি খাতের ইউনিয়ন ব্যাংক ২০২৩ সালের হিসাব সংশোধনের পর ২৯২ কোটি টাকার ক্ষতি দেখিয়েছে, যেখানে ব্যাংকটির আগের নিরীক্ষিত স্থিতিপত্র বা ব্যালান্স শিটে কৃত্রিমভাবে ওই বছরের জন্য ১৬২ কোটি টাকার মুনাফা দেখানো হয়।
চতুর্থ প্রজন্মের এই ব্যাংক, যা বর্তমানে আরও চারটি ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে, গতকাল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওয়েবসাইটে তাদের সংশোধিত আর্থিক বিবরণী প্রকাশ করেছে।
এতে ব্যাংকটি ২০২৩ সালের জন্য ঘোষিত ৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ বাতিল করেছে, এবং বিপুল ক্ষতির কারণে কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এই সংশোধন আসে ব্যাংকের নিরীক্ষক এম এম রহমান অ্যান্ড কোং -এর মাধ্যমে, যারা এর আগের লাভ-দেখানো স্থিতিপত্র-ও প্রস্তুত করেছিল। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করা হলেও, গত বছরের আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ব্যাংকের বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) অনুষ্ঠিত না হওয়ায় লভ্যাংশ বিতরণ সম্ভব হয়নি।
একই নিরীক্ষক সংস্থার প্রতিবেদনে এত বড় অমিল কীভাবে দেখা দিল, জানতে চাইলে ইউনিয়ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হুমায়ুন কবির বলেন, আগের ম্যানেজমেন্ট ব্যাংকের প্রকৃত আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে সঠিক কাগজপত্র তখন দেয়নি।
তিনি বলেন, অডিটর বা নিরীক্ষকরা ক্লায়েন্টের সরবরাহ করা নথির ভিত্তিতেই প্রতিবেদন তৈরি করে। গণমাধ্যমে দুর্নীতির খবর প্রকাশের পর অডিটররা নিজেরাই ব্যাংকের কাছে পুনরায় নিরীক্ষার প্রস্তাব দেন। সেই প্রেক্ষিতে ব্যাংক একই অডিটরকে পুনর্নিয়োগ করে, যারা এবার প্রকৃত আর্থিক চিত্র তুলে ধরেছে।
হুমায়ুন কবির জানান, আদায় না হলেও আগের ম্যানেজমেন্ট এস আলম গ্রুপের ঋণকে নিয়মিত দেখিয়েছিল এবং প্রকৃত খেলাপি ঋণ গোপন করেছিল।
সংশোধিত আর্থিক বিবরণী অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জন্য ইউনিয়ন ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) দাঁড়িয়েছে নেগেটিভ ২.৮ টাকায়, যেখানে আগে তা পজিটিভ ১.৫৮ টাকা দেখানো হয়েছিল।
১০ টাকার ফেসভ্যালুর বিপরীতে রোববার ডিএসইতে ইউনিয়ন ব্যাংকের শেয়ারের দাম কমে দাঁড়ায় ১ টাকা ৭০ পয়সায়। ২৪ সেপ্টেম্বর এটি সর্বনিম্ন ১ টাকা ৫০ পয়সায় নেমে এসেছিল।
তীব্র আর্থিক সংকটে থাকা ইউনিয়ন ব্যাংককে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক অন্য কয়েকটি ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণের উদ্যোগ নিয়েছে। এর কারণ, ইউনিয়নের খেলাপি ঋণ জুনে যেখানে ছিল ১,০০০ কোটি টাকা, সেখানে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর নাগাদ তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ২৫,০০০ কোটি টাকায় — মাত্র ছয় মাসে ২৫ গুণ বৃদ্ধি। মোট ঋণের মধ্যে খেলাপির হার ৩.৮২ শতাংশ থেকে বেড়ে ৮৭ শতাংশ পৌঁছায়, যার ফলে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতেও পারছিল না ব্যাংকটি।
২০১৩ সালে রাজনৈতিক প্রভাবে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ইউনিয়ন ব্যাংক প্রায় এক দশক ধরে মন্দ ঋণ লুকিয়ে রেখেছিল, যাতে কৃত্রিমভাবে কম খেলাপি হার দেখিয়ে আর্থিকভাবে সুস্থ অবস্থার ভুয়া চিত্র তুলে ধরা যায়।
তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এসব গোপন সত্য প্রকাশ পেতে শুরু করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, সরকারের পতনের পর যে ১.৩৫ লাখ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ বাড়ার তথ্য উন্মোচিত হয়েছিল, তার ১৮ শতাংশের জন্যই দায়ী ইউনিয়ন ব্যাংক।
খেলাপির এই বিপুল বৃদ্ধি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি বাড়িয়ে তোলে ১৪ হাজার কোটি টাকায় এবং মূলধন মারাত্মকভাবে ক্ষয় হয়। ফলে ব্যাংকটি টিকে থাকতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে আরও জানা যায়, ২০২২ সালে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত ইউনিয়ন ব্যাংক পুরোপুরি এস আলম গ্রুপ পরিবারের নিয়ন্ত্রণে ছিল, যাদের শেয়ার ধারণ ছিল ২৬.১৮ শতাংশ।
তদন্তে দেখা যায়, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির মোট ২৮ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে এস আলম গ্রুপের ঋণ ২০ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭২ শতাংশ।
বিতর্কিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ২৪টি নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সরাসরি এবং আরও ২৫৯টি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে এসব ঋণ নিয়েছিল, তবে এর খুব সামান্য অংশই ফেরত দিয়েছে।
একই ধাঁচে, বাংলাদেশ ব্যাংকের জুলাইয়ের এক অডিটে দেখা যায়, এস আলম গ্রুপের পূর্বনিয়ন্ত্রিত গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকও ২০২৩ সালের জন্য প্রকৃত ২ হাজার ২৫৯ কোটি টাকার লোকসান গোপন রেখে ১২৮ কোটি টাকার মুনাফার মিথ্যা ঘোষণা দিয়েছে।
অডিটের ফলাফলের পর ব্যাংকটির ঘোষিত ৫ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ বাতিল করা হয়।