Image description

ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান উত্তরা ফাইন্যান্সের আর্থিক অবস্থা নাজুক। গত পাঁচ বছর ধরে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি। আবার আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতেও পারছে না। লোকসানি প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও অপ্রয়োজনীয় খরচ চলছেই।

পাশাপাশি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ মাকসুদুর রহমানের স্বেচ্ছাচারিতায় ঋণ সুবিধা প্রাপ্তি কিংবা ঋণ পুনঃতফসিলিকরণের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করছে না উত্তরা ফাইন্যান্স।

সম্প্রতি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মসহ নানা দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তাকে পদ থেকে অপসারণ করে তদন্তের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য উত্তরা ফাইন্যান্সের ৭৮ শেয়ারহোল্ডার বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানের পুলে ১৭টি গাড়ি রয়েছে। এরপরও ২০২৪ সালের এপ্রিলে নতুন করে আরো দুটি গাড়ি কেনা হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে এক কোটি ৪৭ লাখ টাকা। অথচ নানা সংকটের কারণে প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯ সালের আর্থিক বিবরণী এখনো প্রস্তুত করতে পারেনি। উত্তরা ফাইন্যান্সের বর্তমান নাজুক আর্থিক পরিস্থিতিতে, অর্থাৎ লোকসানি প্রতিষ্ঠানের বিলাসবহুল দুটি গাড়ি কেনার যৌক্তিকতা দেখছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৯ সালে এই ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির (এনবিএফআই) আর্থিক প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে। কেপিএমজি বাংলাদেশের মাধ্যমে ২০২০ সালে নিরীক্ষা চালানো হয়। এতে ৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকার আর্থিক অসংগতি পাওয়া যায়। এরপর ২০২২ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক উত্তরার ব্যবস্থাপনা পরিচালককে অপসারণ করার পাশাপাশি পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে নতুন বোর্ড গঠন করা হয়। তবে দৃশ্যত এর তেমন প্রভাব পড়েনি কোম্পানির পরিস্থিতি উন্নয়নে। ওই বছর প্রতিষ্ঠানটি ১২৬ কোটি টাকা লোকসান করে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছর পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীরা প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের লভ্যাংশ পাননি। বর্তমান আর্থিক অবস্থা সম্পর্কেও তাদের ধারণা নেই, যেহেতু আর্থিক প্রতিবেদনই আর প্রকাশ করা হচ্ছে না। আর্থিক অবস্থা দুর্বল হওয়ায় সম্প্রতি ২০টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিলের উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। সেখানে উত্তরা ফাইন্যান্সের নামও ছিল। প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণ রয়েছে এক হাজার ৩২৮ কোটি টাকা।

এদিকে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা নাজুক হলেও চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ মাকসুদুর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি থেকে ঋণ সুবিধা প্রাপ্তি কিংবা ঋণ পুনঃতফসিলিকরণের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করছেন না তিনি। ঘুসের বিনিময়ে অনেক প্রতিষ্ঠানকে ঋণ পুনঃতফসিলিকরণ সুবিধা দিয়ে আসছেন। আওয়ামীপন্থি ঋণগ্রহীতাদের খেলাপি ঋণ মামলাযোগ্য হলেও অর্থ গ্রহণের বিনিময়ে সেগুলোকে নিয়মিত ঋণ হিসেবে দেখানোর সুযোগ করে দিচ্ছেন। কিন্তু সাধারণ ঋণগ্রহীতারা মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ পুনঃতফসিলিকরণের আবেদন জানালেও সেগুলোকে আমলে নিচ্ছেন না চেয়ারম্যান।

মেজর জেনারেল (অব.) মাকসুদুর রহমানকে ২০২২ সালে উত্তরা ফাইন্যান্সের স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পরবর্তীতে তিনি পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তবে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন এবং একাধিক স্বতন্ত্র পরিচালকের মতামত উপেক্ষা করে প্রহসনের মাধ্যমে তিনি বোর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগে বলা হয়, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের লোক এবং ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী (বর্তমানে পলাতক) আ ক ম মোজাম্মেল হকের আত্মীয় হিসেবে পরিচিত। তাদের ক্ষমতাবলে তাকে নিয়োগ করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকে মাকসুদুর রহমানের বিরুদ্ধে দেওয়া লিখিত অভিযোগে জানা যায়, ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য খেলাপি প্রতিষ্ঠান ‘আনোয়ার খান মডার্ন কলেজ ও হাসপাতাল’-এর মালিককে নিয়মিত ঋণগ্রহীতা হিসেবে দেখানোর সুযোগ করে দেওয়ার জন্য পুনঃতফসিল নোট বোর্ডে উপস্থাপনে ম্যানেজমেন্টকে বাধ্য করা হয় এবং তাতে অনুমোদনও দেওয়া হয়। প্রায় ৬০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলিকরণের সুযোগ দেওয়া হয়; কিন্তু এক বছর পার হয়ে গেলেও সে ঋণের একটি কিস্তিও আদায় সম্ভব হয়নি। আনোয়ার খানের ঋণ পুনঃতফসিলিকরণেও মোটা অঙ্কের ঘুসের লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।

