Image description

গত সরকারের সময় লুকানো খেলাপি ঋণ এখন বেরিয়ে আসায় ব্যাংক খাতে সার্বিকভাবে এর পরিমাণ পাঁচ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এর বাইরে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে খেলাপি দেখানো যাচ্ছে না আরও এক লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। বিভিন্ন ব্যাংকের এক হাজার ৮৬ জন ঋণ গ্রহীতার ২৭ হাজার ৩০২টি ঋণের বিপরীতে বিপুল অঙ্কের এ অনাদায়ী ঋণ নিয়মিত দেখাতে হচ্ছে। এসব ঋণগ্রহীতা নিয়মিত গ্রাহকদের মতো সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী কোনো ঋণ ছয় মাস মেয়াদোত্তীর্ণ হলে তা খেলাপি হিসেবে বিবেচিত হয়। এক ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি হলে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নতুন ঋণ নিতে পারে না। খেলাপি থাকা অবস্থায় আমদানি-রপ্তানির জন্য এলসি খুলতে পারে না। ঋণখেলাপি ব্যক্তি ব্যাংকের পরিচালকও থাকতে পারেন না। এমনকি কোনো ধরনের নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন না। এ জন্য যে কোনো ঋণ বিতরণের আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ তথ্য ব্যুরো (সিআইবি) থেকে যাচাই করতে হয়। তবে অনেকেই উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ নেওয়ার কারণে সিআইবিতে খেলাপি দেখানো হয় না। ফলে ঋণ পরিশোধ না করেও সব ধরনের সুবিধা পাচ্ছেন তারা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বলেন, খেলাপিকে খেলাপিই বলা উচিত। কেউ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ আনলেও তাকে খেলাপি দেখানো উচিত। আর এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক, সরকার এবং বিচার বিভাগকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তা না হলে আর্থিক খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।
জানা গেছে, ঋণখেলাপিদের ঢালাও আইনি সুরক্ষা বন্ধের জন্য ব্যাংক কোম্পানি আইন এবং অর্থ ঋণ আদালত আইন সংশোধনের মাধ্যমে আরও কঠোর বিধান যুক্ত করার প্রস্তাবনা নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর এ জন্য বিভিন্ন ব্যাংকে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশে কী পরিমাণ ঋণ আটকে আছে এবং ব্যাংকের রিপোর্টে দেখানো হচ্ছে– এমন খেলাপি ঋণের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। দুয়ে মিলে গত জুন পর্যন্ত খেলাপি রয়েছে ছয় লাখ ৯৩ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা। ব্যাংক খাতের মোট ঋণের যা ৩৯ শতাংশের বেশি। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে এক হাজার ৮৬ জনের এক লাখ ৬৩ হাজার ১৫০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়মিত দেখানো হচ্ছে। এ তালিকায় থাকা প্রতিজনের কাছে গড় পাওনা ১৫০ কোটি টাকা। এর বাইরে দৃশ্যমান খেলাপি ঋণ পাঁচ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। গত বছরের জুনে যেখানে দৃশ্যমান খেলাপি ছিল মাত্র দুই লাখ ১১ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা। এক বছরে নতুন করে খেলাপির খাতায় যুক্ত হয়েছে প্রায় তিন লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। এর আগে ২০২৩ সালের জুন শেষে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। আর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের সময় ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা।

মতামত জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম সমকালকে বলেন, এদের অনেকেই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা অর্থ পাচার করে বিদেশে নিয়ে গেছে। ফলে শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোরতায় কাজ হবে না। খেলাপিরা জানে, মামলাগুলো বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রাখা যাবে। তারা ঘুষ দিয়ে মামলা পিছিয়ে দিচ্ছে। ঋণখেলাপির এই চক্র থেকে বের হতে হলে খেলাপি ঋণ ট্রাইব্যুনাল করতে হবে কিংবা সুপ্রিম কোর্টের সুনির্দিষ্ট বেঞ্চ গঠন করে এদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। 

উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নেওয়া বিভিন্ন আদেশের কপি প্রতিনিয়ত বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে পাঠানো হয়। এমন কয়েকটি আদেশ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখার গ্রাহক বাংলা-ইউকে এগ্রো প্রোডাক্ট। গত ১৮ মে হাইকোর্টে রিট করে প্রতিষ্ঠানটি। রিট আবেদনে সিআইবিতে খেলাপি না দেখানো এবং এর আগে জমা দেওয়া ১০ কোটি ৭৪ লাখ টাকা এখন ঋণ পুনঃতপশিলের ডাউনপেমেন্ট হিসেবে দেখানোর সুযোগ দিতে আবেদন করা হয়। গত ১৮ জুন বাংলা-ইউকে এগ্রোর এ আবেদন শুনানি শেষে ৬০ দিনের মধ্যে আবেদন নিষ্পত্তি করতে বলা হয়েছে। আর রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সিআইবিতে খেলাপি দেখাতে বলা হয়েছে। গত ১৭ মে আদালত ওয়ান ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখার গ্রাহক ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে ৮০ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করে সিআইবিতে খেলাপি না দেখানোর আদেশ দেন। আদালত সম্প্রতি চট্টগ্রামের বায়েজিদ স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজকে খেলাপি না দেখানোর আদেশ দেন। 

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে নিয়মিত দেখানো আগের তুলনায় এখন কঠিন করা হয়েছে। যদিও আগের স্থগিতাদেশসহ হয়তো এ ধরনের ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। এখন আর আগের মতো অনেক বেশি সময়ও দিচ্ছেন না আদালত। অনেক ক্ষেত্রে কিছু ডাউনপেমেন্টের শর্ত জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোকে স্থগিতাদেশের কারণে নিয়মিত দেখানো ঋণের তথ্য জানানো হচ্ছে। এ ছাড়া অর্থ ঋণ আদালতের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এখন ব্যাংকগুলোর জন্য বেঞ্চ ভাগ করে দেওয়া হচ্ছে। এভাবে চললে খেলাপি ঋণ সমস্যার সমাধান হবে। উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের জন্য আবেদন করতে হলে বকেয়া স্থিতির অন্তত ১০ শতাংশ দেওয়ার বিধান করা উচিত বলে তিনি মনে করেন। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে থেকে খেলাপিদের জন্য একের পর এক নীতি শিথিল করা হয়। তবে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে ঋণ জালিয়াতি ও অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন আর আগের মতো ঋণখেলাপিদের জন্য নীতিসহায়তা দিচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে গুণগত মান বিচারে খেলাপি দেখাতে বলা হচ্ছে। যে কারণে ব্যাংকগুলো এখন খেলাপি ঋণ আদায় জোরদার করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রভাবশালী অনেকের বন্ধকি সম্পত্তি ব্যাংক নিলামে তুলছে। খেলাপি ঋণ নীতিমালায়ও কঠোরতা আনা হয়েছে। নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) ঘাটতি রেখে ২০২৪ সালের জন্য লভ্যাংশ দিতে দেওয়া হয়নি। এসব কারণে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ কমাতে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেছে। বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়ে পাচারকারীদের চাপে রাখতে যৌথ তদন্ত চলছে। এদের সম্পত্তি ফ্রিজের জন্য বিভিন্ন দেশে আবেদন করেছে বাংলাদেশ।

ব্যাংকাররা জানান, ঋণখেলাপিদের অনেকেই সামান্য কিছু টাকা খরচ করে আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসছে। বিশেষ করে বড় ঋণগ্রহীতারা এ ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে। নিয়মিত দেখানো হলেও এসব ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোর আয় নেই। এর পরও আয় দেখিয়ে ব্যাংকগুলো লভ্যাংশ দিয়ে দিচ্ছে। আবার নিয়মিত দেখানোর সুযোগের কারণে অন্য ব্যাংক থেকে ঋণসহ বিভিন্ন সুবিধা নিতে খেলাপিদের বাধা নেই। ফলে স্থগিতাদেশ দিলেও এমন কোনো বিধান যুক্ত করতে হবে, যেন ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।