অপরদিকে সাধারণ ঋণগ্রহীতাদের ঋণ পুনঃতফসিলিকরণের সুযোগ না দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মাধ্যমে মামলা দায়ের করানোর প্রচেষ্টা চালানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ প্রসঙ্গে ডায়নামিক স্টক ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের উদাহরণ উল্লেখ করে বলা হয়, এ প্রতিষ্ঠান তাদের মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের বিপরীতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ ডাউন পেমেন্টের মাধ্যমে ঋণ পুনঃতফসিলিকরণের আবেদন করলেও চেয়ারম্যান এগুলো আমলে নেননি। উভয় পক্ষের সমঝোতার মাধ্যমে এসব ঋণ নিয়মিতকরণের সুযোগ ছিল। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির লক্ষ্যে চেয়ারম্যান রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার চেষ্টা করছেন।

এতে আরো বলা হয়, উত্তরা ফাইন্যান্সের ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠান ‘বিজেজি টেক্সটাইল’কে তাদের খেলাপি ঋণ সেটেলমেন্টের জন্য তিন মাসের সময় দিয়েছিল পর্ষদ। কিন্তু চেয়ারম্যান পর্ষদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে দেড় মাস নির্ধারণ করে মিনিটস চূড়ান্ত করেন। সে সময়সীমা অতিবাহিত হওয়ার ১৫ দিন পর কোম্পানিটি ৫০ কোটি টাকার পে-অর্ডার নিয়ে এলেও নির্ধারিত সময় পার হয়ে যাওয়ার কারণ দেখিয়ে সেটি গ্রহণ করা হয়নি। পরবর্তীতে বিজেজি টেক্সটাইলকে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করতে ম্যানেজমেন্টকে বাধ্য করা হয়। এতে কোম্পানিটি খেলাপি প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে এবং আর্থিক সংকটকালে উত্তরা ফাইন্যান্স ৫০ কোটি টাকা প্রাপ্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলো।

চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ঢাকার টঙ্গী বাজারে অবস্থিত তার আত্মীয়র মালিকানাধীন পিয়ারেজ প্রোপার্টিজ লিমিটেডকে ২০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার জন্য ম্যানেজমেন্টকে অত্যন্ত চাপের মুখে রাখেন। কিন্তু মর্টগেজ সম্পত্তিতে নানা জটিলতার কারণে সে ঋণটি অনুমোদন করা না যাওয়ায় তৎকালীন গুলশান শাখার ম্যানেজারকে বিভিন্নভাবে হেনস্তা করেন চেয়ারম্যান। তাছাড়া চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ম্যানেজমেন্টের কাজে অযাচিত হস্তক্ষেপ, প্রতিষ্ঠানে নিজের প্রভাব বলয় তৈরি, নিজের পছন্দমতো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ঋণ সুবিধা প্রদান, লিগ্যাল ফার্ম নিয়োগে অনিয়ম, গাড়ি ব্যবহারে যথেচ্ছাচারসহ আরো বেশ কিছু অভিযোগ আনা হয়েছে।

অভিযোগকারী ও অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে উত্তরা ফাইন্যান্সের চেয়ারম্যান মাকসুদুর রহমান আমার দেশকে বলেন, ৭৮ জন নয়, ৮০০ জন অভিযোগ দিলেও সমস্যা নেই। কারণ, আমরা কোনো অপরাধ করিনি। উনারা যে অভিযোগ দিয়েছে, তা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এলে তখন দেখব। কারণ, আমি কোনো কিছুই করিনি। তাই অভিযোগে ভয় পাই না।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান আমার দেশকে বলেন, অভিযোগের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত করবে। তদন্তে কোনো সত্যতা পাওয়া গেলে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।